১৭ জুন ২০১৯, ০০:৫৬

এমপিও ধোঁয়াশা এখনও, নেতারা বলছেন— বরাদ্দ গত বাজেটেও ছিল

দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে প্রায় এক দশক পর এমপিওভুক্তির দুয়ার খুললেও এ জন্য বাজেটে কত টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে তা প্রকাশ না করায় নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মধ্যে দেখা দিয়েছে হতাশা। তবে শুক্রবার বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী এমপিওভুক্তির জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখার ঘোষণা দেয়ায় নতুন করে আশায় বুক বাঁধছেন শিক্ষকরা। যদিও এ নিয়ে ধোঁয়াশা এখনো কাটেনি।

এদিকে কিছুদিন আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের মাধ্যমিক শাখার অতিরিক্ত সচিব জাবেদ আহমেদের সভাপতিত্বে যাচাই-বাছাই কমিটির একটি বৈঠক হয়েছে ব্যানবেইসে। এ বৈঠকে প্রতিষ্ঠানের তালিকা নিয়ে কথা হয়েছে বলে জানা গেছে। কমিটির কোন সদস্যই এ ব্যাপারে মুখ খুলতে চাননি।

গত বৃহস্পতিবার বাজেট পেশের সময় এমপিওভুক্তির জন্য অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে জানানো হলেও টাকার পরিমাণ প্রকাশ করা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে নানা ধরনের কানকথা ছড়িয়ে পড়ে। গতবারের বাজেটে বরাদ্দের কথা বলা হলেও কার্যত তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। এমনকি বাস্তবায়নের কোনো সদিচ্ছাও দেখা যায়নি। ফলে এবারও এমপিও হবে না। এ ধরনের আলোচনায় সরগরম হয়ে ওঠেন শিক্ষকরা। ফলে তারা আবারও আন্দোলনের কথাও চিন্তা করতে শুরু করেন। তবে শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, এমপিওর জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা হয়েছে। খুব শিগগিরই এটি কার্যকর করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণার পর শিক্ষক নেতারা বলছেন, সংসদে বাজেট পেশের সময় বলার পরও প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনেও বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন। এতে করে তারা মনে করছেন, খুব শিগগিরই সরকার সব প্রতিষ্ঠানকে এমপিওর ঘোষণা দেবে।

‘এবারের বাজেট পেশের সময় খোদ প্রধানমন্ত্রীই এমপিওভুক্তির সুখবরটি জানিয়েছেন। কিন্তু সেটি ছিল অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য, যা প্রধানমন্ত্রী শুধু পাঠ করেই শুনিয়েছিলেন।’

এ বিষয়ে নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারী ফোরামের সভাপতি অধ্যক্ষ গোলাম মাহমুদুন্নবী ডলার বলেন, গতবারের বাজেটে ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও কোনো প্রতিষ্ঠানকে এমপিও করা হয়নি। এবার ১২শ' কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে জানতে পেরেছেন। এবারের বাজেট পেশের সময় খোদ প্রধানমন্ত্রীই এমপিওভুক্তির সুখবরটি জানিয়েছেন। কিন্তু সেটি ছিল অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য, যা প্রধানমন্ত্রী শুধু পাঠ করেই শুনিয়েছিলেন। কিন্তু কত টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে তা এখনো অপ্রকাশিতই রয়েছে। এ কারণে কিছুটা উদ্বেগ ছিল।

কিন্তু শুক্রবার যেহেতু আবারও প্রধানমন্ত্রী নিজের থেকে জানিয়েছেন যে এমপিওভুক্তির জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা হয়েছে, সেহেতু তারা আশা করছেন এবার আর মিস হবে না। তবে তারা এরই মধ্যে জানতে পেরেছেন সরকার মাত্র ২৭শ' এর মতো প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচিত করেছে। বর্তমান নীতিমালার আওতায় এটি করা হয়েছে। কিন্তু তারা বারবার বলে এসেছেন এ নীতিমালা ২০১৮ সালে করা। কিন্তু অধিকাংশ নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তার অনেক আগেই প্রতিষ্ঠিত। ফলে নতুন নয় বরং পূর্বের নীতিমালার আওতায় এমপিওর যোগ্যতা নির্ধারণ করতে হবে এবং ওই নীতিমালার আওতায় যদি কেউ বাদ যায় তবে তাদের কোনো আপত্তি থাকবে না। তারা আস্থা রাখেন খোদ প্রধানমন্ত্রী যেহেতু এ বিষয়ে দায়িত্ব নিয়েছেন সেহেতু কোনো যোগ্য প্রতিষ্ঠানই বঞ্চিত হবে না।

