বুক রিভিউ: হেরমান হেসের ‘সিদ্ধার্থ’
বয়োসন্ধির পাঠ শেষ করে ব্যক্তিগত এবং পারবারিক জীবনের নানান অভিজ্ঞতা পেরিয়ে যাপিত জীবনের বিভিন্ন দুঃখ এবং না-পাওয়ার অপরিহার্য দৈনন্দিনতায় বিতৃষ্ণা নিয়ে এগোনো কিংবা অন্যকোনো মাধ্যমে দর্শন নিয়ে যারা আগ্রহী ওঠেন, তাদের সবার কাছেই ‘বুদ্ধ দর্শন’ তথা ‘নির্বাণ’ এক শক্তিশালী ভাবনার নাম।
দৈনন্দিন জীবনাচরণের নিয়মতান্ত্রিকতা এবং প্রতিটি মানব জীবনে সময়ের স্রোত বেয়ে আসা অবশ্যম্ভাবী দুঃখবোধকে এড়ানোর চিন্তায় তখন নির্বাণকেই প্রাসঙ্গিক মনে হয়। বস্তুগত নানান প্রাপ্তি এবং অপ্রাপ্তিযোগ থেকে উদ্ভূত সুখবোধ এবং বেদনাবোধ বয়ে বেড়ানো জীবন থেকে সম্পূর্ন আলাদা জীবন হিসেবে নির্বাণকে একেবারে উপযুক্ত পথ মনে হয় অনেকেরই। একবাক্যে ‘সিদ্ধার্থ’ এ ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত তত্ত্বের এক আধ্যাত্মিক উপন্যাস।
জার্মান লেখক হেরমান হেস (১৮৭৭-১৯৬২) দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বাধিক পরিচিত এ অঞ্চল থেকে উদ্ভূত ধর্ম দর্শন ভিত্তিক উপন্যাস ‘সিদ্ধার্থ’র স্রষ্টা হিসেবে। বইটির নাম দেখে প্রথমে সবারই এটাকে গৌতম বুদ্ধের জীবনী কেন্দ্রিক উপন্যাস মনে হলেও এটা মোটেও বুদ্ধ কেন্দ্রিক কোনো বই নয়। মূলত এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র সিদ্ধার্থ একজন ব্রাহ্মণ যুবক যিনি সন্যাস গ্রহণ করে মায়াহীন আত্মিক প্রশান্তিতে ভরা জীবন কাটাতে চান; মোক্ষ লাভ করতে চান এবং সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করার সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন।
কিন্তু সে পথে শান্তি না পেয়ে তিনি পার্থিব জীবনের নানান মোহে ভরা জীবনে আবার ফিরে এসেছিলেন। গৌতম বুদ্ধ এ উপন্যাসের একটি চরিত্র যার সাথে সিদ্ধার্থের দেখা হয়েছিলো। কিন্তু সে বুদ্ধের শিষ্যত্ব গ্রহণ না করে তাঁর পথকে অস্বীকার করে ফিরে আসেন।
এই উপন্যাসের কাহিনীকে অবলম্বন করে মূল চরিত্রে শশী কাপুরকে নিয়ে কোনরাড রক্স ‘সিদ্ধার্থ’ (১৯৭২) নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এই দৃশ্যায়নের সুবাদে এ উপন্যাসটির যথেষ্ট পরিচিতি এসেছে বলে মনে হয়। তবে তার চেয়েও যে কারণে বেশি প্রচার পেয়েছে বলে মনে করি তা হচ্ছে, এটা বুদ্ধের দেখানো নির্বাণ লাভের একটি উল্টো পথকে, একটা ভিন্ন দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
এতে এমন এক জীবনের যাপন দেখানো হয়েছে, যে জীবন কাম-বাসনা, অর্থ-সম্পত্তি, মায়া, দুঃখসহ এজাতীয় অনুভবকে বাহ্যিক অভিজ্ঞতার বিভিন্ন স্তর হিসেবে পার করে নির্বাণের দিকে ধাপিত হয়, যা বুদ্ধ দর্শন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পথ। বৌদ্ধ ধর্মীয় জীবনাচরণের যে অষ্টমার্গ রয়েছে যা পালনের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি নির্বাণের দিকে ধাবিত হয় তার অনেকগুলোকে সরাসরি অস্বীকার করাও হয়েছে এই দর্শনে।
