ক্ষুদ্র ও কমিউনিটি ব্যবসায় ঝুঁকছেন ঢাবি শিক্ষার্থীরা
টিউশন আর জমানো টাকা দিয়ে চলতি বছরের শুরুর দিকে ফেসবুকে একটি পেজ খুলে অনলাইন বেচাকেনায় (ই-কমার্স) যুক্ত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী রাইসা মণি সুমি। তার মতে, টিউশনের চেয়ে স্বাধীন পেশা ফেসবুক কমিউনিটিভিত্তিক এই ব্যবসা। এ ধরণের ব্যবসায় ২ থেকে ৫ বছর শ্রম দিলে সেটাই একটা ক্যারিয়ার হয়ে যায়। ভাগ্য ভালো হলে ব্র্যান্ড ভ্যালু বৃদ্ধি পায়। লাখপতি থেকে কোটিপতিও হওয়া যায়। সমাজ পরিবর্তন করা যায়। কিন্তু টিউশন কিংবা খণ্ডকালীন চাকরি করে যেটা প্রায় অসম্ভব।
শুধু সুমি নয়, ২০২০ সালে দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী ক্ষুদ্র ও কমিউনিটি ব্যবসায় ঝুঁকছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব থাকা অবস্থায় উদ্যোক্তা হিসেবে পথচলা শুরু করেছেন। করোনার প্রাদুর্ভাব চলে যাওয়ার পরও তাদের এই উদ্যোক্তা হওয়ার পথচলা বন্ধ হয়নি।
এ শিক্ষার্থীদের কেউ বেচেন হাতে বানানো খাবার, কেউবা পোশাক-জার্সি। কেউ বিক্রি করেন গয়না, কেউ বিক্রি করেন মধু, আম, লিচু, খাদি কাপড়, নকশি কাঁথার মতো প্রসিদ্ধ আঞ্চলিক পণ্য। অনেকে জড়িয়েছেন ভারতীয়, পাকিস্তানি এবং থাই কাপড় বেচাকেনায়। এদের কেউ কেউ তাদের বেচাকেনা সীমাবদ্ধ রেখেছেন অনলাইনেই। অনেকে অনলাইনের পাশাপাশি সরাসরিও বিক্রি করছেন তাদের পণ্য।
সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ টিউশন এবং খণ্ডকালীন চাকরি থেকে আয় করে থাকেন। ফ্রিল্যান্সিং এবং শেয়ার বাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগের প্রবণতাও রয়েছে। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে এই ক্ষুদ্র ও কমিউনিটি ব্যবসার প্রবণতা বেড়েছে।
বর্তমানে কত সংখ্যক এই ব্যবসায় জড়িত তার কোন নির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে গড়ে ওঠা ঢাবিয়ান বিজনেস কমিউনিটি (ডিবিসি) ও ঢাবি স্টুডেন্টস্ বিজনেস প্ল্যাটফর্ম নামের দুটি ফেসবুক গ্রুপ রয়েছে। সেখানে একটির সদস্যের সংখ্যা প্রায় ৩৬ হাজার, অন্যটির প্রায় ১৬ হাজার। মূলত যেসব শিক্ষার্থীরা ব্যবসায় জড়িত রয়েছেন তারা এই গ্রুপগুলোর সদস্য। তবে ব্যবসায় জড়িত নেই এমন সাবেক ও বর্তমান কিছু শিক্ষার্থীও এই দুটি গ্রুপে রয়েছেন। গ্রুপগুলো বাইরে থেকেও অনেকে ক্যাম্পাসে ও ক্যাম্পাসের বাইরে ব্যবসা করছেন।
তথ্য মতে, বর্তমানে কয়েকশ শিক্ষার্থী উদ্যোক্তা হিসেবে ক্ষুদ্র ও কমিউনিটি ব্যবসায় জড়িত রয়েছেন। ঢাবিয়ান বিজনেস কমিউনিটির (ডিবিসি) এডমিন ও ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম কালিভার্ডের অন্যতম উদ্যোক্তা ইমতিয়াজ উদ্দিন বলেন, করোনার সময় ঢাবি পড়ুয়া প্রায় ২০০ শিক্ষার্থী অনলাইন বিজনেসের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বর্তমানে এটি সঠিক তথ্যটি নেই। তবে আগের চেয়েও বর্তমানে এটি অনেক বেড়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা শিক্ষার্থীদের পণ্য বিক্রি করছে ‘ডিইউ মার্ট’। এ উদ্যোগের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উদ্যোক্তাদের পাঠানো নিরাপদ খাদ্য পৌঁছে যাচ্ছে সারা দেশে। এ কার্যক্রমের উদ্যোক্তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের দুই বন্ধু খন্দকার ফয়সাল আজম বাপ্পি ও আশিকুর রহমান সজল।
