চাইলেই পদত্যাগ করতে পারবেন না এমডিরা, সরাতে পারবে না ব্যাংকও
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৩ PM , আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:১৮ PM
এখন থেকে কোনো ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) চাইলেই হঠাৎ করে পদত্যাগ করতে পারবেন না। আবার ব্যাংক কর্তৃপক্ষও যখন-তখন কোনো এমডিকে সড়াতে পারবেন না। পদত্যাগ কিংবা অব্যাহতি উভয় ক্ষেত্রেই লাগবে বাংলাদেশের অনুমতি।
মঙ্গলবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে এ সংক্রান্ত নীতিমালা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা এমডি পদে যোগ্যতার বিভিন্ন মানদণ্ড ঠিক করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, মেয়াদ শেষের আগে সেচ্ছায় বা অন্য কারণে কোনো এমডিকে ব্যাংক ছাড়তে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কমিটির কাছে ব্যাখ্যা দিতে হবে। সেই কমিটি যে সিদ্ধান্ত দেবে, তা–ই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কোনো এমডিকে অব্যাহতি দেওয়ার ক্ষেত্রেও একই ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে।
এছাড়া প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, এমডি পদে নিয়োগ বা পুনর্নিয়োগ পেতে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে একটি কমিটির সামনে মৌখিক পরীক্ষা দিতে হবে। তবে কেউ একবারে ৩ বছরের বেশি সময়ের জন্য নিয়োগ পাবেন না। যদিও ইতিমধ্যে বেশির ভাগ এমডিকে ৫ বছর বা আরও বেশি সময় পর্যন্ত নিয়োগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বয়স ও অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রেও নিয়ম বেঁধে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেবল ৪৫-৬৫ বছর বয়সীরাই এ পদের জন্য আবেদন করতে পারবেন। তবে তাদের ২০ বছরের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা থাকতে হবে যা আগে ছিল ১০ বছর।
আরও পড়ুন: শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, ১৫% ট্যাক্স দিতে হবে মেডিকেল-ডেন্টাল-ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজেরও
এছাড়া এমডিদের সুরক্ষা ও সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রেও নীতিমালা বেঁধে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে নিরাপত্তা বাড়ালেও নিয়োগ ও চাকরি ছাড়ার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ‘ব্যাংকিং খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একজন উপযুক্ত, পেশাগতভাবে দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ হওয়া আবশ্যক।’
নতুন সংযোজন চারিত্রিক ও নৈতিক বিশুদ্ধতা: পেশাগত যোগ্যতার পাশাপাশি পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিকে এমডি হিসেবে নিয়োগ দিতে ‘চারিত্রিক’ ও ‘নৈতিক বিশুদ্ধতা’কে শর্ত হিসেবে যোগ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফৌজদারি আদালত কর্তৃক দণ্ডিত, জাল-জালিয়াতি, আর্থিক অপরাধ বা অন্য কোনো অবৈধ কর্মকাণ্ডের জড়িত থাকলে তিনি অযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবেন। প্রার্থী সম্পর্কে কোনো দেওয়ানী বা ফৌজদারি মামলায় আদালতের রায়ে কোনো বিরূপ পর্যবেক্ষণ বা মন্তব্য থাকা যাবে না। কোনো নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের বিধিমালা, প্রবিধান বা নিয়মাচার লঙ্ঘনজনিত কারণে দণ্ডিত হলেও প্রার্থী অযোগ্য বিবেচিত হবেন। কখনো এমন কোনো কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় যুক্ত ছিলেন বা আছেন, তার নিবন্ধন অথবা লাইসেন্স বাতিল বা অবসায়িত হয়েছে এমন ব্যক্তি ব্যাংকের এমডি হতে পারবেন না। কোনো কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হিসেবে যুক্ত ছিলেন, যার নিবন্ধন অথবা লাইসেন্স তার সরাসরি বা পরোক্ষ অপরাধজনিত কারণে বাতিল করা হয়েছে। তাহলেও ওই ব্যক্তি এমডি হতে পারবেন না।
অর্থ আত্মসাৎ, দুর্নীতি, জাল-জালিয়াতি ও নৈতিক স্খলনজনিত কারণে কোনো কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান বা পরিচালক বা কর্মকর্তা বা কর্মচারী থাকাকালীন স্বীয় পদ হতে অপসারণ/বরখাস্ত/অবনমিত হয়েছেন এমন ব্যক্তিকেও এমডি হিসেবে নিয়োগ দিতে পারবে না ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের অফসাইট বা অনসাইট পরিদর্শনে কারো বিরুদ্ধে বিরূপ পর্যবেক্ষণ থাকলে তিনি এমডি হতে পারবেন না।
কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া ঋণে খেলাপি, পাওনাদারের প্রাপ্য পরিশোধ না করা এমনকি আপস রফার মাধ্যমে পাওনা আদায় হতে অব্যাহতি লাভ করা ব্যক্তিও এমডি পদে নিয়োগের জন্য অযোগ্য বিবেচিত হবেন।
শিক্ষাগত যোগ্যতা: এমডি হিসেবে নিয়োগ পেতে স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় হতে ন্যূনতম স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী হতে হবে। অর্থনীতি, হিসাববিজ্ঞান, ফাইন্যান্স, ব্যাংকিং, ব্যবস্থাপনা কিংবা ব্যবসায় প্রশাসন বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হবে। আর ডিজিটাল ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী নিয়োগের ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা অধিক গুরুত্ব পাবে এমডি নিয়োগে।
