কবি নাহিদা ইসলামের ‘নিঃশব্দের মিছিল’ যেন অনুভূতির এটিএম
২০১৬ সালের আগস্ট মাসে নিউজিল্যান্ডের ওয়াংগারেই শহরে একটি অদ্ভুত এটিএম মেশিন স্থাপন করা হয়েছিল। যেখানে প্রচলিত অর্থে টাকা উত্তোলন কিংবা জমা কোনটাই সম্ভব ছিল না। তবুও তার সামনে মানুষের লাইন থাকতো। এর কারণ ছিল ঐ মেশিনের স্ক্রিনে প্রায় ১০০০ ধরনের অনুভূতি ছিল। যার মাধ্যমে শহরের লোকজন তাদের আবেগ অনুভূতি জমা রাখতো বা প্রকাশ করতো। শিল্পী ভেনেসা ক্রোয়ির পরিকল্পনায় স্থাপিত এই মেশিনকে বলা হতো আবেগ জমা রাখার মেশিন। যেটি নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটন ও অকল্যান্ডের মতো শহরে স্থাপন করা হয়েছিল জনমত যাচাইয়ের জন্য।
তেমনি উদীয়মান কবি নাহিদা ইসলামের প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ "নিঃশব্দের মিছিল" যেন তেমনই এক অনুভূতির ঝুঁলি। ৫৫টি ছোট বড় কবিতা দিয়ে সাজানো "নিঃশব্দের মিছিল"-এ করুণ সামাজিক সমস্যা, বাস্তবতা, যৌবনের আবেগ, বিরহ, বিচ্ছেদ, বিষাদ, ভালোবাসা, প্রতিবাদ, সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তা পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে। যেন রঙ্গমঞ্চের এক পাঁচমিশালী প্যাকেজ। শুদ্ধ ও সরল সাহিত্য চর্চার এক দুরন্ত প্রয়াস। যেখানে নেই শব্দের দুর্বোধ্যতা। তবে ভাবের গভীরতা আছে। ছন্দের আতিশয্যতা নেই তবে ছান্দসিক সমাপ্তি আছে। গন্দ ছন্দে লিখিত বেশীর ভাগ কবিতা যেন আমাদের যাপিত জীবনের মানচিত্র। মনে হচ্ছে বাড়িয়ে বলছি। কিন্তু যিনি তাঁর প্রথম যাত্রায় এমন আগমনী বারতা সংযোজন করতে পারেন তাঁর প্রতিভা সম্পর্কে, ধারালো কলম সম্পর্কে মন্তব্য করতে দ্বিতীয় বার ভাবতে হবে প্রিয়।
বইটি সম্পর্কে কবি নাহিদা ইসলাম বলেন, এই কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত কবিতাগুলো প্রেম, বিরহ, সমাজ, সামাজিক অন্যায়, বৈষম্য নিয়ে। আর তাতে রয়েছে অনেক অভিযোগ থাকে নিরবে,কিন্তু যা অপ্রকাশিত। আর তাই এটির নাম "নিঃশব্দের মিছিল"।
তিনি আরও বলেন, এই বইটাকে মলাটবদ্ধ আবেগ বলা যায়। অল্প কথায় আমি এর বিশ্লেষণ করতে পারব না। একেকটা কবিতার পেছনে কয়েকটা উপন্যাস, গল্প, মহাকাব্য লুকিয়ে আছে। বইটিতে বর্তমান প্রেক্ষাপট, সামাজিক বৈষম্য, গ্রামীণ সমাজ, প্রেম, বিরহ, বিচ্ছেদ সবকিছু নিয়ে অর্ধশতাধিক কবিতায় নিজের অনুভূতি তুলে ধরেছি।"
প্রশ্ন করা হয়, "একজন নাহিদা ইসলামের কবি হয়ে উঠার পেছনের গল্পটা কেমন?" তিনি এর উত্তরে বলেন, "কবিতা লেখা আমার নেশার মতো। প্রচন্ড রাগ, বিরহ কিংবা খুশি সব কিছুরই বহিঃপ্রকাশ কবিতায়। ক্লাস সেভেন এইট থেকেই কবিতার হাতে খড়ি। ছোট খাটো কবিতা লিখতে লিখতেই কলেজ লাইফে কবিতার পূর্ণতা দেয়ার চেষ্টা করেছি। ২০১৭ থেকে প্রচুর কবিতা লেখা হতো। আর সেগুলো ডায়েরি বন্দী ছিল ২০২০ পর্যন্ত। বই প্রকাশের ইচ্ছে থাকলেও হয়ে উঠেনি। লকডাউনে যখন