হেসের বাবা-মা ছিলেন কেরালার মিশনারী। তাঁর মায়ের জন্মই কেরালাতে। তবে হেসের যখন জন্ম হয় তখন তাঁরা সবাইই জার্মানীতে ফিরে গেছেন। হয়ত ছোট বেলা থেকেই বেড়ে ওঠার সময়ে তিনি ভারতীয় জনজীবনের অনেক গল্প শুনেছেন। একনিষ্ঠভাবে পাঠ করেছেন জার্মান ভাষায় অনুদিত বৌদ্ধ এবং হিন্দু ধর্মীয় দর্শনের অনেক বই। কারণ আর দশজন জার্মান ছেলে-মেয়ের মতো হেসে রোমাঞ্চপথ প্রিয় ছিলেন না। তাঁর ছিলো শান্ত এবং ধ্যানিম জীবন। সমগ্র জীবনে তিনি মাত্র একবারই ১৯১১ সনে ইউরোপের বাইরে পা ফেলেছিলেন। মোটামুটি তিন মাসের সেই এশিয়া পরিক্রমার যে সফর ছিলো তাতে ভারতের মূল ভূ-খন্ডে আসার পূর্বেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ফিরে যান।
কিন্তু তবুও সিদ্ধার্থ বইতে ভারতীয় জীবনাচরণ বিশেষ করে আধ্যাত্মিক জীবন ব্যবস্থার খুটিনাটি উঠে এসেছে তাঁর বয়ানে। এ অঞ্চলের প্রাচীনগ্রন্থ 'কামশাস্ত্র'র প্রভাবও এই উপন্যাসে স্পষ্ট। সিদ্ধার্থ যখন সন্যাস ছেড়ে প্রথম নগরে প্রবেশ করেন তখন এক অচেনা মেয়ের সাথে দেখা হয় যে এসে তার বাম পা সিদ্ধার্থের ডান পায়ের উপর তুলে দিয়ে যে আহবান জানান তা কামশাস্ত্রে আলোচিত কলাসমূহের আহবান জানানোর এক বিশেষ ধরন।
এছাড়া এই শাস্ত্রে যৌনতাকে শুধুমাত্র যৌনতা হিসেবেই আলোচনা করা হয়েছে যেখানে কোনো সম্পর্কের কথা বলা হয় নাই। আর সিদ্ধার্থকে দিয়ে কমলার কাছে শিল্প হিসেবে যৌনতা শিখতে চাওয়ার কথা বলানোর মাধ্যমে তাকে একটি সার্বজনীন প্রেমময় পুরুষ চরিত্রে রূপান্তরিত করা হয়েছে। কোনো ধরনের বৈবাহিক সম্পর্ক ছাড়াই সিদ্ধার্থের পুত্র সন্তানের বাবা হবার যে বিষয় বর্ণিত সেটাও যে সময়কে ধরে এ উপন্যাস লেখা সেসময়ের বিচারে মোটেও প্রাসঙ্গিক নয় এ ভূ-খন্ডের জন্য। তবে কমলা যখন সিদ্ধার্থ’র কাছে বিনিময় চাইল তখন 'একটি কবিতার বিনিময়ে একটি চুম্বন চাওয়ার বিষয়টি কমলাকে গণিকা থেকে এক প্রেমময়ী নারীতে রূপান্তরিত করেছে; তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে এ উপন্যাসের নায়িকা হিসেবে।
‘সিদ্ধার্থ’ উপন্যাসে হেসে উদ্ধৃতি দিয়েছেন উপনিষদ থেকে। বুদ্ধ আর সিদ্ধার্থের যে ঐতিহাসিক কাল্পনিক কথোপকথন রচনা করেছেন তাতে সিদ্ধার্থ বুদ্ধ দর্শনের নির্বাণ প্রাপ্তির নির্ধারিত পথটিকে নস্যাৎ করে দিয়েছেন। সিদ্ধার্থের বন্ধু গবিরন্দ বুদ্ধের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেও সিদ্ধার্থ সে পথকে অস্বীকার করে চলে আসেন। বুদ্ধের সাথের এই কথোকথনটিকে আধ্যাত্মিক দর্শনের একটি বিতর্কের বাইরে গিয়েও যদি দেখা হয় এটা উপন্যাসের কাহিনীর পটবিন্যাসে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ এই কথোপকথনের রেশ ধরেই সিদ্ধার্থ প্রবেশ করেছেন নির্বাণ লাভের এক নতুন পথে।
