রাজনৈতিক বিবেচনায় এমপিও, বাদ পড়ার শঙ্কায় যোগ্য প্রতিষ্ঠান!
এমপিও দেয়ার ক্ষেত্রে চরাঞ্চল, দুর্গত, নারী শিক্ষাসহ আরও কয়েকটি ক্যাটাগরি বিশেষ বিবেচনায় রাখতে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে ডিও লেটার দিয়েছেন এমপিরা। গত সপ্তাহ পর্যন্ত শতাধিক এমপি আড়াই শতাধিক প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ বিবেচনায় এমপিও দেয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের চাপে বাদ পড়ার শঙ্কায় পড়েছে যোগ্য অনেক প্রতিষ্ঠান।
নির্ধারিত শর্ত পূরণ করতে না পারলেও শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় মন্ত্রী-এমপিরা পেতে যাচ্ছে বিপুলসংখ্যক অখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ লক্ষ্যে প্রাথমিক প্রস্তুতিও গুটিয়ে আনা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকার ক্ষমতাসীন দলীয় সাংসদদের কাছ থেকে এরইমধ্যে শতাধিক আধা সরকারি পত্র (ডিও) লেটার নেয়া হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত কয়টি প্রতিষ্ঠানকে এই বিশেষ ক্যাটাগরিতে এমপিও দেয়া হবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির পর তা জানা যাবে।
জানা গেছে, এমপিও দেয়ার ক্ষেত্রে চরাঞ্চল, দুর্গত, নারী শিক্ষাসহ আরও কয়েকটি ক্যাটাগরি বিশেষ বিবেচনায় রাখতে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে ডিও লেটার দিয়েছেন তারা। গত সপ্তাহ পর্যন্ত শতাধিক এমপি প্রায় আড়াই শতাধিক প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ বিবেচনায় এমপিও দেয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন। ডিও লেটারে এমপিরা এসব প্রতিষ্ঠানের নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার কথা উল্লেখ করেছেন। এসব প্রতিবন্ধতা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার কারণে এমপিওভুক্তির নির্ধারিত শর্ত পূরণ করতে পারেনি। সেজন্য এসব প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ বিবেচনায় এমপিও দেয়ার প্রয়োজন বলেও মনে করেন আইন প্রণেতারা। এসব প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হলে স্ব স্ব অবস্থান থেকে শিক্ষার আলো আরও দ্রুত ছড়াতে পারবেন বলে উল্লেখ করেছেন তারা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ ২০১০ সালের এমপিও দিতে গিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই এবার এমপিওভুক্তিতে স্বচ্ছতার জন্য নতুন পদ্ধতি চালু করা হয়। নতুন নিয়ম অনুযায়ী এমপিও পেতে ইচ্ছুক প্রতিষ্ঠানগুলো অনলাইনে নির্দিষ্ট ফর্মে আবেদন করে তার সব তথ্য জমা দিয়েছে। আবেদনের যোগ্যতা হিসেবে ১০০ নম্বর নির্ধারণ করা হয়। সেখানে প্রতিষ্ঠানের বয়স, শিক্ষক-শিক্ষার্থীসংক্রান্ত তথ্য, পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ও পাসের হার, অবকাঠামো ইত্যাদি বিবেচনায় নম্বর দেয়া হয়। সারা দেশের সাড়ে ৭ হাজার প্রতিষ্ঠান এমপিও জন্য আবেদন করে। সেখান থেকে মাত্র দুই হাজার তিনশ প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত যোগ্যতা অর্জন করে। এর মধ্যে স্কুল-কলেজ প্রায় ১২শ, মাদ্রাসা ৫শ এবং সাড়ে ৩শ কারিগরি প্রতিষ্ঠান। নির্ধারিত শর্ত পূরণ করে ফিটলিস্টে জায়গা পায়নি এমন উপজেলাও রয়েছে। আবার একই উপজেলা থেকে ১০টি বেশি প্রতিষ্ঠান ফিটলিস্টে জায়গা পেয়েছে। এগুলো যাচাই বাচাই করার পর এমপিওতে এলাকা ভিত্তিক বৈষম্য কমাতে ‘বিশেষ বিবেচনা’ এমপিও দেয়ার কথা ভাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
মূলত এরই প্রেক্ষিতে দুর্গম, চরাঞ্চল, পিছিয়ে পড়া ও নারী শিক্ষায় বিশেষ অবদান রাখছে এমন ক্যাটাগরির প্রতিষ্ঠানকে এমপিও পেতে স্থানীয় সংসদ সদস্যের ডিও লেটার চাওয়া হয়। এরপর ডিও লেটারে হিড়িক পড়েছে মন্ত্রণালয়। যা নিয়ে অনেকটা বিব্রত অবস্থায় পড়েছে মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা গেছে, সরকারি দলের মন্ত্রী-এমপিদের প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি থেকে বাদ পড়লে অসন্তোষের শঙ্কা থেকে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে উল্টোটা। ফিটলিস্টে ৫-৭টি প্রতিষ্ঠান থাকার পরও বিশেষ বিচেনায় আরও প্রতিষ্ঠান চেয়ে ডিও লেটার দিয়েছেন তারা।
তবে এমপিওভুক্তির তালিকা তৈরির সঙ্গে জড়িত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সফটওয়ারের মাধ্যমে অটোমেশন পদ্ধতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকা করা হয়েছে। তবে পিছিয়ে পরা হাওর, পাহাড় ও চরাঞ্চলের বিশেষ কিছু প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হবে। নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও অগ্রাধিকার পাবে। সেটি খুবই কম। সেজন্য এত ডিও লেটার জমা পড়বে ভাবতে পারেনি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ আসন (নবীনগর) সংসদ সদস্য মোহাম্মদ এবাদুল করিম নবীনগর উপজেলার ‘লাপাং উচ্চ বিদ্যালয়কে’ বিশেষ বিবেচনায় এমপিও দিতে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে ডিও লেটার দিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটি পশ্চাদপদ, হাওর-বাঁওড়, চরাঞ্চল নিয়ে একটি জনপথ। লাপাং ভৌগোলিকভাবে বন্যা, পস্নাবিত ও শিক্ষাদীক্ষায় পশ্চাদপদ এলাকা। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে এ প্রতিষ্ঠানটি এই এলাকার শিক্ষা বিস্তারে কাজ করে যাচ্ছে।বলে ডিও লেটারে উলেস্নখ করেছেন। এ কারণে প্রতিষ্ঠানটি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ‘বিশেষ বিবেচনায়’ এমপিওভুক্ত করতে অনুরোধ করেন তিনি।