এ উদ্যোগের শুরু প্রসঙ্গে বাপ্পি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী টিউশন করে। করোনাকালে টিউশন বন্ধ থাকায় বিকল্প আয়ের উৎস হিসেবে অনেকেই নানা উদ্যোগ শুরু করেছেন। এদের সমন্বয় করতে ২০২০ সালের নভেম্বরের দিকে ডিইউ মার্টের পরিকল্পনা শুরু করি। প্রথমে অনলাইন কার্যক্রম শুরু করলেও ২০২১ সালের মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকটস্থ পলাশী মার্কেটে আউটলেটের কার্যক্রম শুরু করি।
জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগের ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী মো. রাহাত সিকদারও কমিউনিটি ব্যবসায় যুক্ত। করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে তিনি শূন্যহাতে ব্যবসা শুরু করেন। অন্যান্যদের ন্যায় তিনিও এখানে যুক্ত হয়ে কিছু প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করেন। হতাশও হয়েছেন তবে কখনও আশা ছাড়েননি তিনি।
খণ্ডকালীন চাকরি বা টিউশনের চেয়ে অনলাইন ব্যবসা ভাল কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন অবশ্যই। এটি টিউশন থেকে ভালো।এখানে স্বাধীনতা আছে। নিজেকে প্রমাণ করার জন্য, কমিউনিকেশন স্কিল ডেভেলপ করার জন্য বিজনেসের থেকে ভালো কিছু হতে পারে না। এককথায় এখানে গ্রুমিংটা হয়। এটা আমাকে ভবিষ্যতে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করবে।
মূল পেশা হিসেবেও ই-কমার্সে ঝুঁকেছেন অনেকেই। তাদের একটা অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ-তরুণী, যারা নতুন উদ্যোক্তা হিসেবে যাত্রা করছে। এছাড়াও প্রতিষ্ঠিত অনেক উদ্যোক্তাও তাদের ব্যবসা প্রসারের জন্য ই-কমার্সে ঝুঁকেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রী অবসরে তাদের হাতে বানানো খাবার-পোশাক বিক্রি করে জানান দিচ্ছেন নিজেদের প্রতিভার। সাধারণত অনলাইন ব্যাংকিং, বিকাশ, নগদ অ্যাপস্ ব্যবহার করে এই ব্যবসায় পণ্যের দাম পরিশোধ হয়। অনেকে আবার হাতে হাতেও করে থাকেন লেনদেন।
হালাল ও ন্যাচরাল পণ্য নিয়ে কাজ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ সেশনের ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী রাইসা মণি সুমি। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ২/৩ মাস প্ল্যানের পরে শুরু করেন ব্যবসা, পেজের নাম ন্যাচার এন্ড কেয়ার। মূলত এক ডায়েট গ্রুপে থেকে প্রাকৃতিক পণ্যের গুণাগুণ আর ক্যামিকেল প্রোডাক্ট বা বাজারজাত পণ্যের ভয়ানক দিকগুলো জানার পর থেকেই ইচ্ছা হয় এই সেক্টরে হালাল ও ন্যাচরাল কিছু নিয়ে কাজ করার।
তিনি বলেন, প্রথমে আমদানি করা ন্যাচরাল স্কিন-হেয়ার কেয়ার ও হেলথ কেয়ারের প্রোডাক্টস দিয়ে শুরু করলেও আরও বেশি খাটি কিছু চাচ্ছিলাম। প্রাথমিকভাবে ২০ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করি, আমার স্বামীর জমানো টাকা আর টিউশনের টাকা। তারপর আরও অনেক বার ইনভেস্ট করা হয়। এরপর আলহামদুলিল্লাহ আমি ড্রাই ফ্রুটস, মূলতানি মাটি, মেহেদী গুড়া ইত্যাদি পণ্য নিয়মিত ঢাবি ক্যাম্পাসে ডেলিভারিসহ পুরো দেশজুড়ে ক্যাশ অন ডেলিভারি সার্ভিসের মাধ্যমে আমাদের প্রোফিট আসতে শুরু করে। পরে আম্মুর হাতের মুরগির মাংসের আচারসহ বিভিন্ন আচার ও শুকনা খাবার ও মাশাল্লাহ পুরো পরিবারকে অনলাইন ব্যবসার সাথে যুক্ত করে দেয়।
অনলাইন বিজনেসে কোন প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খাবার আইটেমে কাজ করা ও ডেলিভারি দেয়া তুলনামুলক ঝুকিপূর্ণ। পচনশীল দ্রব্য নিয়ে ঝুকি থাকে সবসময়। এরপর ফুড আইটেমগুলোর দাম দ্রুত গতিতে বাড়ে, তাই অনেক পণ্যই বাদ দেয়া হয়। তারপরও আলহামদুলিল্লাহ কিছু পণ্যের এত চাহিদা যে আমাদের আর কষ্ট লাগে না মানিয়ে নিতে।
