মাসুদ রানা সিরিজ নিজেদের দাবি দুই লেখকের
'মাসুদ রানা'র লেখক হিসাবে কাজী আনোয়ার হোসেনের নাম প্রকাশিত হলেও, দুইজন লেখক দাবি করেছেন, অনেক বই আসলে তারা লিখেছেন, যা আনোয়ার হোসেনের নামে প্রকাশিত হয়েছে। সত্ত্ব দাবি করে তারা কপিরাইট রেজিস্টার অফিসে অভিযোগও করেছেন।
তবে সেবা প্রকাশনী এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলছে, কেউ কেউ 'ঘোস্ট রাইটার' হিসাবে কখনো কখনো এই সিরিজের কোন কোন পর্ব লিখলেও, তারা কাজী আনোয়ার হোসেনের তত্ত্বাবধানে আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে লিখেছেন, যেখানে সত্ত্ব কোন দাবি করার সুযোগ নেই। দুইজন লেখকের অভিযোগ পাওয়ার পর বিষয়টি যাচাই করে দেখতে শুরু করেছে বাংলাদেশের কপিরাইট অফিস।
পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে পেপারব্যাক সিরিজ 'মাসুদ রানা' প্রকাশিত হয়ে আসছে। এ পর্যন্ত এই সিরিজের চারশোর বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে। লেখকদের অভিযোগ, সেবা প্রকাশনীকে একসময় নিয়মিত লেখক হিসাবে লিখতেন ইফতেখার আমিন এবং শেখ আজিজুল হাকিম।
সেখানে তাদের নিজেদের নামে অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে। তবে এই দুইজন লেখক বলছেন, বহুদিন ধরে তারা বিদেশি কাহিনীর অবলম্বনে 'মাসুদ রানা' সিরিজের অনেক বই লিখেছেন, যদিও সেগুলো ছাপা হয়েছে কাজী আনোয়ার হোসেনের নামে। এখন তারা সেসব বইয়ের সত্ত্ব ও রয়্যালটি দাবি করেছেন।
উনিশশো ছেষট্টি সাল থেকে সেবা প্রকাশনীতে লেখক হিসাবে কাজ করেছেন শেখ আবদুল হাকিম। তিনি কপিরাইট অফিসে অভিযোগ করেছেন, এ পর্যন্ত কুয়াশা সিরিজ ও মাসুদ রানা সিরিজের ২৬০টি বই তিনি লিখেছেন, যা কাজী আনোয়ার হোসেনের নামে ছাপা হয়েছে। এর অনেকগুলো বই এখন পুনর্মুদ্রণ করা হচ্ছে। কিন্তু লেখক হিসাবে তিনি কোন রয়্যালটি পাচ্ছেন না।
হাকিম বলেন, তখন পাণ্ডুলিপি দেয়ার পর এককালীন একটা টাকা দেয়া হতো। এরপর মৌখিকভাবে কথা হয়েছিল যে, যেসব বইয়ের সত্ত্ব ছেড়ে দেয়া হয়েছিল, সেগুলোর জন্য চারবছর পর্যন্ত রয়্যালটি পাবো। আর যেগুলোর সত্ত্ব ছাড়া হবে না, সেগুলোর জন্য আজীবন রয়্যালটি পাওয়া যাবে।
কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায়, এসব বই একাধিকবার পুনর্মুদ্রণ করা হচ্ছে, কিন্তু আমাকে কোন টাকা দেয়া হচ্ছে না। সেটা যখন চাইলাম, আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করা হলো। এমনকি আমাকে দুঃখজনকভাবে সেবা থেকে বিদায় নিতে হলো।
