চাকরি খুঁজতেই তিন বছর পার ৪৬ শতাংশ গ্রাজুয়েটের
দেশের শ্রমশক্তিতে প্রতি বছর ২০ লাখের মতো নতুন মুখ যুক্ত হচ্ছে। এতে বাড়ছে উচ্চ শিক্ষিতদের অংশগ্রহণ। যদিও তাদের একটি বড় অংশই বেকার থাকছে। এর মধ্যেও বেশি পিছিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ থেকে বের হওয়া শিক্ষার্থীরা। পড়াশুনা শেষ করে চাকরি খুঁজতেই তিন বছর চলে যাচ্ছে ৪৬ শতাংশ কলেজ পড়ুয়াদের। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজের ওপর জরিপ চালিয়ে এ তথ্য দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। সেখানে কর্মবাজারের প্রস্তুতি ও কলেজ পড়ুয়াদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিশ্বব্যাংক। পাশাপাশি এ চিত্রকে তারা উদ্বেগজনকও বলছে।
দেশে দুই ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ মিলছে—বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি-বেসরকারি কলেজ। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যমতে, এর অধিভুক্ত কলেজের সংখ্যা ২ হাজার ৩০০। প্রতি বছর কলেজের সংখ্যা বাড়ছে।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) হিসাবমতে, সারা দেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বিভিন্ন কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৮ লাখের বেশি, যা মোট উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারীর ৬৮ শতাংশ। প্রতি বছর শুধু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছেন ৫০ হাজারের মতো।
পড়ালেখা শেষ করে মাত্র ১ শতাংশ কলেজ পড়ুয়ারা কর্মসংস্থানে যুক্ত হচ্ছেন বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, পড়াশুনা শেষ করার পর তিন বছর ধরে চাকরির সন্ধান করতে হচ্ছে ৪৬ শতাংশ কলেজ পড়ুয়াদের। তাদের মধ্যে বেকারত্বের হারও উচ্চ, যা ৭১ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিক্ষক সংকট, মানসম্মত শিক্ষার পরিবেশ ও বাজারমুখী কারিকুলামের অভাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজে উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য চাকরির বাজার প্রস্তুত না থাকার কারণেও চাকরি পেতে বেশি সময় লেগে যাচ্ছে তাদের।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে কারিকুলামে শিক্ষা দেয়া হয়, তা প্রাসঙ্গিক কিনা অর্থাৎ বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা, তা দেখা হয় না। চাকরির বাজার, ব্যবসা-বাণিজ্য বা উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রে এগুলো অবদান রাখতে পারবে কিনা, গুরুত্ব পায় না সে বিষয়টিও। ঘাটতি আছে মানসম্মত শিক্ষক, শ্রেণীকক্ষ, শিক্ষার সার্বিক পরিবেশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও। শিক্ষার্থীদের যা পড়ানো হচ্ছে, বাজারে তার চাহিদা নেই। আবার যা পড়ানো হচ্ছে, তা-ও ঠিকমতো গ্রহণ করতে পারছেন না শিক্ষার্থীরা। এটি শুধু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, পুরো উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থারই সমস্যা।
পছন্দ না হলে কাজ না করার মানসিকতাও বেকারত্বের একটি কারণ বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, সবাই অনেক বেশি প্রত্যাশা করে, যা বাস্তবসম্মত নয়। আর্থিক কোনো সুবিধা দিচ্ছে না এ প্রবণতা।
একাধিক কলেজ গ্র্যাজুয়েটের সঙ্গে কথা বলেও চাকরি খুঁজতেই তাদের তিন-চার বছর লেগে যাওয়ার তথ্য মিলেছে। এদেরই একজন নীলফামারীর রুদ্র তালুকদার। ২০১৪ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় অংশ নিলেও চাকরি হয়নি তার। চাকরি খুঁজতে খুঁজতে কেটে গেছে চার বছরের বেশি সময়। অবশেষে চলতি বছরের শুরুতে একটি বেসরকারি ওষুধ কোম্পানিতে প্রতিনিধির চাকরি পেয়েছেন তিনি।
পড়াশোনা শেষ করার পর তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো চাকরি জোটেনি ঢাকা কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী সাইদুর রহমানের। অর্থনীতি বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি না পেয়ে এখন টিউশনি করে চলতে হচ্ছে তাকে। পাশাপাশি চলছে চাকরি খোঁজার চেষ্টা।
সর্বশেষ কলেজ গ্র্যাজুয়েট ট্রেসার স্টাডির তথ্য উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংক বলছে, কলেজ গ্র্যাজুয়েট পুরুষদের ৬৬ শতাংশই বেকার থাকছে। নারীদের মধ্যে এ হার আরো বেশি, ৭৭ শতাংশ। শহর-গ্রামভেদেও এ হারে পার্থক্য আছে। মেট্রোপলিটন এলাকার কলেজ পড়ুয়া মধ্যে বেকারত্বের হার ৫৫ শতাংশ হলেও গ্রামাঞ্চলে তা ৭২ শতাংশ। এ হারে পার্থক্য আছে বিভাগভিত্তিক কলেজ পড়ুয়াদের মধ্যেও। মানবিক বিভাগের ৭৪ শতাংশ কলেজ পড়ুয়া বেকার থাকলেও সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের মধ্যে এ হার ৭১ শতাংশ। এছাড়া বিজ্ঞানের ৬৬ শতাংশ ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের ৬৯ শতাংশ কলেজ পড়ুয়া বেকার থাকছেন।
এসব কলেজ পড়ুয়াদের বড় অংশেরই দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। তাদের ওপর জরিপ চালিয়ে সংস্থাটি বলছে, এক-তৃতীয়াংশ চাকরিজীবী গ্র্যাজুয়েট মনে করেন, কলেজে শেখা জ্ঞান ও দক্ষতা তারা কাজে লাগাতে পারছেন। অধিকাংশ কলেজ পড়ুয়ারাই তাদের কলেজে শেখা জ্ঞান কাজে লাগাতে পারেন না। বর্তমান বিশ্বে তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও প্রতি ১০ জনের মধ্যে মাত্র একজন জানিয়েছেন, কলেজে শেখা আইসিটি জ্ঞান কর্মক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারছেন।
তবে শিক্ষার মান উন্নয়ন ও বাজারের চাহিদা অনুযায়ী গ্র্যাজুয়েট তৈরিতে কাজ করা হচ্ছে বলে জানান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন অর রশিদ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নয়নে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার্থীরা যাতে মানসম্মত পাঠ্যপুস্তক পায়, সে বিষয়ে কাজ করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের যৌথ অর্থায়নে সাড়ে ১৬ হাজার কলেজ শিক্ষকের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি দেশের ভেতরে ও বাইরে। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে ব্যাপক সংখ্যক শিক্ষার্থীকে আইটি শিক্ষা দেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। বাজারে যেসব বিষয়ের চাহিদা আছে, সে অনুযায়ী আমরা আমাদের কোর্স কারিকুলাম উন্নত করছি। পর্যটন শিল্পের বিকাশের কারণে নয়টি কলেজে ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট কোর্স চালু করা হয়েছে।