খণ্ডকালীন চাকরি বা টিউশনের চেয়ে অনলাইন ব্যবসা ভালো কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি নিজেও প্রফেশনাল টিচার, টিউশন অনেক বছর থেকে করি। কিন্তু ব্যবসাটা অবশ্যই টিউশন থেকে উপকারী বলে মনে করি। কারণ ব্যবসায় ২-৫ বছর শ্রম দিলে সেটাই একটা ক্যারিয়ার হয়ে যায়, ভাগ্য ভালো হলে ব্রান্ড ভ্যালু বৃদ্ধি পায়। লাখপতি থেকে কোটিপতি ও হওয়া যায়। সমাজ পরিবর্তন করা যায়।
“টিউশন অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপার্জনের মাধ্যমে হলেও এর অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। বিশেষ করে নিজের ব্যবসায় নিজের যে স্বাধীনতা থাকে, আত্মপরিচয়ের আনন্দ থাকে সেটা আর কোথাও নেই।”
অনলাইন বিজনেসে যুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলাম শিক্ষা বিভাগের ২০১৮-২০১৯ শিক্ষা বর্ষের ছাত্রী ফারজানা জান্নাতও। গত বছরের নভেম্বর থেকে প্রথমে মাত্র ৭০০ টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। টিউশন বা খণ্ডকালীন চাকরির চেয়ে অনলাইন বিজনেস ভাল কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, টিউশনের চেয়ে এটা ভালো। জবের এক্সপেরিয়েন্স নেই।
২০১৫-২০১৬ সেশনের পালি এন্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী শাহাদাত হোসেন হৃদয়। তিনিও যুক্ত আছেন অনলাইন বিজনেসের সাথে। তিনি বলেন, গত সেপ্টেম্বর থেকে ১৬ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার বিনিয়োগ ও লাভ দুটোই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তিনি জানান, প্রচারের উপর পণ্য বিক্রি বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিস্তারিত বিষয় জানার প্রয়োজন রয়েছে। তাছাড়া প্রোডাক্ট এর কোয়ালিটি ধরে রাখলে ধীরে ধীরে সেল বৃদ্ধি পায়। তবে এ ক্ষেত্রে ধৈর্য রাখাটা জরুীর। এখানে মার্কেটিং ভালো করতে পারলে পার্ট টাইম জব বা টিউশনের থেকে ভালো কিছু করা সম্ভব।
অনলাইন বিজনেস নিয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী তাসফিয়া শারমিন সেতুর সাথে। তিনি ২০১৪-২০১৫ সেশনের নৃত্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী। তার যাত্রাটা শুরু বেশি দিন না হলেও তিনি সফলতা পেয়েছেন এমনটাই জানান সেতু। তার ব্যবসার শুরুটা ছিল এ বছরের মার্চ মাসে। শুরুতে তিনি ২০ হাজার টাকা ইনভেস্ট করেন।
ব্যবসায় কি কি সমস্যার সম্মুখীন হন, জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, যেহেতু আমার বিজনেসটি সম্পূর্ণ অনলাইনভিত্তিক সেহেতু কিছু কাস্টমার আছেন যারা প্রডাক্ট অর্ডার করে ডেলিভারির সময় আর যোগাযোগ করেন না। এটাই আসলে ১ম এবং প্রাধান সমস্যার বিষয়।
অন্যান্য কাজের চেয়ে ভালো কিনা, জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, অনেকে অনেকভাবে দেখে শুরু করে। সেক্ষেত্রে আমার ফ্যাশন ছিলো অনেক আগে থেকে যে বিজনেস করার। আর বিজনেস নিয়ে আমার চিন্তাধারাও সুদূরপ্রসারী, এজন্য আমার কাছে এই পেশাটা অন্য পেশার চেছে ভালো লাগছে অবশ্যই।
তিনি আরও বলেন, অনলাইন বিজনেসের ক্ষেত্রে হুট করেই ভালো অবস্থানে যাওয়া সম্ভব নয়। তা আমরা অনেকেই জানি। সেক্ষেত্রে আমার উদ্যোক্তা হওয়াটা খুব বেশি দিনের নয়। তবুও বলব এই ক’দিনের বিজনেস অভিজ্ঞতায় আমি স্যাটিসফাইড। ভালোই চলছে আলহামদুলিল্লাহ।