নন্দিত নরকে
শঙ্খনীল কারগার প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের প্রথম লিখিত উপন্যাস হলেও নন্দিত নরকে তার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস। ৬৩ পাতার এই উপন্যাসটি ১৯৭২ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি পড়ার শুরুতেই ভূমিকাটি পড়ে আমার মত যেকোন পাঠক কিছুটা আশ্চর্য হবেন আশা করি। বার বার নেড়েচেড়ে দেখবেন।
ভূমিকার লেখক অধ্যাপক ড. আহমদ শরীফ বলেছেন ” নন্দিন নরকে গল্পের নামটা দেখেই আকৃষ্ট হয়েছিলাম। কেননা ঐ নামের মধ্যেই যেন নতুন জীবন দৃষ্টিভঙ্গি, একটি অভিনব রুচি, চেতনার একটি নতুন আকাশ উঁকি দিচ্ছিল। লেখক তো বটেই তাঁর নামটিও আমার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত। তবুও পড়তে শুরু করলাম ঐ নামের মোহেই। পড়ে অভিভূত হলাম। গল্পে সবিস্ময়ে লক্ষ্য করেছি একজন সূক্ষদর্শী শিল্পীর, একজন কুশলী স্রষ্টার পাকা হাত। বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে এক সুনিপুণ শিল্পীর দক্ষ রুপকারের, এক প্রজ্ঞাবান দ্রষ্টার জন্মলগ্ন যেন অনুভব করলাম।”
ঠিকই বাংলা সাহিত্যে হুমায়ুন একজন প্রজ্ঞাবান দ্রষ্টার জায়গায় আসীন হয়েছেন। ঠিক যেন মানিকে মানিক চিনেছে। এক গ্রামীণ পরিবারের কাহিনীর ভিতরকার কাহিনী উঠে এসেছে উপন্যাসের পরতে পরতে। উপন্যাসের নায়িকা রাবেয়া কিছুটা মানসিক বিকারগ্রস্ত (স্পষ্ট উল্লেখ নাই, আমার কাছে মনে হল)। তাকে পাড়ার ছেলে পেলেরা ভাল কথা বললেও হাসে খারাপ কথা বললেও হাসে। ভাল মন্দের মধ্যে পার্থক্য যাচাই করতে পারে না রাবেয়া। অপ্রকৃতিস্থ রাবেয়া স্বাধীনভাবে পাড়াময় ঘুরে বেড়ায়। তবে রাবেয়া কী কারণে এমন বিকারগ্রস্ত, জন্মগত ভাবেই কি না। এ বিষয়ে লেখক কিছু জানায়নি বলে লেখক সম্পর্ক কিছুটা আশা ভঙ্গের শিকার হয়েছি।
বারেয়ার পরিবারে ছয় জন সদস্য। মা-বাবা, ছোট বোন রুনু, ছোট ভাই মন্টু আর রাবেয়ার বড় ভাই (নাম উল্লেখ নেই, তবে অধিকাংশ সময়ই দাদা, খোকা বলে তাকে ডেকেছে রাবেয়া)। আরও থাকত তার বাবার ছোট বেলার বন্ধু, পরে যাকে তাদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিল, তাদের মাস্টার কাকা শফিক। শফিক আনন্দমোহন কলেজে লেখাপড়া শেষে ঘটনাচক্র তার বন্ধু বারেয়ার বাবার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। এখানেই সে দিনযাপন করে এবং রাবেয়ার ভাই বোনদের পড়ায়। একদিন রাবেয়াকে হঠাত বাসায় পাওয়া যায় না। অনেক খোঁজাখুজির পর যখন তাকে তার মাস্টার কাকা স্কুল থেকে ফেরার পথে নিয়ে আসল। বাবা মা হাফ ছেড়ে বাঁচলো এই অবুজ মেয়েটিকে পেয়ে। কিছুদিন পর হঠাত চা খাওয়ার পর রাবেয়া যখন ওয়াক ওয়াক বমি করলো তখন পরিবারের সবাই বুঝতে পারলো কেউ রাবেয়ার সর্বনাশ করেছে। তার দাদা ভাই মাঝে মাঝে নীরবে খুব গোপনে জিজ্ঞাস করে, “বারেয়া তোকে কি কেউ চুমু খেয়েছিল”। রাবেয়া লজ্জিত হয়ে বলে ছিঃ এটা কি কেউ খায় দাদা। অবশ্য মা আরও খোলামেলা ভাবে মেয়ে রাবেয়াকে জিজ্ঞাস করে ” রাবেয়া বল কেউ তোর কাপড় খুলেছিল কি না?? তোর সাথে কেউ শুয়েছিল কি না??” অসুস্থ রাবেয়া কিছুই মনে করতে পারে না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
দিন অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে রাবেয়ার শারীরিক পরিবর্তন আসতে থাকে। পাশের বাড়ির হেড মাস্টারের বউ যখন বলে রাবেয়ার হাটা দেখে পোয়াতি পোয়াতি মনে হয়। তখন লজ্জায় মাথা হেট হওয়ার উপক্রম হয় পরিবারটির। কোনো একদিন ভোর বেলায় নিজের ঘরেই এবোরশন করানো হয় বারেয়াকে। প্রচন্ড রক্তকরণের ফলে শহর থেকে ভাল ডাক্তার আসার আগেই মৃত্যু হয় রাবেয়ার। যে রাবেয়া তার খালাতো বোন নিনার বাচ্চা কিংশুককে দেখে বলেছিল সেও তার বাচ্চার নাম রাখবে কিংশুক। আজ সেই অবিবাহিত রাবেয়া তার বাচ্চাকে বুকে নিয়ে চিরদিনের জন্য শুয়ে আছে ঘরের মেঝেতে। রাবেয়ার রক্তে ঘরের মেঝে লাল হয়ে উঠছে। এদিকে এ ঘটনা দেখে রাবেয়ার ছোট ভাই মন্টু (যে অনেক দিন নানার বাড়িতে বেড়াতে ছিল) তার হাতের বটি দিয়ে আঘাত করে পরপারে পাঠিয়ে দিলেন তার মাস্টার চাচাকে। পুলিশ এসে মন্টু ধরে নিয়ে গেল। কী বা কেন খুন করা হয়েছে ইত্যাদি অনেক বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও মন্টু কিছুই বলেনি। চূড়ান্ত বিচারে মন্টুর ফাঁসি হয়।
এখানে লেখক তার পুরো কাহিনী খোলাসা না করলেও পাঠকের মনে হবে রাবেয়ার মাস্টার কাকাই তার সর্বনাশ করেছিল। আমার মনে হয় এখানেই লেখক তার দক্ষ হাতের পরিচয় দিয়েছেন, কিছু কথা অনুক্ত রেখেও পাঠকে ঘটনা বুঝিতে দেওয়া। তবে উপন্যাসের শুরুতে চরিত্রগুলোর ভেতরে ডুব দেওয়া কিছুটা কষ্টকর টেকে। রাবেয়ার আচার আচরণ এমন কেন? সে আসলে কী চায়?? মন্টু, রুনু, রাবেয়ার মধ্যে আসলে সম্পর্কটা কী এজাতীয় প্রশ্ন পাঠকের মনে ঘুরপাক খেতে পারে। যেটা আমার হয়েছে। সবশেষে সবাইকে বইটি পড়ার আমন্ত্রণ রইলো।