দেশের শিক্ষাবিদরাও এমপিওর জন্য প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন। শিক্ষাবিদ সৈয়দ আনোয়ার হোসেন এ বিষয়ে বলেন, দীর্ঘ প্রায় এক দশক ধরে এমপিও হয় না। বিভিন্ন সময়ে এটিকে এক ধরনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। দলীয় সুপারিশ না দেখে যোগ্য প্রতিষ্ঠানকে সঠিক নীতিমালার আওতায় এমপিও করার কোনো বিকল্প নেই। বছরের পর বছর এটি বন্ধ রাখা উচিত হয়নি। এখন প্রধানমন্ত্রী যেহেতু বিষয়টিতে কথা বলছেন সেহেতু এটি ইতিবাচক।

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-কারিগরি) কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনের একটি অংশ সরকারিভাবে প্রদান করা হয়। এটিকে এমপিও (মানথলি পে-অর্ডার) বলা হয়। সর্বশেষ ২০১০ সালে ১ হাজার ৬২৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়েছিল। এর পর থেকে নানা অজুহাতে এমপিওভুক্তি কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়। বাজেটেও এর জন্য বরাদ্দ রাখা হয়নি। আবার গত বছরে সামান্য কিছু রাখলেও তা কার্যকর করা হয়নি। এমপিওভুক্তির জন্য প্রতি বছরই বাজেটের আগে-পরে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক সংগঠনগুলো আন্দোলন করে আসছিল। তবে ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এমপিওভুক্তির জন্য আন্দোলন ছিল সবচেয়ে আলোচিত ও জোরালো। এতে শত শত শিক্ষক রাজধানীতে প্রবল বর্ষণ ও রোদ উপেক্ষা করে লাগাতার অনশন কর্মসূচি পালন করেছিল। এ নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও আন্দোলনকারী শিক্ষকদের নানা নাটকের পর গত বছরের জুলাইয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এমপিও জন্য জনবলকাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০১৮ তে নতুন শর্তারোপ করে জারি করে। এরপর গত আগস্টে এমপিওভুক্তির জন্য আবেদন চাওয়া হয়। তাতে মোট ৯ হাজার ৬১৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আবেদন করে। নির্বাচনের আগে এমপিওভুক্তির বিষয়টি আবার ঝুলে যায় যাচাই-বাছাইয়ের নামে। পরে যোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২ হাজার ৭৬২টি প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করা হয়েছে।

বাজেট বক্তৃতার শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও মানবসম্পদ উন্নয়ন সংক্রান্ত অংশে প্রধানমন্ত্রী লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য একটি সুসংবাদ দিয়ে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর আমি প্রথমে আলোকপাত করতে চাই। দীর্ঘদিন আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে নানাবিধ জটিলতার কারণে এমপিওভুক্তি কার্যক্রমটি বন্ধ ছিল। এবারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা এমপিওভুক্তি কার্যক্রমের জন্য এ বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান রাখা হয়েছে।’

সূত্র জানায়, বাজেট সংসদে পাসের আগেই নতুন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির ঘোষণা আসতে পারে। নতুন অর্থবছরের প্রথমদিন থেকেই এমপিও কার্যকর হবে। প্রায় এক দশক ধরে আন্দোলন করা শিক্ষকরাও এটির জন্য অপেক্ষা করছেন। তবে শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরই এমপিও চান। নতুন নীতিমালাকে অতি কঠোর দাবি করে পূর্বের নীতিমালার আওতায় তারা এমপিও চান। সেটি না হলে প্রয়োজনে এমপিও ঘোষণার পরপরই আবারও তারা আন্দোলনে নামতে পারেন বলেও আভাস দিয়েছেন।