ফটোগ্রাফি হতে পারে আধুনিক সময়ের স্মার্ট পেশা
একটি ছবি একজন দর্শকের মগজে একটা গল্প তৈরি করে দেয়। একটা সময়ের গল্প, একটা মুহূর্তের গল্প, কখনও একটা জীবনের গল্প। আর ক্যামেরার কৌশলে যারা এই সৃজনশীল শৈল্পিক কাজটি করে থাকেন তাদেরকে বলা হয় ফটোগ্রাফার। বর্তমান সময়ে ফটোগ্রাফির চাহিদা আকাশচুম্বী। ফটোগ্রাফি হতে পারে আধুনিক সময়ের স্মার্ট এবং যুগোপযোগী পেশা। আবার অনেকে শুধু শখের বসেই ফটোগ্রাফি করেন। পড়াশোনার পাশাপাশি ফটোগ্রাফি করেও সুনাম কুড়ানো এবং মাসে ভালো টাকা আয় করা যায়। এমনই একজন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদের স্নাতক শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী ফাহিম আল শামস।
মানুষ স্বভাবগতভাবেই চাই জীবনের বিশেষ বিশেষ মূহুর্তের স্মৃতিগুলো সারাজীবন সংরক্ষণ করতে। সেই আদিম যুগের মানুষ থেকে শুরু করে বর্তমান যুগের আধুনিক মানুষ সবার মধ্যেই এই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। আদিম মানুষ গাছ, লতাপাতা এবং পাহাড়ের গুহায় বিশেষ চিহ্ন বা ছবি একে বিভিন্ন স্মৃতি সংরক্ষণ করতো। কিন্তু বর্তমান সময়ে মানুষের বিশেষ মূহুর্ত আজীবন ধরে রাখার জন্য ফটোর কোনো তুলনা হয় না।
ফাহিমের ফটোগ্রাফির সম্পর্কে আগ্রহ জাগে কৈশোরেই যখন সে সবে মাত্র নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। কৈশোরে কোনো এক বিয়ে বাড়িতে ডিএসএলআর ক্যামেরার চমকপ্রদ, ঝকঝকে, জীবন্ত, হাই রেজুলেশনের ফটো দেখে কৌতূহলবশত ইচ্ছা জাগে ফটোগ্রাফার হওয়ার। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা আসে, পরীক্ষা দেন চান্স পান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। যখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তখন তার মা তাকে একটি ক্যামেরা কিনে দেন। সেই সময় তার ক্যামেরা বা ফটো সম্পর্কে খুব বেশি ধারণাও ছিল না।
প্রথম প্রথম ক্যামেরা পেয়ে তীব্র খুশি, ভালো লাগা আর আগ্রহ নিয়ে সকালে ঘুম থেকে উঠেই চলে যেত বিশ্ববিদ্যালয়ের আমবাগানে। ঘাস, লতা, পাতা, পোকামাকড়, ঘাস ফড়িং যা পেত তারই ছবি উঠাতো। তখন তার এটাও ধারণা ছিল না যে ক্যামেরা দিয়ে মানুষের ছবিও তোলা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন বরণে প্রথম ছবি তুলে শুরু হয় মানুষের ছবি তোলার হাতেখড়ি। সেই ছবিতেই বাজিমাত। বন্ধুরা সবাই ছবি দেখে হতভম্ব । সবাই বলে তোর যে ছবি তোলার হাত খুবই ভালো। ছবির ফ্রেমও খুব ভালো বুঝিস তুই। ফটোগ্রাফির মূলমন্ত্র এই ফ্রেমিং, যে যতো ফ্রেমিং বোঝে তার ফটো ততো ভালো হয়। ফটো তোলার পাশাপাশি সে ফটো এডিটিং টাও শিখতে থাকে নিজ উদ্যোগে।
এরপরের যাত্রাটা শুরু হয় এক বড় ভাইয়ের সাথে বিয়ে বাড়িতে ফটো তোলার মাধ্যমে। দিনাজপুরে কাজিনের বিয়েতে বর, কনের দারুণ সব ফটো তুলে বানিয়ে ফেলেন একটা ফটো অ্যালবাম তা দিয়ে খুলে ফেলেন ফেসবুক পেজ। পেজে আপলোড দেওয়ার পর প্রথম অ্যালবাম হিসেবে ভালোই সাড়া পাই তার তোলা ফটো। পরবর্তীতে ওয়েডিং ফটোগ্রাফি থেকে পোট্রেট ফটোগ্রাফির দিকে বেশি নজর দেন ফাহিম যাতে বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌছানো যায়। তার ফেসবুক পেজে যখন তিন নম্বর অ্যালবাম আপলোড করেন তখন একটা পেইড কাজের অফার পান তিনি। এটাই তার প্রথম ক্লায়েন্ট এবং কাজ। ঢাকা ধানমন্ডি লেকের সুন্দর সব দৃশ্যপটে এই প্রথম ক্লায়েন্টের ছবি তোলেন তিনি এবং অনুমতি নিয়ে এগুলো ফেসবুক পেজে আপলোড করেন। প্রথম কাজের জন্য পান ১ হাজার টাকা। এই কাজের সূত্র ধরেই পরবর্তীতে তিনি আরো অনেক গুলো প্রফেশনাল কাজ পান এবং ভালো পরিমাণ অর্থ উপার্জন করেন যা পড়াশোনার পাশাপাশি যথেষ্ট। এরপর তিনি চেষ্টা করেন সেলিব্রেটি বা ইনফ্লুয়েন্সারদের সাথে কাজ করতে। প্রথম প্রথম কাজ পেতে অনেক ইনফ্লুয়েন্সার নক করতেন কিন্তু তেমন একটা সাড়া পেতেন না। এরপর একজন ইনফ্লুয়েন্সার তার সাথে কাজ করতে সম্মতি হোন। এই ইনফ্লুয়েন্সারের সাথে কাজ করার পর ছবিগুলো যখন পেজে আপলোড করেন তখন তার কাজের মান দেখে ইনফ্লুয়েন্সারাই তাকে খুঁজে বের করে তার সাথে কাজ করতে চাইতো।