এ ব্যাপারে এমপি এবাদুল করিম বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় যে ক্যাটাগরিতে তালিকা তৈরি করেছে সেখানে এ প্রতিষ্ঠানটি স্থান পায়নি। কারণ প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধে করে তারা শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে। সেখানে নির্ধারিত শর্ত পূরণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই বিশেষ বিবেচনায় এমপিওভুক্ত করতে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করেছি। এটাকে রাজনৈতিক বিবেচনা মানতে নারাজ তিনি।
একই অনুরোধ করেছেন নরসিংদী-২ আসনের এমপি ও শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন। তিনি তার নির্বাচনী আসনে ৩টি প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ বিবেচনায় এমপিওভুক্ত করতে ডিও লেটার দিয়েছেন। প্রতিষ্ঠান তিনটি হলো মনোহরদী উপজেলার সরদার আহমত আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ, খিদিরপুর ডিগ্রি কলেজ ও বেলাবো উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা নজিব উদ্দিন খান কলেজ।
এ তিনটি প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ বিবেচনায় এমপিওভুক্ত করার কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, এ প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরে এ এলাকার শিক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। বিশেষ করে নারী শিক্ষায় বিশেষ অবদান রাখছে। এ ব্যাপারে এমপি বলেন, ‘এমপিওভুক্তির জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় যে ফিটলিস্ট করেছে তাতে এসব প্রতিষ্ঠানগুলো নেই। যেসব শর্তাবলি পূরণ করার পর ফিটলিস্টে স্থান পাওয়ার কথা এসব প্রতিষ্ঠানে সেসব সুযোগসুবিধা নেই। পিছিয়ে পড়া জনপদ ও গোষ্ঠীকে শিক্ষার আলো ছড়াতে তারা কাজ করছে। এজন্য এসব প্রতিষ্ঠানকে বিশেষভাবে এমপিও দিতে অনুরোধ করেছি।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিশেষ বিবেচনায় এমপিও পেতে বেশি ডিও লেটার দিয়েছেন রংপুর বিভাগের এমপিরা। এরপর সিলেট, চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগ। কম পড়েছে ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগে। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে ২৬ হাজার ১৮০টি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত আছে। এর মধ্যে স্কুল ১৬ হাজার ১৯৭টি, কলেজ দুই হাজার ৩৬৫টি, মাদ্রাসা সাত হাজার ৬১৮টি। এ খাতে সরকারের ব্যয় বরাদ্দ আছে বছরে ১৪ হাজার ১৮২ কোটি টাকা। এ ব্যয় বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাজেটের ৬৩ শতাংশের বেশি। আবেদনকৃত প্রতিষ্ঠানকে এমপিও দিলে বছরে অন্তত আরও তিন হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। আগামী অর্থ বছরের বাজেটে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি ও সরকারিকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা ব্যয় মেটাতে অতিরিক্ত চার হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা বরাদ্দ চায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
সম্প্রতি এ বিষয়ে অর্থসচিবকে একটি আধা সরকারি পত্র দিয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব। তার আগে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বেসরকারি মাধ্যমিক) জাবেদ আহমেদের নেতৃত্বে গঠন করা হয় নয় সদস্যের ‘প্রতিষ্ঠান বাছাই কমিটি’। কমিটির অপর সদস্যরা হলেন বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) মহাপরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব (বেসরকারি মাধ্যমিক), যুগ্ম সচিব (আইন), মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (মাধ্যমিক), পরিচালক (কলেজ), মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপসচিব (কলেজ), জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব (বাজেট)। কমিটির সদস্যসচিব করা হয় যুগ্ম সচিব (বেসরকারি মাধ্যমিক-৩)।
অন্যদিকে অনলাইনে আবেদন গ্রহণের জন্য ব্যানবেইসের মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লাহর নেতৃত্বে গঠন করা হয় আট সদস্যের কারিগরি কমিটি। এই কমিটিতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ সিস্টেম অ্যানালিস্ট, প্রোগ্রামারসহ বিশেষজ্ঞদের কমিটির সদস্য করা হয়। গত বছরের ৫ থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আবেদন নেয়া হয়। এই কমিটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রস্তুত করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরে গ্রেডেশন তালিকা 'প্রতিষ্ঠান বাছাই কমিটির' কাছে উপস্থাপন করেছে।-যায়যায়দিন