বাড়িতে প্রচন্ড অবসরে ছিলাম, অনেক ডিপ্রেশন, অনেক কারনে মন খারাপ হওয়া কাজ করতো। আর এই টাইমটাতেও অনেক কবিতা লিখেছি। পরে ডিপার্টমেন্ট এর বড় ভাই 'কয়লা' উপন্যাস এর লেখক পারভেজ হোসাইন ভাইয়ার সাথে কথা হলো। ভাইয়া ডিপার্টমেন্টের সম্মানিত শিক্ষক আলম চৌধুরী স্যারের সাথে যোগাযোগ করতে বলে। স্যারকে পান্ডুলিপি তৈরি করে পাঠালাম, স্যার অনেক পছন্দ করলো। স্যারই বইয়ের নাম ঠিক করলেন, প্রকাশকের সাথে কথা বললেন। বলতে গেলে সব স্যারই দেখাশোনা করেছিলেন।"
এরপর তিনি তার কবিতার বিষয় বস্তু ও কবিতা নিয়ে অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেন,-" আমার অনেক গুলো কবিতা আছে বিরহের। এসব কবিতা গুলো যখন আমি ফেসবুকে পোস্ট করি তখন মজার ছলে হলেও অনেকে জিজ্ঞেস করে প্রেমে ব্যর্থ কিনা,বা কেউ প্রতারণা করেছে কিনা, ইনবক্সেও অনেকে জিজ্ঞেস করেছে। আর কবিতার বিষয়গুলো কি আমার জীবন থেকে নেওয়া কিনা!" তখন তার উত্তর ছিল এমন, "আমার চারপাশে যা কিছু ঘটে তা ই আমার বিষয়বস্তু।আমার পরিচিতজনের সাথে যা ঘটে তাও আমার বিষয়বস্তু। আমার নিজের ভাবনা কিংবা কল্পনাও আমার বিষয়বস্তু।"
বইটির ফ্ল্যাপে মোহাম্মদ আলম চৌধুরী বলেন, "জমজমাট প্রতারণার হাটে শূন্য হয়ে ফিরে শুদ্ধ প্রেমিক। বাউল বাতাস উড়ে আর কাঁদে। জীবনানন্দের পাখিরা ঘরে ফেরে না। সবখানে বিকৃত রসনার রসুইঘর। এমন শূণ্যতা, অপ্রাপ্তি, অপ্রেম, প্রকৃতিনাশ, অভিমান, আঁধার আর দুঃস্বপ্ন তাড়াতে প্রত্যয়গাঁথা স্বপ্নবাহী ভোরের আলোর মতো সুন্দরের প্রত্যাশায়- ‘নিঃশব্দের মিছিল’। প্রতিবাদের আগুনপোড়া শব্দরাজি দিয়ে তৈরি নাহিদা ইসলামের কবিতা। বিরহের শিল্পবন্দনা তুমুল ঝঙ্কার তুলে হিমছড়িঝর্ণার মতো।"
বইটির পাঠ প্রতিক্রিয়ায় লেখক পারভেজ হোসাইন বলেন, "এই বইয়ের বেশ কয়েকটি কবিতা আমার কাছে এত বেশী ভালো লেগেছে যে সেগুলো আমি ক্ষেত্র বিশেষে দশ-পনেরো বার অব্দি পড়েছি। তবুও মুগ্ধতা কমেনি এতটুকু।"
নরসিংদির রায়পুরা উপজেলার গ্রামীণ মেয়ে কবি নাহিদা ইসলাম বর্তমানে পড়াশোনা করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগে ৩য় বর্ষে। ছোট থেকে ডায়েরি লেখার মাধ্যমেই যাত্রা শুরু সাহিত্যের জগতে।
নিঃশব্দের মিছিল থেকে গৃহীত কয়েকটি লাইন- *টাকার ক্যাটাগরিতে নিলামে উঠে শরীর! *বিদায় বেলায় কিছু ভাষা দিয়ে যেও প্রিয়। *খোলা হবেনা অপেক্ষার দ্বার/ জায়গা হবে না কারো// কেবল দেখবো বলে তোমার অপেক্ষার মাত্রা/ কতোটা তুমি পারো। *বিদঘুটে সব হতাশা জাপটে ধরে আপাদমস্তক/স্মৃতিরা আলো হয়ে উঠে যেন চারিপাশ ঘিরে/আমি নিঃশব্দের মিছিলে চিৎকার করি’। *‘নারীটা স্নান সেরে পতিতা/আর পুরুষটা স্নান সেরে সমাজপতি’।
বই: নিঃশব্দের মিছিল, লেখক: নাহিদা ইসলাম, প্রকাশনী: পরাপাঠ, প্রকাশক: মনির ইউসুফ, নামকরণ: আলম চৌধুরী, উৎসর্গ: মা-বাবা, প্রচ্ছদ: নাজিব তারেকের পেইন্টিং অবলম্বনে, মূল্য: ১৩০ টাকা।