হিন্দু দর্শনে চতুরাশ্রম নীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং হিন্দুশাস্ত্রীয় চরিত্রসমূহ এবং ঘটনা বিশ্লেষণ করলে জীবনের এই চার স্তরের পরিচয় পাওয়া যায়। এতে একজনকে প্রথমে গুরুগৃহে শিক্ষার্থী, তারপর গৃহস্থ, তারপর বানপ্রস্থধারী তপস্বী এবং সর্বশেষে সন্যাসী জীবনাচরণের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
জীবনের এই চারটি পর্বের যুক্তি এই যে, প্রতিটি মানুষের কিছু সহজাত কামনা বাসনা থাকে আর সন্তান উৎপাদনের মাধ্যমে সৃষ্টিকে টিকিয়ে রাখারও দরকার। তাই আধ্যাত্মিক জীবনে প্রবেশের পূর্বে মানুষের এই কামনা-বাসনা, অন্যান্য জাগতিক ইচ্ছেসমূহ পূরণ হওয়া দরকার। যেমন- শিক্ষা লাভের বাসনা (১ম পর্ব), যৌন-কামনা, সঙ্গিনী সঙ্গ পিপাসা, সন্তানের আকাঙ্খা (২য় পর্ব), এবং সর্বশেষে আসে মোক্ষ বা মুক্তি পিপাসা (৩য় ও চতুর্থ পর্ব)।
প্রাচীন হিন্দুদের শিক্ষা এই যে, এসব কিছু পূরণ করতে হবে এই ক্রম মেনে। সংসার জীবনের ভোগে এবং কর্তব্যে পরিতৃপ্ত মানুষেরাই সাধু-সন্ত হবার পথে পা বাড়াতে পারবে। কিন্তু বৌদ্ধধর্ম দর্শনে পরবর্তীতে গার্হস্থ্য পর্বটিকে সম্পূর্ণ মুছে দেওয়া হয়, যদিও গৌতম সব ধরনের ভোগ বিলাসের জীবনকে অতিক্রম করেই পরবর্তীতে বোধীজ্ঞান লাভ করে বুদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন।
উপন্যাসের প্রথম পর্বে হেসে সিদ্ধার্থের জীবনাচরণের মাধ্যমে মূলত তর্পন, যাগযজ্ঞ, ও পূজা-অর্চনাকেন্দ্রিক ব্রাহ্মণ্য গার্হস্থ্য জীবনকে দেখিয়েছেন। আচারের নিয়মতান্ত্রিকতায় বিরক্ত হয়ে সিদ্ধার্থ পরিব্রাজক সন্যাসী হয়ে ঘর ছাড়েন। কিন্তু সে জীবনও নিয়ম আর নিষ্প্রাণ অভ্যাসের আধিক্যে পরিপূর্ণ হওয়ায় একদিন বন্ধু গবিন্দকে সাথে নিয়ে বুদ্ধের উপদেশ শুনতে আসেন, মূলত আসেন মোক্ষ লাভের নতুন পথের সন্ধানে।
বুদ্ধের সাথে কথোপকথনে দেখা যায়, বুদ্ধ জীবনকে দেখছেন পূর্বনির্দিষ্ট কার্যকারণের এক অভিন্ন শৃঙখল হিসেবে। বুদ্ধের অনুগামী নির্বাণ চাওয়া মানুষের কর্তব্য হচ্ছে জীবন অস্বীকার করে জীবনের সেই কার্যকারণ সম্পর্ক এড়িয়ে যাওয়া। সিদ্ধার্থ বুদ্ধের কাছে সংশয় প্রকাশ করে বলেছেন, চাইলেই কার্যকারণ সম্পর্ক এড়ানো যায়। তবে মোক্ষলাভ ঘটে অতীন্দ্রিয়লোকে আর কার্যকারণ সম্পর্ক বাহ্যিক জীবনের ঘটনা। তাই একে এড়ানো বা পালনে কিছুই ঘটবে না যদি অতীন্দ্রিয় সত্ত্বার জাগরণ না ঘটে। উপন্যাসে এভাবে সিদ্ধার্থ শুধু বুদ্ধের নির্বাণ শিক্ষাকেই শুধু বাতিল করেন নাই; শিক্ষাদানের যাবতীয় ব্যবস্থাকেও নাকচ করে দিয়েছেন।