তাই এখন তিনি এসব বইয়ের সত্ত্ব দাবি করেছেন এবং মুদ্রণের জন্য লেখক হিসাবে রয়্যালটি দাবি করেছেন। তবে তিনি বলছেন, লেখা, সত্ত্ব এবং রয়্যালটির বিষয়ে লিখিতভাবে কোন চুক্তি হয়নি। মৌখিকভাবে এসব ঠিক করা হয়েছিল, যা দীর্ঘদিন পর্যন্ত অনুসরণ করা হয়েছে। সেবার রেজিস্টারে স্বাক্ষর করে তিনি অর্থ গ্রহণ করেছেন।
শেখ আবদুল হাকিম বলছেন, যখন আমি দেখলাম যে, একেকটি বই অনেকবার পুনর্মুদ্রণ করা হচ্ছে, কিন্তু আমাদের কোন রয়্যালটি দেয়া হচ্ছে না, তখন আমি দাবি তুললাম। এরপরেই আমাদের টাকা দেয়া বন্ধ হয়ে গেল। ফলে আমি বাধ্য হয়ে কপিরাইট অফিসে অভিযোগ দিয়েছি।
১৯৯২ সাল থেকে সেবা প্রকাশনীতে লিখতে শুরু করেন আরেকজন লেখক ইফতেখার আমিন। ইফতেখার আমিন বলছেন, ''আমি প্রথম এসব বই পুনর্মুদ্রণের রয়্যালটি দাবি করার পর সেবার সঙ্গে সমস্যা তৈরি হয়। ২০১০ সালে কপিরাইট অফিসে অভিযোগ করেছিলাম যে এসব বই আমি লিখেছি। তখন নানা কারণে সেই মামলার রায় আমি পাইনি।''
কিন্তু এখন আমার কাছে প্রমাণ আছে যে, এসব বই আমি লিখেছি। আনোয়ার সাহেব পত্রপত্রিকায় দেয়া দুই-একটি সাক্ষাৎকারেও বলেছেন যে, তিনি এখন আর মাসুদ রানা লেখেন না, তার পক্ষে যারা লেখেন বলে বলেছেন, সেখানে আমার নামও আছে।''
গতমাসে, ১১ই জুলাই তিনি প্রমাণের কাগজপত্র সহ তিনি কপিরাইট অফিসে একটি অভিযোগ পত্র জমা দিয়েছেন। সেখানে তিনি দাবি করেছেন, মাসুদ রানা সিরিজে তার লেখা ৫৮টি বই কাজী আনোয়ার হোসেনের নামে ছাপা হয়েছে। অভিযোগে তিনি সেসব বইয়ের লেখক সত্ত্ব এবং লভ্যাংশ দাবি করেছেন।
শেখ আবদুল হাকিম বলছেন, আমি আর্থিক কারণে এসব বই তাকে (কাজী আনোয়ার হোসেন) নামে লেখার অনুমতি দিয়েছি। কারণ তখন আমার টাকার দরকার ছিল।
আর ইংরেজি কাহিনীর নকল করে বাংলা এসব বই আমার নামে ছাপা হোক, সেটাও আমি কখনো চাইনি। কাউকে এসব বলতেও খারাপ লাগতো, তাই মুখ বুজে থেকেছি। তবে অনেকেই বিষয়টি জানতো।
প্রথম দিকে একেকটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি দিলে পাঁচশো টাকা পাওয়া যেতো। পরে সেটা দশ হাজার পর্যন্ত হয়। সুতরাং কপিরাইট নিয়ে ভাবিনি। যতদিন তারা নিয়মিত টাকা দিয়ে গেছেন, ততদিন আমি আপত্তিও করিনি। কিন্তু যখন দেখছি যে, বই আবার ছাপা হচ্ছে, কিন্তু আমাকে কোন টাকা দেয়া হচ্ছে না, তখন আমি অভিযোগ করতে বাধ্য হয়েছি।
ইফতেখার আমিন বলছেন, স্বাধীনতার আগে থেকে সেবা প্রকাশনীতে এই প্রাকটিসটা চলে আসছিল। ফলে আমি শুধু সেখানে যোগ হয়েছি। তখন আনোয়ার সাহেব বলতেন, তোমাদের নামে ছাপা হলে তো পাঁচশো কপির বেশি বিক্রি হবে না, আমার নামে ছাপা হলে দুই হাজার কপি বিক্রি হবে। তাই আমরা সেখানে সত্ত্বও দাবি করতে যাইনি।
কিন্তু যখন দেখলাম আমাদের লেখা বই বারবার ছাপা হচ্ছে, কিন্তু তার কোন আর্থিক সুবিধা আমরা পাচ্ছি না, তখন আমরা আইনি ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হলাম।
