দ্য ক্রাউড ।। জনতার মন
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ১০ জুন ২০১৮, ০৯:১৫ PM , আপডেট: ১০ জুন ২০১৮, ০৯:২০ PM
‘দ্য ক্রাউড : অ্যা স্টাডি অব দ্য পপুলার মাইন্ড’ বইটি লিখেছেন ফরাসি নৃবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানী গুস্তাভ লা বো। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৯৫ সালে। বইটির বয়স প্রায় ১২৩ বছর। আমরা শাসকশ্রেণির মন নিয়ে হয়তো অনেক বই পড়েছি। কিন্তু শাসক শ্রেণি যাদের নিয়ে ব্যবসা করে সেই জনগণের মন নিয়ে কি ভেবেছি কখনো? জনগণের সামগ্রিক মন বলে কি কিছু আছে আদৌ? বইটি আজ ক্ল্যাসিক হিসাবে স্বীকৃত। বইটির গুরুত্ব এখানেই যে পুরো বইটিতে গুস্তাভ জনগণের মন নিয়ে কাজ করেছেন। তার এই ধরনের কয়েকটি বই আছে। বইটির গুরুত্ব তার বিষয়বস্তুতেই। জনগণ বলতে আমরা সাধারণত অচেতনভাবে একটা দেশের জনসাধারণ বা জগতের জনসাধারণকেই বুঝি কিন্তু গুস্তাভের জনগণ তারা নন। বইটিতে গুস্তাভ বলেন, মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে জনতা বলতে সম্পূর্ণ আলাদা একটা সত্তাকে বুঝায়। হঠাৎ করে বেশ কিছু লোক এক জায়গায় হলেই তাকে জনতা বলা যায় না। কোনো সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যবিহীন অজস্র লোক একত্র হলেই মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে তাকে জনতা বলা যায় না। কোনো জমায়েতকে সত্যিকারের জনতায় রূপান্তরিত হতে হলে তাকে বিশেষ কতগুলি প্রাক-কার্য সম্পন্ন করতে হবে। কোনো জমায়েত জনতায় পরিণত হবে তখনই জমায়েতের প্রতিটি ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তা নিমজ্জিত হবে এবং সেখানে জমায়েতের মন-মানসিকতা পৃথকখাতে প্রবাহিত হবে।
বইটি তিনটি পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্বে চারটি অধ্যায়, দ্বিতীয় পর্বে চারটি অধ্যায় ও তৃতীয় পর্বে পাঁচটি অধ্যায়। প্রথম পর্বে তিনি জনতার সাধারণ বৈশিষ্ট্য, জনতার আবেগপ্রবণতা ও নৈতিকতা বোধ, জনতার চিন্তাভাবনা বিচারবুদ্ধি ও কল্পনা শক্তি, জনতার বিশ্বাস ধর্মীয় বিশ্বাসের দৃঢ়মূল শক্তি ইত্যাদি নিয়ে লিখেছেন।
দ্বিতীয় পর্বে লিখেছেন জনতার বিশ্বাস নির্মাণের প্রস্তুতি-পর্ব, জনতার মতামতের পেছনে তাৎক্ষণিক কারণাদি, জনতার নেতারা কীভাবে জনতার ওপরে প্রভাব বিস্তার করে, জনতার বিশ্বাস ও মতামতের ব্যতিক্রমের সীমানা।
তৃতীয় পর্বে লিখেছেন জনতার শ্রেণিভেদ, যাকে অপরাধী জনতা বলে ধরা যেতে পারে, ন্যায়নীতি বর্জিত জনতা, নির্বাচনী জনতা, আইন পরিষদ নামে পাঁচটি অধ্যায়।
প্রথম অধ্যায়ে তিনি আরও বলেন, সাইকোলজিক্যাল জনতার সবচাইতে উল্লেখযোগ্য চারিত্রিক লক্ষণ হচ্ছে—জমায়েতে অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিবর্গ যারা জীবনযাত্রায়, পেশায়, চরিত্রে, বুদ্ধিমত্তায় যতই আলাদা হোক না কেন—উক্ত জমায়েত যখন জনতায় রূপান্তরিত হয়। তখন তাদের এমন একটি যৌথ কিন্তু একক মানসিকতা তৈরি হয় যে, বিচ্ছিন্ন থাকলে তারা যা চিন্তা ভাবনা বা কার্যকলাপ করত, তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
