দারিদ্র্য ও বেকারত্বহীন সমাজ বিনির্মাণের মূলমন্ত্র
পুঁজিবাদ। আক্ষরিক অর্থে এটি এমন একটি ব্যবস্থাকে বোঝায়, যা সম্পদ তৈরী এবং সম্পদের মজুদ বাড়াতে সহায়তা করে। আর বাস্তবিক অর্থেও বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতিতে তাই হচ্ছে। কিন্তু ড. মোহাম্মদ ইউনূস তার 'এ ওয়ার্ল্ড অব থ্রি জিরোস: দ্য সিউ ইকোনোমিজ অব জিরো পভারটি, জিরো আনএম্পোলয়মেন্ট এন্ড জিরো নিট কার্বন ইমিশন" বইয়ের মধ্যে পুঁজিবাদের মূল ধারণাকে নতুন করে চিন্তা করার পরামর্শ ও পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন। তার প্রস্তাবিত নতুন পুঁজি ব্যবস্থায় দারিদ্রতা, বেকারত্ব এবং জলবায়ু পরিবর্তন কি ভাবে কমিয়ে আনা যায় সে বিষয়ে চমৎকার ব্যাখ্যা ও ব্যবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন।
দারিদ্রতা দুরিকরণে সৃজনশীল সব সমাধানের জন্য পরিচিত নোবেল বিজয়ী ড. ইউনুস এই বইতে এডাম স্মিথের “মানুষ মূলত ব্যক্তিগত-সাফল্য ও স্বার্থান্বেষী প্রজাতি” এই মতবাদকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। পাশাপাশি এটি যে একরৈখিক মতবাদ তা উপলদ্ধি করার জন্য পাঠককে তিনি সমাজে বিভিন্ন ধরনের যে বিনিয়োগ হয় তা বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছেন। এক্ষেত্র তার যুক্তি হচ্ছে-স্বাভাবত মানুষ স্বার্থবাজ এবং স্বার্থহীন দুই ধরনেরই হয়ে থাকে। এই দুটোই অর্থনৈতিক কর্মকা-ে ব্যবহার করা যেতে পারে। নিজের অর্থনৈতিক অভিজ্ঞতার আলোকে নতুন একটি কাঠামো তুলে ধরেছেন, যেই কাঠামোতে মানব পুুঁজিকে সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে বিশ্বের এক ও অভিন্ন সমস্যা সমাধান সম্ভব।
এই প্রেক্ষাপটে ড. ইউনুস বলেন-“পুঁজিবাদের মূল সমস্যা হচ্ছে, বর্তমানে এটি একটি মাত্র লক্ষ্যকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তা হচ্ছে ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জনের স্বার্থগত প্রচেষ্টা। এর ফলে সব ব্যবসা এই স্বার্থ কেন্দ্রীক। যদিও সারা বিশ্বে এখনো লাখ লাখ মানুষ দারিদ্র দূরিকরণ, বেকারত্ব সমাধান এবং পরিবেশ সুরক্ষাসহ অন্যান্য লক্ষ্য অর্জন্য আগ্রহী। এসব সমস্য খুব দ্রুতই কমে আসবে যদি আমরা বিষয়গুলো মাথায় নিয়ে নতুন ব্যবসায়ীক পরিকল্পনা গ্রহণ করি। আর এক্ষেত্রে সামাজিক ব্যবসা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।”
এশিয়া আফ্রিকা সহ বিভিন্ন দেশের উদাহরণ টেনে ড. ইউনুস বলেছেন উন্নয়নশীল এবং উন্নত সব দেশেই এই ভাবে ব্যবসা চালুর মাধ্যমে বেকারত্ব ও দারিদ্রতার সমাধানের দৃষ্টান্ত রয়েছে। তিনি বলেন-
“দীর্ঘ সময়ের জন্য আমরা দারিদ্রতা, বেকারত্ব, এবং পরিবেশগত ক্ষতিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো সহ্য করে আসছি। আমরা মনে করি এগুলো মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কখনও কখনও দারিদ্রতা ও বেকারত্বকে অর্থনেতিক প্রবৃদ্ধির অপরিহার্য ব্যয় বলেও মনে করেছি আমরা।”
