তোত্তোচান: জানালার ধারে ছোট্ট মেয়েটি
তোত্তোচান একটি জাপানি শিশু। তবে তার কেতাবি নাম তেৎসুকো কুরোয়ানিগা। জাপানে শিশুদের নামের শেষে ‘চান’ যোগে ডাকা হয়। ফলে সবাই তাকে ডাকে তেৎসুকোচান বলে। তবে ওই শিশুটি শুনতো তোত্তোচান। তাই যখনি কেউ তার নাম জিজ্ঞেস করত, সে বলতো আমার নাম ‘তোত্তোচান’।
লেখক তার নিজের শিক্ষাজীবনের শুরুর বিদ্যালয়, তার প্রধান শিক্ষকের শিক্ষাদান পদ্ধতি, মানবিকতা, শিশুদের সাথে শিশুদের সম্পর্ক, শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক বিদ্যালয়ের চিত্র তুলে ধরেছেন ‘তোত্তোচানঃ জানালার ধারে ছোট্ট মেয়েটি’ বইয়ে। লেখক জাপানের রেডিও ও টেলিভিশনের জনপ্রিয় উপস্থাপক।
১৯৮১ প্রকাশিত এই বইটির বাংলায় অনুবাদ করেন চৈতী রহমান। দুন্দুভি প্রকাশিত বইটির বাজার মূল্য ২৫০ টাকা। বাংলাভাষা ছাড়াও বইটি বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। পেয়েছে সর্বাধিক বিক্রির তকমাও।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালের টোকিওর দক্ষিণ পশ্চিমের একটি স্কুল নিয়ে এই বইটির সূত্রপাত। তোমোয়ো ইশকুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন সোশাকু কোবাইয়াশি। অনেক দিন ধরেই কোবাইয়াশি মশাই শিশু শিক্ষা নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু করেন। তিনি ১৯২২ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন স্কুল ভ্রমণ করেন। এরপর ১৯৩৭ সালে তোমোয়ো স্কুল প্রতিষ্ঠান আগ পর্যন্ত তার ইউরোপ ভ্রমণ অব্যাহত রাখেন।
স্বপ্ন ছিল একটা শিশু বান্ধব স্কুল তৈরি করার। কোবাইয়াশি তার শিক্ষকদের বলতেন, ‘শিশুদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে দাও। প্রকৃতির মাঝে ছেড়ে দাও। শিক্ষকদের স্বপ্নের চেয়ে শিশুদের স্বপ্ন অনেক অনেক বড়’। তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘সব শিশুই জন্মায় সহজাত মানবিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে, কিন্তু পরিবেশ আর বয়স্কদের প্রভাব তাদের নষ্ট করে দেয়’।
খুব আলোচিত এই বইটি অনেক দিন ধরেই পড়ার ইচ্ছা ছিল। কয়েকবার রকমারি ডট কমে অর্ডার করেও পাইনি। ফলে বই মেলার শুরু থেকেই আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বইটি কেনার ব্যাপারে। তবে ব্যস্ততার কারনে পড়া শুরু করলেও শেষ করতে সময় লেগেছে। বইটি কারো কাছে গল্পের বই মনে হলেও আমার কাছে শিক্ষা বিষয়ক একটা দরকারি বই।
অনেকটা ‘তারে জামিন পার’ কিংবা ‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবির মত। আমার কাছে এই দুটি হিন্দি ছবি গতানুগতিক সিনেমার চেয়েও অনেক বেশি শিক্ষা বিষয়ক প্রয়োজনীয় সিনেমা। বইটির শুরু একটি ছোট্ট শিশুর স্কুলের প্রথম শ্রেণি থেকে বহিষ্কারের মধ্য দিয়ে। যেখানে উঠে আসে একটি শিশুর সহজাত বিষয়গুলো শিক্ষকের দেখার দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীদের জীবনে কী প্রভাব পরে। যার গভীরতা কতটা গভীরে।