তিনি বলছেন, ''বিষয়টি যেহেতু আইনগত একটি ব্যাপারে পরিণত হয়েছে, তাই আমরা এখন এ বিষয়ে কোন কথা বলতে চাই না। তবে আমাদের কাছে নানা প্রমাণ আছে, সেসব বক্তব্য আমরা কপিরাইট অফিসে দেবো। তখন আপনারাও আমাদের বক্তব্য জানতে পারবেন। তাই এখন আর এই বিষয়ে আমরা কথা বলতে চাই না।''
তবে তিনি বলছেন, '' যারা সম্পূর্ণ কাজী আনোয়ার হোসেনের তত্ত্বাবধানে নিখেছেন, ঘোস্ট রাইটার হিসাবে লিখেছেন, লেখার বদলে টাকা নিয়েছেন, সব সত্ত্ব দিয়ে দিয়েছেন, এখন এতদিন পরে এসে আপনি কপিরাইট দাবি করবেন, সেটা তো হয় না। তবে আমরা শেষপর্যন্ত আইনের ওপরেই নির্ভর করতে চাই।''
কিন্তু লেখকদের কপিরাইট প্রমাণিত হলে আপনারা তখন কি করবেন? জানতে চাইলে মি. হোসেন বলছেন, ''কপিরাইট অফিসের পরে কপিরাইট বোর্ড আছে, আদালতের ব্যাপার আছে। দেখা যাক, আইনে শেষ পর্যন্ত কি দাঁড়ায়?
বাংলাদেশের রেজিস্টার অফ কপিরাইটস জাফর আর চৌধুরী বলছেন, একজনের লেখা বই আরেকজনের নামে ছাপা হবে, নৈতিকতার দিক থেকে বিষয়টা ঠিক নয়। কপিরাইট আইনও সেটাকে অনুমোদন দেয় না, কারণ যার মেধা বা যিনি লিখেছেন, লেখার সত্ত্বও তার।
আরেকটি বিষয় থাকে, সেটা হলো অর্থনৈতিক কপিরাইট, অর্থাৎ বইটা প্রকাশ করার বা ছাপানোর অধিকার, যেটা প্রকাশকরা পেয়ে থাকেন।
''তবে এখানে যে বিষয়টা ঘটেছে, তা হলো দুইজন লেখক দাবি করেছেন যে বইগুলো তারা লিখেছেন, কিন্তু ছাপা হয়েছে আরেকজনের নামে। এতদিন তারা সে নিয়ে কোন আপত্তিও তোলেননি। এখন যেহেতু আপত্তি তুলছেন, আইন অনুযায়ী, তাদেরকে এখন প্রমাণ করতে হবে যে, আসলে তিনি বা তারা লেখাটি লিখেছেন।'' বলছেন মি. চৌধুরী।
চিঠিপত্র, চুক্তি, রসিদ, অন্যান্য নথিপত্র, সাক্ষাৎকার ইত্যাদি এখানে প্রমাণ হিসাবে গণ্য করা হতে পারে।
তিনি বলছেন, ''এটা যদি প্রমাণিত হয় যে, 'ক' বইটি লিখেছে, তাহলে কপিরাইট 'ক'য়ের। কিন্তু আপনি যদি তার বদলে বেতন বা অন্য কিছু নিয়ে থাকেন বা ভিন্ন কোন চুক্তি করে থাকেন, তাহলে সেটার প্রকাশনা বা রয়্যালটি নিয়ে আইনের বিষয় থাকতে পারে, কিন্তু কপিরাইট তারই থাকবে, যিনি সেটার স্রষ্টা।''
'মাসুদ রানা' সিরিজের বইগুলোয় দুইজন লেখক নিজেরা লিখেছেন বলে যে দাবি করেছেন, সে প্রসঙ্গে তিনি বলছেন, ''সচরাচর এরকম ঘটনা দেখা যায় না। তবে বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রমাণ করতে পারলে লেখক তার সত্ত্ব বুঝে পাবেন।''
আইন অনুযায়ী, কপিরাইট পেলে তখন রয়্যালটির প্রশ্ন আসবে। সেটা দুই পক্ষ সমঝোতার মাধ্যমে সমাধান না করতে পারলে কপিরাইট বোর্ডে আপিল করতে পারেন। সেখানেও সন্তুষ্ট না হলে আদালতে মামলা করার সুযোগও রয়েছে।
[বিবিসি বাংলা]