বইটিতে লেখক বেকারত্বের উপর বেশি জোর দিয়েছেন। তিনি পরামর্শ দিয়েছেন-আমরা কেন তরুণ প্রজন্মকে নিজেদের জন্য এবং অন্যদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরামর্শ দিচ্ছি না। যেই প্রজন্ম চাকরি জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে, কিন্তু অধিকাংশই ব্যর্থ হয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হয়। কিন্তু এই সম্ভাবনাময় প্রজন্মকে যদি ব্যবসায়ীক ধারণা ভিত্তিক প্রাতিষ্ঠানিক অর্থায়নের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পথটা বাতলে দেয়া যেত তবে সমাজের চিত্রটা কত সুন্দরই না হতো।
কিন্তু আমরা আমাদের সন্তানদের কাছে যেই বার্তা পাঠাই বা যে প্রত্যাশার চাপে তাদেরকে অন্ধকারে ঠেলে দেই, তা কি আদৌ যৌক্তিক। আমারদের সমাজে সন্তানদের অভিভাবকের প্রত্যাশা হচ্ছে-“চাকরি নাইতো, জীবনও নাই। এই বার্তাটি ঘর, স্কুল ও মিডিয়াসহ প্রত্যেক প্রান্ত থেকে খুবই জোরালো এবং পরিষ্কার ভাবে তরুণদের কাছে পাঠানো হয়। এতে যখন একটি শিশু প্রাপ্ত বয়স্ক হয়, তখন সে নিজেকে চাকরির বাজারে যে প্রতিযোগিতা তাতে উৎসর্গ করে। আর যদি সে এটা একবার হারায়, তখন নিজেকে দারিদ্রতার নিচুস্তরে একজন নাগরিক হিসেবে ভাবতে শুরু করে। কিন্তু কেউ তাদের বলে না তারা যে অন্যের মাধ্যমে নিযুক্ত হাওয়া বা নিয়োগ লাভের জন্য জন্ময়নি, প্রতিটি মানুষ জন্মগত ভাবে একজন উদ্যোক্তা।”
তাঁর মতে সামাজিক ব্যবসা হচ্ছে একটি অলাভজনক বা নন-ডেভিডিয়েন্ট কোম্পানী যা মানুষের সমস্যা সমাধানে নিবেদিত। এই ব্যবসায় বিনিয়োগকারীরা তাদের প্রাথমিক পুঁজিটাই ফেরত নিয়ে থাকে। তবে এর ফলে যে মুনাফা আসবে তা জমিয়ে না রেখে আরো অধিক মানুষকে সেবা দেয়ার জন্য বিনিয়োগ করা হয়। এই ধরনের অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের ভিন্নতা হচ্ছে, এতে ক্রমাগত মুলধন সংগ্রহ করতে হয় না, বরং পদ্ধতিগত ভাবে এটা উপার্জন সক্ষম এবং আত্মনির্ভরশীল।
দারিদ্রতা ও বেকরত্ব দূরিকরণ এবং বিদ্যমান বৈষম্যের চিত্র পাল্টাতে ড. ইউনুসের এই ফ্রেমওয়ার্ক খুবই প্রশংসনীয় এবং বাস্তবিক অর্থে যথার্থ। একটি উৎসাহ ব্যঞ্জক বই। যদিও অনেকাংশে কিছু বিষয় বারবার বর্ণনা করেছে। তবে তাঁর দৃঢ় রাজনৈতিক দৃষ্টি ভঙ্গি এবং পুঁজিবাদ বিরোধী অবস্থান কিছু পাঠকের কাছে হতে বিরুপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে।
সর্বপরি তিনি এশিয়া আফ্রিকা এবং এমনকি ইউরোপের সামাজিক ব্যবসায় সফল ব্যক্তিদের যে দৃষ্টান্তে দিয়েছেন তা পাঠকে নিঃসন্দেহে আকৃষ্ট করবে। এই বইটি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হলে, তারা অধিক উপকৃত হবে। কারণ তারা এমন একটি পর্যায়ে আছে যেখান থেকে তাদের মগজে প্রথাগত সমাজ ও অর্থনেতিক কাঠামো ঠুকানো হয়। যেটাতে তাদেরও কোন উপকার হয় না, না সমাজেরও না।