জনতার মন বিচার করতে গিয়ে গুস্তাভ প্রচুর উদাহরণ হাজির করেছেন ধর্ম, রাজনীতি ও বিপ্লব থেকে। তিনি গোটা বইজুড়ে বলেছেন জনতা চালিত হয় মূলত আবেগ দিয়ে। জনতা বিচারবুদ্ধির ধার ধারে না। কোথাও কোথাও তিনি জনতা আর পশুরপালকে অভিন্ন হিসাবে দেখেছেন। গুস্তাভ বলেন, জ্ঞানের বিচারে গণিতবিদ ও মুচির ব্যবধান দুস্তর কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক বিচারে উভয়ের ব্যবধান নাই বললেই চলে, থাকলেও সামান্য।
জনতার আবেগ সংক্রামক। তাকে তিনি জীবাণুর সংক্রমণের সঙ্গেই তুলনা করেছেন। কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা দেখেছি, একজন কিশোরকে চোর আখ্যা দিয়ে জনতা বিভিন্নভাবে তাকে পিঠিয়ে হত্যা করেছে। এই গুজবের সংক্রমণের কারণেই—গুজরাটে আড়াইহাজার মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। আরাকানে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা ধর্ষণ ও দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। জনতার এই আবেগের সংক্রমণের কারণেই গুস্তাভ বলেন, জনতার প্রতিটি কাজ ও আবেগই সংক্রামক আর এতই প্রগাঢ় যে ব্যক্তি সেখানে তার ব্যক্তিসত্তাকে জনসত্তার কাছে বিসর্জন দেয়।
অথচ এই গুজরাটে যারা হত্যা করছে, ফিলিস্তিনে যারা হত্যা করছে, আরাকানে যারা হত্যা ধর্ষণ করছে—তারা যদি ব্যক্তিগত বিচারবুদ্ধির সম্মুখীন হয়। তাহলে তারা হয়তো নিজেদের আচরণে লজ্জিত হবে। কিন্তু যখন তারা জনতায় পরিণত হয়, হয়তো রাজনীতি ধর্ম বা কোনো সামাজিক ঘটনার সংক্রমণ হয়। তখন তাদের আলাদা কোনো ব্যক্তিসত্তা থাকে না। তারা পরিণত হয় উন্মত্ত জনতায়। এক্ষেত্রে হয়তো সে সম্মোহিত হয়ে পড়ে। গুস্তাভ বলেন, নিখুঁত পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যে, কোনো ব্যক্তি যদি কিছুক্ষণের জন্য জনতার অঙ্গে পরিণত হয় তাহলে সে সম্মোহিত হয়ে যায়। এ অবস্থায় মস্তিষ্কের ক্রিয়া অসাড় হয়ে পড়ে। সে সময় তার ইচ্ছাশক্তি ও বিচার ক্ষমতা উবে যায়। তার সব চিন্তা-ভাবনা-অনুভূতি সম্মোহকের নির্দেশিত পথে চলে।
সামগ্রিক জনতা আসলে আদিম ও পাশবিক। এই জনতার মনস্তত্ত্ব হয়তো আদিমতা থেকেই গড়ে উঠেছে। কারণ গুস্তাভ দেখান জনতা আবেগতাড়িত যুক্তিবোধ বিসর্জিত বর্বর ও নরাধম। তার আচরণে নিম্নগতি পায়, উন্মত্ততায় শিকার হয়, আদিম মানুষের মতো উৎসাহ উদ্দীপনার অধিকারী হয়ে দাঁড়ানোর ফলে, সে তার নিজস্ব স্বার্থের ও অভ্যাসের পরিপন্থী কাজ করতে উন্মত্ত হয়ে ওঠে। সে স্বাধীনতা হারায় তার চিন্তা ভাবনা অনুভূতি পরিবর্তিত হয়। পরিবর্তন এতটাই সুদূরপ্রসারী যে তা একজন কৃপণকে মিতব্যয়ী করে তোলে, একজন পলায়নবাদীকে রূপান্তরিত করে বিশ্বাসীতে, সৎকে অসৎ, কাপুরুষকে বীরপুরুষে।
