বুক রিভিউ: আহমদ ছফার বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস

  © টিডিসি ফটো

লেখক হল বইয়ের স্রষ্টা। স্রষ্টা সম্বন্ধে না জেনে সৃষ্টিকর্মের মর্ম উপলব্ধি করা দুষ্কর্ম। তাই এই প্রজন্মের পাঠকের জন্য বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (পরিবর্ধিত সংস্করণের শিরোনাম: সাম্প্রতিক বিবেচনা: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস) এর রিভিউ দেয়ার পূর্বে বইয়ের লেখক আহমেদ ছফা কে নিয়ে দুই কলম বলা প্রয়োজনবোধ করছি।

আহমেদ ছফা ছিলেন ‘‘অসম্ভব শক্তিধর লেখক’’ মন্তব্য করেছেন হুমায়ুন আহমেদ। জাফর ইকবাল বলেছেন, আহমেদ ছফা ছিলেন ‘‘চুলের ডগা থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত একশত ভাগ সাহিত্যিক’’।তিনি আরো মজার একটা উক্তি করেছেন, আহমেদ ছফা মরে গিয়ে সবাইকে বিপদে ফেলে দিয়েছেন! এখন কেউ পুরস্কার দিয়ে লজ্জা মোচন করতে পারছে না।"অসংখ্য সাহিত্যিকের জন্মদাতা এবং মেন্টর আহমেদ ছফা বুদ্ধি বেঁচে খাওয়া সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে অস্ত্রের মত ধারালো কলম ধরতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। আর দুর্দান্ত সাহসিকতার সাথে কাজটি করেছেন বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস গ্রন্থে।

গ্রন্থটিতে আহমদ ছফা বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের মানচিত্র অঙ্কন করেন এবং বাংলাদেশি বুদ্ধিজীবীদের সুবিধাবাদিতার নগ্ন রূপ উন্মোচন করেন তথা বুদ্ধিজীবীদের সত্যিকার দায়িত্বের স্বরূপ ও দিকনির্দেশনা বর্ণনা পূর্বক তাঁদের সতর্ক করে দিতে বুদ্ধিজীবীদের ব্যর্থতায় বাংলাদেশের কী দুর্দশা হতে পারে তা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেন।

বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস গ্রন্থের প্রথম ভাগটিতে রাজনৈতিক দলের মধ্যে মুসলিমলীগ, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বামপন্থী, জাসদ ইত্যাদি কোনটাই বাদ যায় নি সমালোচনা থেকে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভাল দিকগুলোও তুলে এনেছেন। আবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাঁকশালি চিন্তাচেতনার বিরোধিতা করতে ক্ষণিক সময় নেন নি। আওয়ামী রেডিক্যাল থেকে সৃষ্ট তরুণদের দল জাসদ এর মৃত্যুকে তিনি করুণ সংবাদ বলে অবহিত করেছেন৷

জাসদ বামপন্থী প্রগতিশীল দল না হলেও তারুণ্যের অংশগ্রহণকে ইতিবাচক পরিবর্তন বলে স্বীকার করেন। জাসদের মৃত্যুর মূল কারণ গুলো সবিস্তারে না লিখলেও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন । বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এর আগমন কে যেমন অভিনন্দন জানিয়েছে। একইসাথে তীব্র ভাষায় নিন্দা জানিয়েছেন বিএনপিকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিদের পক্ষে কাজ করা রাজাকারদের অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়ার জন্য। বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনীতির ব্যর্থতার একটি খতিয়ান দিয়েছেন। সেখানে তিনি বামপন্থার ব্যর্থতার এগারোটি কারণ নির্দেশ করেছেন।বামপন্থীদের মধ্যে কতিপয় প্রগতিশীল মানুষে বাস্তবিক অর্থে সুবিধাবাদ রূপ ধারণকারী মানুষের সমালোচনা করেছে।