সিদ্ধার্থ সন্যাস জীবন ছেড়ে গৃহস্থ্য জীবনে ফিরে আসেন। হিন্দু দর্শনে এটা একটা পাপ, এক ধরনের পতন। এই পাপ আরো গুরুতর কারণ সে কমলাকে বিয়ে না করেও সন্তান জন্ম দেন। এখানে হেসে আসলে পাশ্চাত্য জীবনাচরণের প্রবেশ ঘটিয়ে দিয়েছেন। কারণ এভাবে বিয়ে না করে বাবা হওয়া বা মা হওয়া আমাদের এ উপমহাদেশের বাস্তবতার সাথে প্রাসঙ্গিক নয়। তবে তিনি মূলত নির্বাণ প্রাপ্তির বুদ্ধ নির্ধারিত পথকে আরো জোরালোভাবে ভাঙতেই এটা করেছেন বলেই মনে হয়েছে। আর বারবণিতা কমলার কাছে শিল্প হিসেবে যৌনতা শিখতে চাওয়াটা ছিলো সিদ্ধার্থের ভোগে প্রবেশের প্রথম স্তর যা নির্বাণের পথে থাকা মানুষের জন্য বুদ্ধ নিষিদ্ধ করেছেন।
তবে এই উপন্যাসের শেষে সিদ্ধার্থ যখন সকল ভোগ- বিলাস, অর্থবিত্তের সুখ উপভোগের পর সব কিছু ছেড়ে এসে নদীর তীরে পাটনী বাসুদেবের সাথে থাকা শুরু করলেন সেটাই তার নির্বাণের নতুন সূচনা করে। উপন্যাসে বার বার নদীর কথা শোনার মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ার যে ঘটনা বর্ণিত আছে, সেটা মূলত নিজের চিন্তা দ্বারাই পরিচালিত হওয়া। কোনো বিশেষ গুরুর নির্ধারিত পথের অন্ধ অনুসরণ নয়। সিদ্ধার্থে বুদ্ধের নির্ধারিত পথকে উত্তম বলা হয়েছে, সঠিকও বলা হয়েছে।
তবে সিদ্ধার্থের মতে সেটা বুদ্ধ তাঁর সারাজীবন দিয়ে অনুভব করেছেন, এই পথে সে বোধীজ্ঞান লাভ করেছেন। তবে এটা শুধুমাত্র তাঁর নির্বাণ লাভের উপায় হতে পারে। সকল মানুষের নয়। কারণ বিদ্যা একজন আরেকজনকে শেখাতে বা দান করতে পারেন। কিন্তু জ্ঞান কখনো কেউ কাউকে শেখাতে বা দান করতে পারেন না। এটা উপলব্ধি করতে হয়। উপন্যাসে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধার্থের এই চিন্তার উন্মেষ ঘটে। যেটা তার মধ্যে জাগিয়ে তোলেন খেয়াঘাটের এক মাঝি।
অর্থাৎ জীবনে শিক্ষাগুরু শুধুমাত্র গুরুগৃহ বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই থাকেন না; জীবনের যেকোনো পাঠের শিক্ষক যে কেউ বা যেকোনো কিছু হতে পারে। যেমন আধ্যাত্মিকতার আলোকে লেখা এই উপন্যাসে মাঝি বাসুদেবের গুরু হয়ে উঠেছে একটা নদী, আর সারা জীবন অসংখ্য গুরুর সংস্পর্শে গিয়েও কাউকে গুরু হিসেবে গ্রহণ করতে না পারা, এমনকি বুদ্ধকেও গুরু হিসেবে অস্বীকার করা সিদ্ধার্থ এই মাঝিকে তার গুরু হিসেবে স্বীকার করে প্রণাম করেছেন। এই মাঝি নদীর কথা শোনার মাধ্যমে মূলত নিজের চিন্তা দ্বারা সিদ্ধার্থকে পরিচালিত হওয়া শিখিয়েছিলেন।
এটা অনেকটা শ্রীমদভগবত গীতার একাদশ অধ্যায়ের বিশ্বরূপ দর্শনের মতো। তবে এই দেখাটা ছিলো মূলত নিজেকে দেখা, এই জানাটা কেবল নিজেকে জানা। অর্থাৎ নিজের সত্ত্বাকে আটকে রেখে নয়; ইচ্ছানুযায়ী পরিপূর্ণ তৃপ্তির শেষে আত্মিক এক জাগরণের মাধ্যমে অতীন্দ্রিয়বোধসম্পন্ন জীবনে প্রবেশ যা বুদ্ধের নির্ধারিত নির্বাণের সম্পূর্ণ ভিন্ন এক আখ্যান।
লেখক: থিসিস শিক্ষার্থী, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়