তবে জনতা কী শুধুই ক্ষতিকর একটা সত্তা? গুস্তাভ বলেন, জনতা সবসময় বুদ্ধিবৃত্তিক বিচারে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি থেকে নিম্নমানের। কিন্তু অনুভূতি ও কার্যক্রমের দিক থেকে অনেক সময় জনতা ব্যক্তি থেকে ভালো হতে পারে মন্দও হতে পারে। এসব নির্ভর করে জনতা কি ধরনের নির্দেশনার বশীভূত। যারা জনতাকে অপরাধীর ভূমিকায় দেখে, তারা এ প্রশ্নটি ভুল বুঝে থাকে। নিঃসন্দেহে জনতা অনেক সময় অপরাধপ্রবণ কিন্তু এ কথাও সত্য যে তারা বহু ক্ষেত্রে বীরোচিতও বটে। কেবল জনতাই পারে ঝুঁকি নিয়ে কোনো বিশেষ সত্য বা মতবাদকে বিজয়ের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে। যদি মানব সমাজ চিন্তা-ভাবনা করেই সব কিছু করতো। মানব ইতিহাসে খুব বেশি মহৎ কাজের নজির পাওয়া যেত না।
জনতার চরিত্র বাস্তবিকই অত্যন্ত জটিল। তবে জনতা কোনো একটা ক্ষমতা বলয়ের অধীনে কাজ করতে চায়। আবার সে ক্ষমতার দহন থেকে মুক্তিও পেতে চায়। জনতা খুব সহজেই নির্দেশনার দাস হয়ে পড়ে। জনতার কোনো নেতা কোনো কিছু তাদের কাছে তুলে ধরলে তা মিথ্যা হলেও জনতা সেটাকে সত্য বলে বিশ্বাস করে। শিক্ষিত অশিক্ষিত উভয়েই জনতার অন্তর্ভুক্ত হলেই ব্যক্তিসত্তা জনতার মানসিক দোষে দুষ্ট হয়ে পড়ে। অনেক লোক বলছে দেখলে জনতা সেটাকে সত্য বলে মেনে নেয়। এটাই জনতার অলেপনীয় ত্রুটি।
গুস্তাভ বলেন, জনতা সবসময় বলিষ্ঠ নেতৃত্বাধীন থাকতে চায়। জনতা বিপ্লবী হলেও তার অবচেতন মনে-রক্ষণশীল মানসিকতা, পরিবর্তন ও প্রগতির প্রতি অনীহা বর্তমান। যে জনতাকে ঘাতকের ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়, সেই একই জনতা অতি সহজে শহীদের ভূমিকা পালনেও আকৃষ্ট হয়।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই মূঢ় জনতা নামক সত্তাটা সবসময় কারো না কারো দ্বারা চালিত হয়েছে। সবসময় এটা দেখা গেছে যে সব রাষ্ট্রনায়কই এমনকি স্বৈরশাসকরাও জনতার এই মানসিকতাকে তাদের ক্ষমতার ভিত্তি বলে মনে করে। এই কথাটির প্রমাণে নেপোলিয়নের একটা উদাহরণ দেন গুস্তাভ। তিনি বলেন, নেপোলিয়ন ক্যাথলিক সেজে ভেনডেন-এর যুদ্ধ সমাপ্ত করেছিলেন। মুসলিম সেজে মিসরে পদার্পণ করেছিলেন, অতি ধার্মিক সেজে ইতালিতে ধর্মযাজকদের মন জয় করেছিলেন এবং একথাও বলেছিলেন যে ইহুদিদের পদাণত করতে হলে আমি সলোমনের মন্দির পুননির্মাণ করতাম। আলেকজান্ডার আর সিজারের পরে আর কোনো ব্যক্তি জনতার মানসিকতাকে এত ভালো করে বুঝেননি। তার বিজয়ে, বক্তৃতায় তার কার্যকলাপে নেপোলিয়ন সবসময় জনতার মানসিকতা সম্পর্কে সজাগ থাকতেন।
জনতা সম্পর্কে এই বইটির প্রতিটি শব্দই গুরুত্বপূর্ণ। জনতাকে গুস্তাভ বিভিন্ন দিক থেকে দেখার চেষ্টা করেছেন। জনতার সঙ্গে যে সমস্ত সম্পর্কগুলো তৈরি হয়—সেসব নিয়ে তিনি কথা বলেছেন। বইটি পাঠ জনতাকে ভুলভাবেও আবেগি দেখা থেকে বিরত রাখে ও হয়ে উঠে জনতা সম্পর্কে নতুন এক অভিজ্ঞতা।