কোটা পদ্ধতি কি আগের মত ফিরবে? মানতে পারছেন না শিক্ষার্থীরা
প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল করার রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। এই দুই শ্রেণির নিয়োগে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালে যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল, সেটি অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছে উচ্চ আদালত। এক রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ বুধবার (৫ জুন) এ রায় দেন।
কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালের রায়ের খবরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) সাধারণ চাকরিপ্রত্যাশী ও ছাত্র-ছাত্রীরা বিক্ষোভ দেখিয়েছে। এসময় সরকারি চাকরিতে সব ধরনের কোটা বাতিলের দাবি জানান তারা। বিক্ষোভে শিক্ষার্থীরা বলেন, কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল থাকলে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সাধারণ মেধাবীদের চাকরি হয় না। এজন্য ২০১৮ সালে ৭ মাস আন্দোলনের মাধ্যমে যে কোটা পদ্ধতি রহিত করেছিল সেটি আদালতের মাধ্যমে ৫ বছরে বেশি সময় পর পুনর্বহাল হল আজ। এখন সরকার যদি এই রায় গ্রহণ করে নেয় তাহলে আমাদের ভিন্ন পদ বেছে নিতে হবে।
“মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালের পক্ষে কথা বলছেন তাদের কথায় কোন যৌক্তিকতা দেখি না। কারণ আমরা মুক্তিযুদ্ধের ৫২ বছর পার করেছি। যারা প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধে গিয়েছিলেন তারা অনেকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সত্য, কিন্তু তাদেরকে আর্থিক কিংবা অন্যান্য সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন সেটি কি অনন্তকাল চলমান থাকবে? প্রকৃতপক্ষে আমার মনে হয় সেই ক্ষতির বিপরীতে সুবিধা ভোগ করার কোন মানসিকতা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের ছিল না-অধ্যাপক ড. আবুল কাশেম ফজলুল হক, শিক্ষাবিদ
জানা যায়, ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশে সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা প্রচলিত ছিল। তবে, ওইবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যাপক কোটা সংস্কার আন্দোলন হয়। তার পরিপ্রেক্ষিতে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত চাকরির ক্ষেত্রে কোটা সুবিধা পুরোপুরি বাতিল করে দেয় সরকার।
আরও পড়ুন: সরকারি চাকরিতে বহাল থাকল ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা
তার আগে এসব পদে চালু থাকা কোটার ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং তাদের নাতি-নাতনিদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। এর বাইরে নারীদের জন্য ১০ শতাংশ, অনগ্রসর জেলার বাসিন্দাদের জন্য ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ আর প্রতিবন্ধীদের জন্য এক শতাংশ আসন থাকতো। কিন্তু, আজকের এই রায়ের ফলে শুধু মুক্তিযোদ্ধা কোটাই ফিরবে নাকি বাকি সব কোটাই বহাল হবে সেটি এখনো পরিষ্কার নয় বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
কোটা পদ্ধতি কি আগের মতো ফিরবে?
জানা যায়, ২০২১ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের অংশটিকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হাইকোর্টে রিট করেন। সে রিটের শুনানি নিয়ে ওই ৩০ শতাংশ কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়। সর্বশেষ আজ বুধবার সেই রুল যথাযথ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট।
অধ্যাপক ড. আবুল কাশেম ফজলুল হক
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ সাইফুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, আদালত তার বক্তব্যে বলেছেন আগের মতো কোটা বহাল হবে। “আদালতের জাজমেন্ট (পূর্ণাঙ্গ রায়) না পাওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যায় না। এক কথায় বলা যায়, আগের মত কোটা ফিরে আসবে”। তবে বাকি কোটাগুলোর ব্যাপারে 'প্রসিডিং'-এ কিছু উল্লেখ ছিল না বলেও জানান তিনি।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ সাইফুজ্জামান বলেন, এখানে শুধু মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য কোটার কথা বলা হয়েছে।
“শিক্ষার্থীরা প্রায় ৭ মাস সক্রিয় আন্দোলনের মাধ্যমে যে কোটা পদ্ধতি রহিত করেছিল সেটি আদালতের মাধ্যমে পুনর্বহাল করাটা আমি মনে করি ছাত্রসমাজের সাথে সরকারের সরাসরি প্রতারণা। কোটা বাতিলের জন্য সে সময়ে সরকার একটা কমিটি করে দিয়েছিল, যারা পর্যালোচনা করে কোটা বাতিল করেছিল-নুরুল হক নুর, ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা
