০৫ মার্চ ২০২০, ০০:২৪

১৯৮১ সালের বইয়ে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের আভাস!

  © সংগৃহীত

প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাসের আক্রমণে সারা বিশ্ব যখন আতঙ্কগ্রস্ত, সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের একজন ফিকশন লেখকের একটি বই সোশাল মিডিয়ায় আলোচনার ঝড় তুলেছে। ১৯৮১ সালে প্রকাশিত ডিন কুনজের থ্রিলার ‘দ্য আইজ অফ ডার্কনেস’-এর প্রচ্ছদ এবং একটি পৃষ্ঠা তুলে দিয়ে বলা হচ্ছে, চীনের উহান থেকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাসের কথা নাকি বইটিতে লেখা হয়েছিল।

গত কয়েক দিন ধরে সোশাল মিডিয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমেও বইটি নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। বইটি নিয়ে ফেসবুক ও টুইটারে যে পোস্ট দেওয়া হয়েছে, সেগুলো এরইমধ্যে হাজার হাজার বার শেয়ার ও রিটুইট হয়েছে।

একজন শোকার্ত মায়ের ছেলের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে রহস্যময় এক পরিবেশে ঢুকে পড়ার কাল্পনিক কাহিনী তুলে ধরে লেখা এই বইয়ে একটি প্রাণঘাতী ভাইরাসের কথা বলা হয়, যার নাম দেওয়া হয় ‘উহান-৪০০’। ভয়ঙ্কর এই ভাইরাস মানুষের শরীরে ঢুকলে মৃত্যু অনিবার্য বলে বলা হয় এখানে। 

এদিকে নভেল করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান থেকেই। কভিড-১৯ নাম পাওয়া এই রোগে মৃতের সংখ্যা ৩ হাজার ২০০ ছাড়ানোর মধ্যে ওই উহান শহরটি এখনও রয়েছে চীনের বিশেষ নজরদারিতে।    

এ থেকেই ‘উহান-৪০০’ ও নভেল করোনাভাইরাসের মধ্যে মিল খুঁজে পেয়েছেন সোশাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের একটি বড় অংশ। এখন সারা বিশ্বে মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ানো এই ভাইরাস নিয়ে ডিন কুনজ চার দশক আগেই পূর্বাভাস দিয়েছিলেন বলে মনে করছেন তারা।

তবে এ দুটি বিষয়ের আদ্যোপান্ত বিশ্লেষণ করে একে নিছক কাকতালীয় ঘটনা বলছে রয়টার্স। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি  প্রকাশিত এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে রয়টার্স একে বলছে, আংশিক মিথ্যা দাবি। এতে বলা হয়, কুনজ আসলে একটি কাল্পনিক ভাইরাস নিয়ে লিখেছেন যার নাম চীনের ওই শহরের সাথে মিল রেখে তিনি দেন ‘উহান-৪০০’। উহান থেকেই কভিড-১৯ এর শুরু হলেও এই রোগের উপসর্গ ও আচরণের সঙ্গে বইয়ে উল্লেখিত ভাইরাসের মিল নেই।

যে পৃষ্ঠাটি সোশাল মিডিয়ায় প্রকাশ করে দাবি করা হচ্ছে, কুনজের বইয়ে ২০২০ সালে নিউমোনিয়ার মতো এই রোগটি মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়বে বলে লেখা আছে; সেই পৃষ্ঠাটি আসলে ওই বইয়ের নয়। 

ওই লাইনগুলো ২০০৮ সালে প্রকাশিত  ‘এন্ড অফ ডেজ: প্রেডিকশন অ্যান্ড প্রফেসিস অ্যাবাউট দ্য এন্ড অফ দ্য ওয়ার্ল্ড পেপারব্যাপ’ থেকে নেওয়া। এই বইয়ের লেখক সিলভিয়া ব্রাউনি নিজেকে আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী বলে দাবি করেন।

তিনি ওই বইয়ে লিখেছিলেন, “২০২০ সালের দিকে তীব্র নিউমোনিয়ার মতো গুরুতর একটি রোগ ছড়িয়ে পড়বে এই ব্রহ্মাণ্ডে। এতে মানুষের ফুসফুস আর শ্বাসনালী আক্রান্ত হবে, কিন্তু কোনো চিকিৎসাই কাজে আসবে না।”

ডিন কুনজের বইয়ের যে পৃষ্ঠাটির কয়েকটি লাইন নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় তোলপাড় চলছে তাতে বলা আছে, ”ওরা এর নাম দিয়েছে ‘উহান-৪০০’; কারণ উহানের বাইরে একটি আরডিএনএ ল্যাবে এই ভাইরাসের জন্ম। এবং ওই গবেষণাগারে মনুষ্যসৃষ্ট অনুজীবের মধ্যে এটি চারশতম।”

বইয়ে ‘উহান-৪০০’ কে কুনজ বর্ণনা করেছেন ‘এক দশকের মধ্যে চীনের সবচেয়ে গুরুতর আর ভয়ঙ্কর অস্ত্র’ হিসেবে।

এই বইয়ের ‘উহান-৪০০’ ভাইরাস মানুষের শরীরে সুপ্ত থাকতে পারে মোটে চার ঘণ্টা। কিন্তু ভাইরাস শরীরে ঢুকলে কভিড-১৯ রোগে মানুষ আক্রান্ত হতে পারে এক থেকে ১৪ দিনের মধ্যে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-ডব্লিউএইচও বলছে, সাধারণত পাঁচ দিনের মধ্যেই এই রোগের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। উহান-৪০০ আক্রান্ত হলে মানুষের মৃত্যুর সম্ভাবনা শতভাগ বলা আছে কুনজের বইয়ে।