এরপর আসে করোনার হানা করোনার সময়টা নষ্ট না করে ইন্টারনেট ঘেটে বিভিন্ন উৎস থেকে প্রফেশনাল ফটো ইডিটিং শিখতে থাকেন এবং এই বিষয়ে দক্ষ হয়ে উঠেন। এরপরে বিপত্তি বাধে ক্যামেরা নিয়ে । তার কাছে যেই ক্যামেরাটি ছিল সেটি অত্যাধুনিক মানের না হওয়ায় তা দিয়ে বড় কোনো প্লাটফর্মে ফটো তোলা এবং প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। এই জন্য অত্যাধুনিক মানের ক্যামেরা দরকার। ক্যামেরা তো দরকার কিন্তুু টাকা কোথায়? একটা নতুন অত্যাধুনিক লেন্সের ক্যামেরা কিনতে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজারের মত টাকা দরকার। পুরাতন ক্যামেরা বিক্রি করে কিছু টাকা পেলেও তা যথেষ্ট ছিল না। এজন্য মায়ের কাছে টাকা চান কিন্তুু তার মা টাকা দিতে অসম্মতি প্রদান করেন। কিন্তু ফাহিম হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন। তিনি মাকে চ্যালেঞ্জ করেন যে লোন করে হলেও টাকা যেন টাকা দেন এবং এই লোন সে অবশ্যই ১ বছরের মধ্যে পরিশোধ করবে। তার মা তার কথা মত লোন করে একটা অত্যাধুনিক ক্যামেরা কিনে দেন। পরবর্তীতে পুরোদমে ইনফ্লুয়েন্সারদের সাথে কাজ শুরু করেন এবং ৭ মাসের মধ্যে লোন পরিশোধ করে দিতে সক্ষম হোন। এটাই তার জীবনের সবচেয়ে বড় সফলতা।
পরবর্তীতে ফাহিম চিন্তা করেন একটু ভিন্ন কিছু করা যায় কিনা এর থেকেই সে নিজের জীবনের সাথে হালকা মিল রেখে একটা গল্প লিখে ফেলেন। গল্পটা ছিল ত্রিভুজ প্রেমের গল্প। গল্পটাকে ফুটিয়ে তুলতে স্টেশন, নদীর পাড়, বাগান বিভিন্ন জায়গায় যেয়ে যেয়ে ফটো তোলেন। এভাবে ফটোর মাধ্যমে নিজের জীবনের গল্প তুলে ধরেন। যা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং ফেসবুকে প্রচুর ভিউজ আসে।
বর্তমানে ফাহিম বিপননের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পণ্যের ছবি তুলে দেন । এর সাথে প্রোট্রেট ফটোগ্রাফি করেন। পড়াশোনার পাশাপাশি এখান থেকে মাসে ৩০-৪০ হাজার টাকার মত উপার্জন করেন। ফটোগ্রাফির সাথে সাথে সিনেমাটোগ্রাফি করছেন এবং প্রফেশনাল ভিডিও এডিটিংও শিখছে।
ভবিষ্যতে পড়াশোনা শেষ করে তিনি দেশের বাইরে যেতে চান। বাইরের দেশের বিভিন্ন ফটোগ্রাফারের সাথে ইতোমধ্যেই তিনি যোগাযোগ করেছেন। উচ্চতর শিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যেয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি পার্ট টাইম জবের বদলে ফটোগ্রাফি করতে চান তিনি। ইউরোপ, অ্যামেরিকাতে পোট্রেট ফটোগ্রাফারের দারুণ চাহিদা।
ফাহিম বলেন, শিক্ষার্থীরা চাইলে অল্প পরিশ্রমে ফটোগ্রাফি করে ভালো টাকা আয় করতে পারেন এর জন্য শুধু ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট, খুব বেশি পরিশ্রমের দরকার নেই। সম্প্রতি ফাহিম অনলাইন প্লাটফর্ম চরকির একটা ওয়েবফিল্ম "শুক্লপক্ষ"তে স্ট্যান্ড আপ ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করেছেন। এ ওয়েবফিল্মে কাজ করেছেন সুনেরাহ কামাল, খায়রুল বাশার এর মতো প্রখ্যাত অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা এবং পরিচালনা করেছেন ভিকি জাহেদ।