ছফার ভাষায়, ‘আগে বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি ছিলেন, বিশ্বাসের কারণে নয়— প্রয়োজনে। এখন অধিকাংশ বাঙালি হয়েছেন—সেও ঠেলায় পড়ে।’ দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা, গল্প-উপন্যাসে পাকিস্তান প্রশস্তি, স্বৈরশাসকের জীবনী অনুবাদ— এসব বিষয়কে ছফা দেখেছেন লেখকদের মেরুদণ্ডহীনতার চূড়ান্ত প্রমাণ হিসেবে। একইসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগমুহূর্তে লেখক সমাজের নিষ্ক্রিয়তা, যুদ্ধের সময় দ্বিধান্বিত ভূমিকা, ভারতে পালিয়ে বেড়ানো, ভোগবিলাসে মত্ত থাকার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ছফা তুলে ধরেছেন, স্বাধীনতা পূর্ববর্তী বাংলাদেশের লেখক সমাজ কতটা অপরিণামদর্শী ও অদূরদর্শী ছিলেন।

ছফা বলেন, সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীরা ‘প্রয়োজনে-ঠেলায়’ পড়ে বিশেষ বিশেষ ঘটনার আগে যে ধরনের বক্তব্য-বিবৃতি দেন, ঘটনার পরে লেখেন তার উল্টো কাসুন্দি। ফলে তাদের কোনো চিন্তা-কর্ম-উপদেশ সমাজের বিশেষ কোনো কাজে আসে না।তাই ছফা বলেন, বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হত না। এখন যা বলছেন, শুনলে বাংলাদেশের সমাজ-কাঠামো আমূল পরিবর্তন হবে না।

ছফা বলেছেন, আমাদের মন-মানস এতো দীর্ঘকাল ধরে দাসত্ব করেছে যে, তার হদিস আমরা নিজেরাও জানিনে। অসংখ্য বিদেশি জিনিসের মধ্যে কোনটা আমাদের জন্য উপযুক্ত, কোনটা অনুপযুক্ত, কোনটা প্রয়োজন, কোনটা অপ্রয়োজন, কোনটা খেলে ভালো হবে, কোনটা খেলে খারাপ হবে, কোনটা করা উচিত, কোনটা করা উচিত নয় সে ব্যাপারে আমাদের ধারণা করার শক্তিও নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা জ্ঞানকে কতদূর সার্বজনীন করব, প্রযুক্তিবিদ্যার কি পরিমাণ প্রসার ঘটাব এবং বিজ্ঞানের ফলিত প্রয়োগ কতদূর নিশ্চিত করব তার উপরেই নির্ভর করছে আমাদের স্বাধীনতার ভবিষ্যৎ।

এসব যদি করা অসম্ভব হয়ে পড়ে তাহলে নামে স্বাধীন হলেও কার্যত আমাদের দাস থেকেই যেতে হবে। অপরের বাঁধা-ধরা চিন্তার মধ্যে আমাদের আবর্তিত হতে হবে। আমাদের নিজস্ব রুচি নিজস্ব সংস্কৃতির যে নির্দিষ্ট কোনো আকার আছে, তা কোনোদিন দৃশ্যমান করে তুলতে পারব না। বাঙালি-সংস্কৃতি বলতে যদি আদ্যিকালের কোনো সমাজের চিন্তা-চেতনায় আচ্ছন্ন থাকি বা তা আঁকড়ে ধরতে চেষ্টা করি তাহলে আমরা সভ্য মানুষ হিসাবে স্বীকৃত হতে পারব না।

ইতিহাসের ধারায় বাঙালি আজ যেখানে এসে পৌঁছেছে সবকিছু স্বীকার করে নিয়ে, মেনে নিয়ে এই বৈজ্ঞানিক যুগে পৃথিবীর অপরাপর দেশের সঙ্গে তাল রেখে আমাদের মাটি জলহাওয়া যে আমাদের চরিত্রকে একটি নির্দিষ্ট ধাঁচে তৈরি করেছে, সেটি ফুটিয়ে তুলতে পারাটাই হবে আমাদের যথার্থ মৌলিকতার স্ফুরণ এবং সেটাই হবে আমাদের যথার্থ বাঙালিয়ানা। আবুল কাসেম ফজলুল হক মনে করেন, বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তির জগতের চালচিত্র বোঝার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস।প্রবন্ধটির কারণে তৎকালীন সরকারের রোষে পড়তে হয় তাঁকে।


সর্বশেষ সংবাদ