একশো বছর আগের বাস্তব ঘটনা নিয়ে লেখা বইটি এখনো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কতটা গুরুত্বপূর্ণ অনুবাদক সে ব্যাখ্যা দিয়েছেন বইটির ভূমিকাতে। তবে যারা নতুন বাবা-মা কিংবা যাদের সন্তান স্কুলে যাচ্ছে তাদের এটা পড়া দরকার। আর যারা শিক্ষা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করেন তাদের জন্য আরো ভালো করে পড়া দরকার। তবে আশা রাখি এডুকেশন পলিসি নিয়ে যারা কাজ করবেন তারাও বইটি পড়ে দেখবেন।
তোত্তোচান ক্লাস চলাকালীন সময়ে জোরে জোরে শব্দ করায়, জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকায়, বাজনা বাদকদের ডেকে ডেকে ঘন্টা-ঢাক-বেহালা বাজানোর অনুরোধ করায়, পাখির সাথে আলাপ করায়, অন্য শিশুদের ডেকে ডেকে পাখি দেখানো এবং কাগজে ছবি না একে টেবিলে ছবি আকায় তাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
তার মাকে ডেকে বলা হয়, ‘আপনার কন্যাটি ক্লাসরুমের সবকিছুতে বিরক্ত করে। সত্যিই ওর সাথে আমি আর পেরে উঠছিনা। দয়া করে ওকে এখান থেকে নিয়ে গিয়ে অন্য স্কুলে ভর্তি করুন’। যেমনটা আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অভিযোগ, ‘শিশুরা অনেক বেশি দুষ্টুমি করে। কনট্রোল করা যায় না’।
আর উল্টো দিকে শিক্ষা মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘শিশুরা এই বয়সে দুষ্টুমি করবে। যাকে তারা বলছে শিশুর বিকাশ ও বৃদ্ধি’। ফলে যা হবার তাই হলো। অন্য স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করা হলো তোত্তোচানকে। যেই স্কুলের নাম আগেই বলেছি তোমোয়ে গাকুয়েন বিদ্যালয়।
রেলগাড়ীর পরিত্যক্ত কামরা গুলোই তোমোয়ো স্কুলের এক একটি রুম। এ যেন রেলগাড়িতে স্কুল। যেন শিক্ষা জীবনের রেলগাড়ী। যে রেলগাড়ীতে ভ্রমণ করবে ছোট্ট ছোট্ট শিশুরা, যাত্রা শুরু করবে আগামীর পথে। লেখক বইটিতে চমৎকার ভাবে তার সহপাঠীদের পরিচয়, ক্লাস রুমে বসার ব্যবস্থা এবং পুরো একটি বছরে তারা কী কী করেছেন তা ফুটিয়ে তুলেছেন।
তিনি পড়াশোনার কায়দা কানুন নিয়ে বলছেন, ‘এখানে ঘন্টা ধরে সাজানো কোন ক্লাস নেই। এখানে সব কিছুই অন্য রকম! দিনের শুরুতেই শিক্ষক ক্লাসে ঢুকে কোন বিষয়ে কী পড়ানো হবে তার লিস্ট দিয়ে দেন সবাইকে। তারপর শিক্ষক বলেন, এখন যার যে বিষয় পছন্দ সে বিষয় দিয়ে পড়া শুরু কর।’
লেখক বলছেন, এর ফলে শিক্ষকেরা সহজেই জানতে পারছেন শিশুদের কোন বিষয়ে আগ্রহ এবং তাদের চিন্তা ভাবনার ধরণ কেমন। এই ক্লাসে কেউ হয়তো রচনা লিখছিল, আর কেউ হয়তো ছবি আঁকছিল।
এবার আমাদের দেশের একটা গল্প বলি। আমার এক পরিচিত বড়ভাইয়ের ছেলে ক্লাস ওয়ানে পড়ে। তাকে বলছে ‘এ’, ‘বি’, ‘সি’ দিয়ে আপেল, বল, ও ক্যাট লিখতে। কিন্তু তার ছেলে ওগুলো না লিখে ‘এ’ দিয়ে আলমারি, ‘বি’ দিয়ে ব্যাট এবং ‘সি’ দিয়ে সাইকেলের ছবি একে ম্যাডাম কে দেখায়। তখন ম্যাডাম সব কেটে দিয়ে বলে কিছু হয় নাই। এমনকি তার বাবাকেও ডেকে পাঠায়।
