স্বপ্নহীন পৃথিবী একটি দুঃস্বপ্ন
স্বপ্নচারীরা কখনো সমুদ্রের গর্জনে পিছু হাটে না। প্রথম শ্বাস প্রশ্বাস থেকে শেষ ইচ্ছা পর্যন্ত সব জয় পরাজয়, চড়াই উৎড়াইয়ের মাঝে যাকে কেন্দ্র করে মানুষ বেঁচে থাকে সেটা হচ্ছে আশা। একজন মানুষ ধ্বংস বা শেষ হয়ে যেতে পারে তবে কখনো আশা বা স্বপ্নের কাছে পরাজিত হতে পারে না। স্বপ্নহীন পৃথিবী একটি দুঃস্বপ্ন।
'দ্যা ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্যা সি' বইটি আর্নেস্ট হ্যামিংওয়ের অসাধারণ একটি সাহিত্য কর্ম। ১৯৫২ সালে রচিত এ ছোট উপন্যাসে তেমনি এক স্বপ্নবাজ লড়াকু জেলের জীবন চিত্রিত হয়েছে। এর এক পর্যায়ে এটাকে হয়তো মনে হবে-এটি কিউবার কোন একজন জেলে ও একটি মাছের গল্পকাহিনী।আবার কখনো মনে হয় মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যকার গল্প। সবকিছু ছাপিয়ে মোটা দাগে যেটা মনে হয়, এটা হচ্ছে বিপদসঙ্কুল মূহুর্তে ব্যক্তিত্ব, প্রেরণা ও বীরত্বের সংস্কৃতি বিষয়ক গল্প। এটা হচ্ছে একজন ব্যক্তির সাহস ও বীরত্বের গল্পগাথা, যে কিনা নিজের সন্দেহের বিরুদ্ধে নিজের সামর্থ্যের বিরুদ্ধে এবং আশা ছেড়ে দেয়ার মানসিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করে।
এই গল্পের খুবই মৌলিক চরিত্র হচ্ছে বয়স্ক মৎস্য শিকারি সান্তিয়াগো। টানা ৮৪ দিন জাল টানার পরেও কোন মাছ শিকার করতে না পারায় তার যোগ্যতা নিয়ে যখন সবাই সন্দেহ এবং বিরক্তি প্রকাশ শুরু করে। এমনকি নিজের জেলে জীবনের একমাত্র সঙ্গী ও শীষ্য মেনলিনকেও তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে অন্য নৌকায় পাঠায় তার বাবা-মা। ঠিক তখনও সান্তিয়াগো নিরাশ হয়নি। বরং নিজের স্বপ্ন ও বিশ্বাসের উপর সে অটুট ছিল, ছিল অবিচল। তার বিশ্বাস ছিল সে সমুদ্রের সবচেয়ে বড় এবং সুন্দর মাছটি সেই শিকার করবে। স্বপ্ন ছুঁতে অনাহারে অর্ধাহারে সে চেষ্টা চালিয়ে যায়। অবশেষে ৮৫তম দিনে তাঁর জালে ধরা পড়ল ১৮ ফুট লম্বা সোর্ড ফিস।
মাছ ধরতে না পারার আগে ছিল এক ধরনের লড়াই। কিন্তু মাছ শিকার করার পর শুরু হয় অন্যে এক লড়াই। বৃহদাকার ওই মাছটি এতটাই ছুটা -ছুটি শুরু করে, যেন বৃদ্ধ সান্তিয়াগো এবং তার নৌকাকে সমুদ্র থেকে ছুড়ে ফেলতে চায়। এভাবে টানা দুই দিন লড়াই চলে বৃদ্ধ জেলে ও মাছের। এক পর্যায়ে হার মেনে শান্ত হয় সোর্ড ফিস।
গল্পের এই পর্যায়ে বৃদ্ধের জয়ে পাঠক যখন স্বস্তির ও আনন্দের ক্ষণ গণনা শুরু করবেন তখন আবার গল্পে ভিন্ন মোড়। সেই মোড়ে শুরু হয় বৃদ্ধের বিষন্ন পরাজয়। মাছ নিয়ে তীরে ফেরার পথে দুধর্র্ষ সব হাঙরের আক্রমনে পড়ে সান্তিয়াগো ও তার নৌকা। নৌকার বৈঠা দিয়ে প্রথমে হাঙ্গরগুলোকে তাড়ানোর কঠোর চেষ্টা করে ওল্ড ম্যান। কিন্তু তীরে পৌছাতে পৌছাতে হাঙ্গরের সংখ্যা ও আক্রমণ এতটাই বৃদ্ধি পায় যে সে লড়াইয়ে পেরে উঠতে পারেননি। অবশেষে তীরে যখন নৌকা পৌছায় তখন সোর্ড ফিসের কঙ্কালই বাকি থাকে।
হেমিংওয়ের লেখনির শৈল্পিক রূপ এখানেই। তিনি এই বৃদ্ধের সাহস ও প্রেরণার জয়গান গেয়েছেন। নিঃসঙ্গ এক ব্যক্তি যে বিপদ-সঙ্কুল পথ বিবেচনা না নিয়ে সাহসিকতা এবং উৎসাহি হয়ে এগিয়ে স্বপ্ন জয়ে এগিয়ে যায় এমন মানব চরিত্রের উদযাপন হয়েছে এই গল্পে।
এই গল্পের আরেকটি পার্শ্ব চরিত্র রয়েছে। সেটি হচ্ছে এক যুবক। নিঃসঙ্গ সান্তিয়াগো নিজের ইচ্ছায় নিঃসঙ্গ হয়নি। জেলে পেশায় কাজের সহযোগী হিসেবে সম্পর্ক ও ভালবাসা তৈরি হয় এই তরুণের সাথে। যে কিনা পাঁচ বছর বয়স থেকে সান্তিয়াগোর সাথে মাছ শিকার শুরু করে। কিন্তু শেষের দিকে বাবা-মায়ের চাপে ছেলেটি অন্য এক নৌকায় যোগ দেয়। যেটা সান্তিয়াগোর নৌকার চেয়ে মাছ শিকারের দিক থেকে অনেক সফল ছিল। যদিও ছেলেটি বৃদ্ধের সততা, ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় মুগ্ধ ছিল। সে বৃদ্ধের সাথেই কাজ করতে স্বছন্দ বোধ করত। দূর সমুদ্রে বৃদ্ধ যখন মাছটিকে বশে আনতে এবং তৎপরবর্তী হাঙর তাড়াতে গিয়ে ব্যর্থ হচ্ছিল, তখন বার বার পরিতাপ করে ওই তরুণের উপস্থিতি চেয়েছে।
বর্তমানে আমাদের অনেকেই হয়তো নগরজীবনে অনুকূল পরিবেশে বসবাস করি। যেখানে প্রকৃতির সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকার কোনো বালাই নেই। কিন্তু হ্যামিংওয়ের এই গল্প উপকূল ও সমুদ্র তীরে বেঁচে থাকার জন্য প্রকৃতির সাথে মানুষের প্রতিনিয়ত যে লড়াই, আপনাকে তা স্মরণ করিয়ে দেবে।এই গল্প একদিকে ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক ও সহযোগিতার গুরুত্বের কথা স্বীকার করেছে। অন্যদিকে দৈনন্দিন জীবনে শত বাধা, হতাশা ও বিপদের মুখে কিভাবে স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার জন্য কতটা দক্ষতা, প্রচেষ্টা এবং লড়াইয়ের মানসিকতা দরকার তা দারুণ ভাবে চিত্রায়িত হয়েছে।