ঢাবি ছাত্র সোহানের উদ্যোগ— দ্যুতি ছড়াচ্ছে শশীভূষণ গ্রন্থাগার
- শেখ শাকিল হোসেন
- প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২১, ০৮:১৩ PM , আপডেট: ২৭ আগস্ট ২০২১, ০৮:১৩ PM
বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষা দেশের একমাত্র দ্বীপজেলা ভোলা। জেলা সদর থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে চরফ্যাশন উপজেলার প্রায় ১ লক্ষ মানুষের জনপদ শশীভূষণ। যা ২০১২ সালে থানায় উন্নীত হয়। কিন্তু, বৃহৎ এই জনপদে ছিল না কোন পাঠাগার। বিষয়টি ভাবায় শশীভূষণের স্বপ্নবাজ তরুণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র সোহানুর রহমানকে। তিনি এলাকার শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়ে দীর্ঘ ৩ মাসের প্রচেষ্টায় গড়ে তুলছেন শশীভূষণ থানার প্রথম পাঠাগার ‘শশীভূষণ গ্রন্থাগার’।
সোহান বলেন, শিক্ষা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রায় সকল ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে আমাদের শশীভূষণ। এখানকার ছেলেমেয়েরা পড়ালেখার ক্ষেত্রে অনেক বাঁধা মোকাবেলা করে। বিশেষ করে মেধাবীরা পর্যাপ্ত পরিচর্যার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। যার ফলে এখানকার শিক্ষার্থীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না।
তিনি আরো বলেন, আমি দুঃখ পাই যখন দেখি শিক্ষার্থীরা দিন দিন পড়ালেখা বিমুখ হয়ে যাচ্ছে। ফলে তারা জড়িয়ে যাচ্ছে নানা অপকর্মে, হারিয়ে যাচ্ছে মাদকের আসরে। করোনার এই সময়ে এই অবস্থা এখন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। তাই শিক্ষার্থীদেরকে বইয়ের প্রতি ফিরিয়ে আনতে একটি লাইব্রেরির চিন্তা মাথায় আসে, যা এখানে কখনোই ছিল না।
শুরুতে সোহান পরিকল্পনাটি তার কিছু বন্ধুকে বলে যারা বর্তমানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছে। তারপর তারা তহবিল সংগ্রহের কাজ শুরু করে। পাশাপাশি লিফলেট বিতরণ করে মানুষকে লাইব্রেরির গুরুত্ব সম্পর্কে বোঝাতে থাকে। বন্ধুবান্ধবসহ নিজেদের সংগ্রহে থাকা নতুন-পুরাতন বইগুলো সংগ্রহ করে। তারপর সোহানরা এলাকার সচেতন ও বিত্তবান মানুষদের শরণাপন্ন হয়।
সোহান বলেন, শুরুতে আমরা বিভিন্নভাবে যে তহবিল সংগ্রহ করেছিলাম সেটা দিয়ে ঘর ভাড়া নিই এবং তিনটি বইয়ের তাক ও তিনটি চেয়ার স্থাপন করি। নিজেদের বাসা থেকেও কিছু ফার্নিচার এনে লাইব্রেরি সাজিয়েছি।এভাবেই ৫-৬ জন পাঠকের বসার পরিবেশ তৈরি করে ‘এসো সবাই বই পড়ি, সুন্দর এক সমাজ গড়ি’ স্লোগানে যাত্রা শুরু করে ‘শশীভূষণ গ্রন্থাগার’।
বর্তমানে লাইব্রেরি কিভাবে চলছে- জানতে চাইলে সহ-উদ্যোক্তা খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আমিনুল ইসলাম নাঈম বলেন, আমাদের লাইব্রেরিতে আর্থিক সংকট রয়েছে। পর্যাপ্ত আসবাবপত্র ও লাইব্রেরিয়ান নেই। তারপরও আমরা স্বেচ্ছাসেবকরা মাসিক চাঁদা দিয়ে ঘরভাড়া এবং যাবতীয় খরচ চালিয়ে নিচ্ছি। গ্রন্থাগারটি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাঝে বই পড়ার মানসিকতা জাগিয়ে তুলতে সহায়ক হবে। ফলে তাদের শিক্ষাগ্রহণ হবে মানসম্মত ও আনন্দপূর্ণ। সুস্থ মস্কিষ্কের ধারার বিকাশ ঘটবে।
সোহানদের এই উদ্যোগ পুরো জনপদে সাড়া ফেলেছে। স্থানীয় রসুলপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম জানান, শশীভূষণ গ্রন্থাগার আমাদের এলাকায় একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ।এরফলে শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার প্রতি আগ্রহী হবে। আমি সর্বদা এই গ্রন্থাগারের যেকোন প্রয়োজনে পাশে আছি। স্থানীয় বেগম রহিমা ইসলাম কলেজের অধ্যক্ষ শরিফুল আলম শোয়েব জানান, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে সোহানের উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। আমাদের এই এলাকায় পূর্বে কোন গ্রন্থাগার ছিল না। আমরা শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দেই যাতে তারা লাইব্রেরিতে গিয়ে বই পড়ে। একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজের অগ্রযাত্রায় লাইব্রেরির ভূমিকা অপরিসীম।
শশীভূষণ গ্রন্থাগারের একজন পাঠক জাকির হোসেন। তিনি নিয়মিত লাইব্রেরিতে আসেন বই পড়তে। তিনি জানান, শশীভূষণে এরকম একটি গ্রন্থাগার হওয়ায় আমি খুবই আনন্দিত। এখানে সহজেই বই পড়া যায় যা আগে সম্ভব ছিল না। আমি নিয়মিত এখানে বই পড়তে আসি। এর মাধ্যমে আমি অনেক কিছু জানতে পারি। বই পড়া শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন খারাপ পথ থেকে ফিরিয়ে আনবে বলে আমার বিশ্বাস।
সোহানদের এই উদ্যোগের দ্যুতি ছড়িয়ে পড়েছে আশেপাশের এলাকায়ও। অনেকেই লাইব্রেরি পরিদর্শনে আসছেন এবং বিভিন্ন পরামর্শ নিচ্ছেন। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত লাইব্রেরি সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকে। লাইব্রেরির সদস্য হওয়ার মাধ্যমে বই বাসায় নিয়েও পড়া যায়। বর্তমানে সোহানদের লাইব্রেরিতে সাহিত্য, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, ইসলামিক, অনুবাদসহ নানা ক্যাটাগরির ২৫০টির অধিক বই আছে।
স্বপ্নবাজ সোহানুর রহমান পথ দেখাচ্ছেন শশীভূষণের হাজারো শিক্ষার্থীকে। নিজ জনপদের উন্নয়নে আরো বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়া এই তরুণ চায় একটি সুন্দর সমাজ গড়তে।