পরিশেষে ওই শিশুটিকেও স্কুল ছাড়তে হয়। একদিন ওই বড়ভাই তার মোবাইলে ছবি দেখিয়ে আক্ষেপ করে এ ঘটনা বর্ণনা করেন। আর জানতে চান তার করণীয়। তাই, ১৯৩৭ সালের জাপান আর ২০২০ সালের বাংলাদেশের মধ্যে আমি খুব কোন পার্থক্য দেখি না। শুধু স্থান দুটো আর সময় আলাদা।
তোমোয়ো স্কুলের শুরুতেই তোত্তোচানের ইন্টারভিউ নেন কোবাইয়াশি মশাই। তিনি তোত্তোকে বলেছিলেন, তুমি তোমার সম্পর্কে আমাকে কী কী বলতে চাও? তিনি এক নাগাড়ে চার ঘন্টা তোত্তোচানের কথা শোনেন। তখন তোত্তোচান ভাবেন এই প্রথম কোন মানুষ এতটা আগ্রহ নিয়ে তার কথা শুনছে। যা হয়তো অনেকের কাছেই শিশুর অর্থহীন বকবকানি।
এভাবে পাহাড়ের কিছু ও সমুদ্রের কিছুর মধ্য দিয়ে স্কুলের টিফিন, শর্ষে ক্ষেতের পাশদিয়ে হাটতে হাটতে ফুলের পুংকেশর ও গর্ভকেশরে প্রজাতির অবদান, পুকুরে সাতার কাটার মধ্য দিয়ে শিশুদের দৈহিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা প্রদান, ছুটিতে ক্যাম্পিং, ভুত খেলার মধ্য দিয়ে সাহসী পরীক্ষা, সমুদ্র ভ্রমণ সহ নানান দিক গল্পের ছলে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক।
তোমোয়ো স্কুলের প্রধান শিক্ষক অভিভাবকদের বলেছিলেন শিশুদের ময়লা কাপড় পরিয়ে স্কুলে পাঠানোর জন্য, যাতে শিশুরা খেলা করতে, জামা কাপড়ে ময়লা লাগাতে সংকোচবোধ না করেন। আবার তিনি মাঠ থেকে একজন কৃষককে এনে শিশুদের জমি চাষের কলাকৌশল শিখিয়ে ছিলেন। যার মধ্য দিয়ে শিশুরা নিজ হাতে বোনা বীজ থেকে চারা গজানো দেখতে পাওয়ার কত আশ্চর্য সুখানুভূতি।
এরপর একদিন কোবাইয়াশি স্যার শিশুদের নিয়ে গেলেন মাঠে রান্না করে পিকনিক করতে। শিশুরা ইট দিয়ে চুলা বানানো, লাকরি সংগ্রহ, সবজি কাটাসহ রান্না করল। এই শিশুদের কেউই আগে এত মনোযোগ দিয়ে রান্নার পাত্র খেয়াল করেনি, চুলোর আগুন উসকে দেয়নি, কমিয়ে দেয়নি। তারা বারবার টেবিলে পরিবেশিত মজার সব খাবার খেয়ে এসেছে অমনি অমনি।
রান্নার আনন্দ, চুলোর বিপদ কিংবা আগুনের তাপে হাড়ির ভিতরের জিনিস বদলে যাওয়া তাদের কাছে এতকাল অচেনাই ছিল, যা ছিল মূলত শিশুকে বাস্তবতার কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে শেখানোর প্রচেষ্টা।
সর্বোপরি বইটিতে একজন প্রধান শিক্ষক কিভাবে একটা স্কুল দাড় করান এবং শিশুদের কতটা ভালোবাসা দিয়েছেন তাই ফুটে উঠেছে। তিনি শিশুদের জন্য শুধু লাইব্রেরি তৈরি করেই থামেন নি, বাসায় বই নেয়ার ব্যবস্থা করা এবং কারো কাছে নতুন কোন বই থাকলে তা অন্যকে পড়তে দেয়ার ব্যবস্থাও করেছিলেন কোবাইয়াশি মশাই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমেরিকার সাথে যুদ্ধকালীন সময়ে জাপানে ইংরেজি ভাষা শিক্ষা নিষিদ্ধ হওয়ার সময়ও তিনি অন্য ভাবে (আমেরিকা ফেরত একটি শিশু ভর্তি করিয়ে) শিশুদের ইংরেজি শেখার সুযোগ তৈরি করেছিলেন। তবে স্কুলটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকার বি- ২৯ বোমারু বিমানের হামলায় ধ্বংস হয়। যার মধ্য শেষ হয় তোমোয়ো স্কুলের অগ্রযাত্রা।
লেখক: সহকারী বিশেষজ্ঞ
জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি, ময়মনসিংহ