শিক্ষাজীবনের কোনো পর্যায়ে তৃতীয় বিভাগ বা শ্রেণি থাকতে পারবে না জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, গ্রেডিং পদ্ধতিতে এসএসসি বা সমমান ও এইচএসসি বা সমমান পরীক্ষার ক্ষেত্রে জিপিএ ৩ এর কম এবং অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত সিজিপিএ এর ক্ষেত্রে ৪ পয়েন্ট স্কেলে ২ দশমিক ৫০ এর কম এবং ৫ পয়েন্ট স্কেলে ৩ এর কম হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
বিদেশ থেকে ডিগ্রি অর্জনের ক্ষেত্রে প্রকাশিত ফলাফল (শ্রেণি/বিভাগ/জিপিএ) যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত ও সমতায়িত হতে হবে জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, প্রার্থীর নেতৃত্ব প্রদানের গুণাবলি থাকতে হবে।
অভিজ্ঞতা: এমডি পদে নিয়োগ হিসেবে কমপক্ষে ২০ বছরের অভিজ্ঞতাসহ ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার অব্যবহিত পূর্ববর্তী পদে কমপক্ষে দুই বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এই পদে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ন্যূনতম বয়স ৪৫ বছর হতে হবে এবং বয়স ৬৫ বছর অতিক্রান্ত হলে তিনি কোনো ব্যাংক-কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে অধিষ্ঠিত থাকতে পারবেন না।
দেশের ব্যাংকিং খাতে ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তার পদনাম সমরূপ/একরূপ করার কথা জানিয়ে সার্কুলারে বলা হয়, ব্যাংক-কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তার পদনাম ‘ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা’ হিসেবে অভিহিত হবে। তবে, বিদেশি ব্যাংক-কোম্পানির বাংলাদেশস্থ স্থানীয় শীর্ষ কর্মকর্তার পদনাম উক্ত ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী নির্ধারিত হতে পারবে। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার নিয়োগের মেয়াদ হবে সাধারণভাবে ৩ (তিন) বছর, তবে তিনি পুনর্নিয়োগের যোগ্য হবেন। যে মেয়াদের জন্যই প্রস্তাব করা হোক না কেন, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রার্থীর সাক্ষাৎকার নেওয়ার পর দেওয়া সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।
নিয়োগ বাতিলের নিয়ম: চরম স্খলন/বিচ্যুতিপূর্ণ কাজ না করে থাকলে কোনো প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার চুক্তির মেয়াদপূর্তির পূর্বে অপসারণ বা উক্ত চুক্তি বাতিল করা যাবে না বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সার্কুলার অনুসারে, মেয়াদের পূর্বে এমডির নিয়োগ বাতিল বা অপসারণ করতে চাইলে ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদে সিদ্ধান্ত নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রস্তাব আকারে পাঠাতে হবে।
চুক্তির মেয়াদপূর্তির পূর্বে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ব্যক্তিগত বা অন্য কোনো কারণে পদত্যাগ করার আবেদন করলে এরূপ আবেদন পরিচালনা পর্ষদের সুপারিশসহ বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রেরণ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত কমিটি পদত্যাগকারী এমডির ব্যক্তিগত শুনানি গ্রহণ করবে। তারপরে বিষয়টিতে বাংলাদেশ ব্যাংক যে সিদ্ধান্ত জানাবে তা চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা: প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার বেতন-ভাতা নির্ধারণে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা, কর্মকাণ্ডের ব্যাপকতা, ব্যবসার পরিমাণ, উপার্জন ক্ষমতা, শাখা, উপশাখা, এজেন্ট ব্যাংকিং ও আঞ্চলিক কার্যালয়ের সংখ্যা বিবেচনায় নিতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে সমজাতীয় ব্যাংকের এমডির বেতন ভাতা উদাহরণ হিসেবে নিতে নির্দেশনা দিয়ে বলা হয়, মূল বেতন ও বাড়ি ভাড়া বাবদ প্রত্যক্ষ বেতন ও ভাতা এবং অন্যান্য ভাতা যোগ করে মোট বেতন-ভাতা হিসাব করতে হবে। ইউটিলিটি বিল, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার নিজের চিকিৎসা খরচ, ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়ামের সুনির্দিষ্ট পরিমাণ/সীমা রাখতে বলেছে নতুন নির্দেশনায়। সকল সুবিধার (গাড়ি, জ্বালানি, চালক ইত্যাদি) অর্থমূল্যে বের করে বেতন-ভাতায় উল্লেখ করতে বলা হয়।
প্রতি বছরে সর্বোচ্চ দুইটি উৎসব ভাতা ঠিক করে দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, প্রতিটি এক মাসের মূল বেতনের অধিক হবে না। চাকরির মেয়াদকালে বেতন-ভাতাদির কোনো শর্ত পরিবর্তন করা যাবে না।
পরোক্ষ সুবিধা বাতিল: সব ধরনের পরোক্ষ সুবিধা বাতিল করে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ব্যাংকের মুনাফার বিপরীতে কোনো লভ্যাংশ, কমিশন, ক্লাবের জন্য কোনো চাঁদা বা খরচ, বিদেশে চিকিৎসা খরচ বা বাৎসরিক মেডিকেল চেক-আপ বাবদ খরচ, বিদেশে পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা খরচ, ব্যক্তিগত ভ্রমণের ক্ষেত্রে নিজের বা পরিবারের সদস্যদের বিদেশ ভ্রমণ ভাতা প্রাপ্য হবেন না। তবে, এমডি নিজের জন্য বিদেশে (এশিয়ার যেকোনো দেশে) চিকিৎসা গ্রহণের ক্ষেত্রে দেশের চিকিৎসা যথেষ্ট নয় মর্মে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের প্রত্যয়নের ভিত্তিতে তিনি বিদেশে চিকিৎসা সুবিধা গ্রহণ করতে পারবেন। এমডির বেতন-ভাতার বিপরীতে আয়কর ব্যক্তিকে নিজ উৎস থেকে দিতে হবে এখন থেকে।