নতুন করে সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ কোটা পুনর্বহালের যৌক্তিকতা নিয়ে জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আবুল কাসেম ফজলুল হক দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, প্রথমত আদালতের প্রতি আমি শ্রদ্ধা রাখি। কিন্তু এ সংক্রান্ত বিতর্ক নিয়ে যদি বলি, যারা মুক্তিযোদ্ধা কোটা রহিত করার পক্ষে তাদের কথায় আমি যৌক্তিকতা খুঁজে পাই। কিন্তু যারা পুনর্বহালের পক্ষে কথা বলছেন তাদের কথায় কোন যৌক্তিকতা দেখি না।
আরও পড়ুন: কোটা পুনর্বহাল রাখার যৌক্তিকতা দেখছি না: অধ্যাপক আবুল কাসেম
“কারণ আমরা মুক্তিযুদ্ধের ৫২ বছর পার করেছি। যারা প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধে গিয়েছিলেন তারা অনেকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সত্য, কিন্তু তাদেরকে আর্থিক কিংবা অন্যান্য সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন সেটি কি অনন্তকাল চলমান থাকবে? প্রকৃতপক্ষে আমার মনে হয় সেই ক্ষতির বিপরীতে সুবিধা ভোগ করার কোন মানসিকতা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের ছিল না। আবার এটিকে পুঁজি করে উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তি থেকে বিভিন্ন স্তরে মিথ্যা প্রমাণ জোগাড় করে সুবিধা ভোগের যে মানসিকতা আছে সেটির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিশ্চিত করা উচিত। প্রকৃতপক্ষে আমাদের উচিত অন্য যে-সকল দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে কিংবা সেটির ইতিহাস রয়েছে তাদের দিকে তাকিয়ে একটা নৈতিক অবস্থান সৃষ্টি করা।”
তিনি আরও বলেন, সামগ্রিকভাবে আমি মনে করি এটি আমাদের রাজনৈতিক নিম্নগামীতাকে সামনে নিয়ে আসে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বলি, মুক্তিযুদ্ধকে যারা রাজনীতিতে অস্বীকার করে তাদের প্রতিও জনগণের সমর্থন থাকা উচিত নয়।
২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা সংগঠন ছাত্র অধিকার পরিষদের সাবেক সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, শিক্ষার্থীরা প্রায় ৭ মাস সক্রিয় আন্দোলনের মাধ্যমে যে কোটা পদ্ধতি রহিত করেছিল সেটি আদালতের মাধ্যমে পুনর্বহাল করাটা আমি মনে করি ছাত্রসমাজের সাথে সরকারের সরাসরি প্রতারণা। কোটা বাতিলের জন্য সে সময়ে সরকার একটা কমিটি করে দিয়েছিল, যারা পর্যালোচনা করে কোটা বাতিল করেছিল।
তিনি বলেন, এখন আবার সরকার আদালতকে ব্যবহার করে তার রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে যাবে। কারণ আমরা সবাই জানি বর্তমানে সবকিছু সরকারের নিয়ন্ত্রণে। আন্দোলনের সাবেক সহকর্মীদের সাথে ইতোমধ্যে আমরা কথা বলেছি। বর্তমানে যারা ছাত্র রয়েছে ছাত্র অধিকার পরিষদ থেকেও নেতৃত্ব দেয়ার প্লাটফর্ম তৈরি করছে। তারা শক্তভাবে সে জায়গায় প্রতিবাদ করবে। আমরাও তাঁদের প্রয়োজন অনুযায়ী সহযোগিতা করব।
চাকরির বয়স ৩৫ প্রত্যাশী শিক্ষার্থী সমন্বয় পরিষদের আহ্বায়ক শরীফুল হাসান শুভ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ইতঃপূর্বে বর্তমান সরকার প্রধান কমিটি গঠনের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করেছিল। এখন নতুন করে আদালত থেকে যে রায়টি দেয়া হয়েছে আমি মনে করি সরকারে কোন একটি বডি কিংবা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রায়টিকে খারিজ করানোর জন্য কাজ করবেন। কিন্তু যদি সরকার এ রায় গ্রহণ করে নেয় তাহলে এটি হবে ছাত্রসমাজের সাথে প্রতারণার শামিল। আমরা অবস্থা পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য প্রস্তত রয়েছি।
আরও পড়ুন: কোটা পুনর্বহাল ছাত্রসমাজের সাথে সরাসরি প্রতারণা: নুর
বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জয়নাল আবেদীন বলেন, স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের সন্তানদের পরে নাতি-নাতনিরাও কোটা সুবিধা ভোগ করেছেন। প্রাইমারিতে নারী কোটার আধিক্য, রেলওয়েতে প্রায় ৮০ শতাংশ কোটা রয়েছে। নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনরায় চালু হলে সাধারণ মেধাবীরা হারিয়ে যাবে।
“আমরা তো কোন দোষ করিনি। শুধু যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরির সুযোগ চেয়েছি। কোটা পদ্ধতি পুনরায় চালু হলে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরা সরকারি চাকরিতে স্থান পাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। যেটি আমাদের জন্য কষ্টের, কারণ যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও চাকরির সুযোগ হারাতে হবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আমির হক বলেন, আমরা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানাই, যারা দেশের সূর্য সন্তান। কিন্তু তাই বলে তাদের সন্তান এমনকি নাতি-নাতনিরা পরিশ্রম কম করেই কোটায় চাকরিতে যোগ দেবে এটা মানি না। সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা কোনো দেশের স্বাভাবিক শিক্ষাব্যবস্থা হতে পারে না বলে তিনি মনে করে।