“একবার আক্রান্ত হলে ২৪ ঘণ্টার বেশি কেউ বাঁচে না। বেশিরভাগই বারো ঘণ্টায় মধ্যে মারা যায়।” তবে কভিড-১৯ আক্রান্তদের মধ্যে এখন পর্যন্ত মৃত্যু হার ৩.৪ শতাংশের মতো বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে।

রয়টার্সের অনুসন্ধানে দেখা যায়, উহান-৪০০ আর কভিড-১৯ রোগের উপসর্গও একেবারে আলাদা। কুনজের কাল্পনিক এই ভাইরাস মস্তিষ্কের কোষ খেয়ে ফেলে।

“যাকে এই রোগে ধরে তার হৃদস্পন্দন, শরীরের আর সব অংশের ক্রিয়া আর শ্বাস-প্রশ্বাস একেবারে থেমে যায়।”

বিপরীতে নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট হয়।সংক্রমণ মৃদু হলে ঠাণ্ডাজনিত লক্ষণগুলো প্রকট হয়। অবস্থা গুরুতর হলে নিউমোনিয়া, শ্বাসতন্ত্রের জটিলতা ও কিডনি অকার্যকর হয়ে মৃত্যু হতে পারে।

বইয়ে কাল্পনিক উহান-৪০০ ভাইরাসকে ইবোলার চেয়ে ভয়াবহ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে বাস্তবে কভিড-১৯ ইবোলার চেয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ।  

ডব্লিউএইচও বলছে, ইবোলায় গড় মৃত্যুর হার ৫০ শতাংশের মতো। এর আগে ইবোলা প্রাদুর্ভাবে মৃত্যুর হার ক্ষেত্র বিশেষে ২৫ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্তও ছিল। সেখানে নতুন করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হার ইবোলার চেয়ে অনেক অনেক কম।

রয়টার্স বলছে, দ্য আইজ অফ ডার্কনেস-এর প্রথম মুদ্রণে ডিন কুনজের এই ভাইরাসের নাম ‘উহান-৪০০ ছিল’ না। বরং সেখানে এই ভাইরাসের নাম ছিল রাশিয়ার একটি শহরের নামে ‘গোরকি-৪০০’।

সেখানে বলা হয়, ‘গোরকি-৪০০ ভাইরাসের’ জন্ম ছিল রাশিয়ার ওই শহরটির বাইরের এক পরীক্ষাগারে। একে সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ভয়ঙ্কর জৈব অস্ত্রও’ বলা হয়েছিল।

গুগলে খোঁজ চালিয়ে বইটির ১৯৮১ সালে ছাপা সংস্করণ থেকে এই তথ্য উদ্ধার করেছে রয়টার্স। ওই মুদ্রণে ‘গোরকি-৪০০’ থাকলেও ‘উহান-৪০০’ বলে কোনো ভাইরাস লেখা নেই।

সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের (এসসিএমপি) বরাতে রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, ভাইরাসের নাম বদল করা হয়েছিল ১৯৮৯ সালে বইটির পুনঃমুদ্রণের সময়।

যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধ ছিল তখন সমাপ্তির পথে। আর এরপর ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তিও ঘটে।

পুনঃমুদ্রণের সময়েই ‘গোরকি-৪০০’ হয়ে যায় ‘উহান-৪০০’ ভাইরাস। কয়েক দিন ধরে ৪০ বছর আগে লেখা বইটি এত আলোচনার জন্ম দিলেও এ নিয়ে এখন পর্যন্ত কোথাও কোনো মন্তব্য নেই কুনজের।

এসব নিয়ে কথা বলার জন্য ডিন কুনজের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোনো সাড়া মেলেনি বলে রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তবে লেখকের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে বলা হয়েছে, আগামী ১ এপ্রিল সন্ধ্যায় লস অ্যাঞ্জেলসে পাঠকের সাথে ‘লাইভ টক’-এ অংশ নেবেন তিনি।

কে এই ডিন কুনজ? জটিল মনস্তত্ত্ব, থ্রিলার, অদ্ভুতুরে গল্প-উপন্যাস লিখে সাড়া ফেলেন যুক্তরাষ্ট্রের লেখক ডিন কুনজ। আসল নাম ছাড়াও বেশ কয়েকটি ছদ্মনামে লিখেছেন তিনি। দ্য আইজ অফ ডার্কনেস বইটির প্রথম মুদ্রণও তিনি ‘লেই নিকোলস’ ছদ্মনামে প্রকাশ করেন। পরের মুদ্রণের সময় ডিন কুনজ তার আসল নামেই বইটি ছাপান।

নিজের ওয়েবসাইটে লেখক লিখেছেন, তার ১৪টি উপন্যাস নিউ ইয়র্ক টাইমসের ‘বেস্টসেলার’ বইয়ের তালিকায় শীর্ষস্থানে জায়গা করে নিয়েছে। 

জাপান ও সুইডেনেও ডিন কুনজের বইয়ের প্রচুর কাটতি রয়েছে। তার বেস্টসেলার বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ফ্রম দ্য কর্নার অফ হিজ আই, মিডনাইট, কোল্ড ফায়ার, দ্য ব্যাড প্লেস, ড্রাগন টিয়ার্স, হোয়াট দ্য নাইট নোজ, ৭৭ শ্যাডো স্ট্রিট।