বুক রিভিউ: অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানের ‘প্রার্থনা’
শিক্ষাগুরু অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান স্যারের সঙ্গে পরিচয় বেশি দিনের নয়। সবমিলিয়ে দুই আড়াই বছর। এই স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তিনি আমার শিক্ষাগুরু আসনে আসীন হয়েছেন। এটা স্যারের স্বাভাবিক যোগ্যতা অথবা প্রকৃতি প্রদত্ত সরল গুণ বা স্পৃহা যা এখন অনেক শিক্ষকের মাঝেই বিরল।
তাঁর শিক্ষকতা জীবনের প্রধান শক্তিই হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রশ্ন করতে শেখানো বা ভিন্ন চোখে বিষয়বস্তুকে দেখে প্রশ্ন করার পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত করানো। এই কাজে তিনি সফল হয়েছেন। অথবা বলতে পারেন শিক্ষকতা ব্যবসায়, সাহিত্য ব্যবসায়, আংশিক আইন ব্যবসায় সাফল্য লাভ করে যাচ্ছেন।
শ্রেণীকক্ষে এবং শ্রেণীকক্ষের বাহিরে নির্মোহ জ্ঞান বিতরণে তাই তাঁর ক্লান্তি অবসাদ নেই। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানকে তাঁর শিক্ষার্থীরা যে কোন সময়ে কাছে পান। অনেক শিক্ষার্থীরা যেখানে শ্রেণীকক্ষের মাঝেই তাদের প্রিয়/অপ্রিয় শিক্ষকদের কাছে পেয়ে থাকেন, অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান সেখানে অনন্য নজির রেখে যাচ্ছেন। শ্রেণীকক্ষ ছাপিয়ে তাকে সভা, সেমিনারে, সম্মেলনে সমানভাবে পাওয়া যায়। এটাই আমাদের পরম পাওয়া।
চলতি বছর ২০১৯ সালে মহান একুশে গ্রন্থমেলার মাঝপথে মধুপোক প্রকাশনী থেকে জাতীয় সাহিত্য ২ শিরোনামে ‘প্রার্থনা’ প্রকাশিত হয়েছে। এর নয় বছর আগে ২০১০ সালে এই সিরিজের ‘আহমদ ছফা সঞ্জীবনী’ শিরোনামে জাতীয় সাহিত্য প্রথম খন্ড প্রকাশিত হয়েছিল।
‘প্রার্থনা’ গ্রন্থটি আমাকে আশির্বাদ হিসেবে যে দিন হস্তান্তর করেছেন, সেই ক্ষণে তিনি শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক অনুবাদকৃত ফরাসি চিন্তাবিদ জোজেফ জুবেয়ারের (Joseph Joubert, ১৭৫৪-১৮২৪) উক্তি লিখে দেন।
জুবেয়ার বলেছেন, ‘যাহারা অর্ধেক বুঝিয়াই সন্তুষ্ট হয় তাহারা অর্ধেক প্রকাশ করিয়াই খুশি থাকে; এমনি করিয়াই দ্রুত রচনার উৎপত্তি।’ এই লেখার ক্ষেত্রে তেমনটা তাড়াহুড়া ছিল না বটে, কিন্তু গ্রন্থটি পড়ে মনোভাব প্রকাশের ইচ্ছা প্রবল ছিল। একইসাথে এই লেখায় রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’র বাণীর মত ‘তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান’- এই ভাবের উপস্থিতি প্রত্যক্ষমান।
‘প্রার্থনা’ গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন আবুল খায়ের মোহাম্মাদ আতিকুজ্জামান; গুনগত কাজের ক্ষেত্রে যার জুড়ি নেই। অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানের ‘প্রার্থনা’ কোন আত্মজীবনীমূলক কোন গ্রন্থ নয়; সেটি গ্রন্থের সূচনাতে লেখক উল্লেখ করেছেন।
গ্রন্থটিতে স্থান পেয়েছে ১৯৯৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ‘কয়েকজন মহাত্মা’কে নিয়ে লেখা অধ্যাপক খানের মূল্যায়ন। লেখকের মতে উল্লেখিত মহাত্মজনেরা ‘ইতিহাসের বিশেষ ক্লান্তিকালের সন্তান।’ তাঁর লেখায় যেসব মহাত্মাজনের নাম এসেছে তাদের মধ্যে প্রেম ও দ্রোহের কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, মমতাজুর রহমান তরফদার, জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুল্লাহ মোহাম্মাদ সাকী, অকাল প্রয়াত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ, প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা আবুল কালাম আজাদ, ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের পুরোধা কমরেড মুজফফর আহমদ, ‘ওরিয়েন্টালিজম’ নামে খ্যাত এডোয়ার্ড সায়িদ, কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিডেল কাস্ত্রো, বাংলাদেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত, কবি মোহন রায়হান, অভীক ওসমান, অনিকেত শামীম, বিধান রিবেরুর নাম অন্যতম।
উপরোক্ত মহাত্মাজনদের নামে তিনি কি কি করেছেন? গবেষণার দৃষ্টিভঙ্গীতে আলোচনার সূত্রপাত করেছেন। শব্দের পর শব্দ দিয়ে লিখেছেন কিছুটা স্মৃতিকথার আঙ্গিকে। তবে সম্পূর্ণটাই স্মৃতিকথা নয়। উপস্থিত মহাত্মাজনদের স্মরণ করে লেখক সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, সাহিত্য নিয়ে দিলখোলা আলোচনা করেছেন। বলেছেন তাদের সুকীর্তির কথা; আর্থ-সামাজিক দিক থেকে তাদের অবদানের ফিরিস্তি তুলে এনেছেন গবেষণার আঙ্গিকে।
প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সমালোচনাও করেছেন। এক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ছাড় দেননি তাঁর বন্ধু এবং শিক্ষক তারেক মাসুদের বেলায়ও। ‘মহাপ্রয়াণের পর মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান’ নামক আলোচনায় একটি বিষয় যেমন উলেখ করা যায় সেটি হল মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান প্রধান বিচারপতি পদে আসীন থেকেও বাংলা ভাষায় আদালতের রায় দেবার দৃষ্টটা দেখাতে পারেননি।
যদি করতেন তাহলে হয়তো ভাষা শহীদের আত্মত্যাগের প্রতি কিছুটা হলেও সুবিচার করা যেত। তবে লেখক লিখেছেন, ‘বিচারপতি হাবিবুর রহমান বাংলা নিজে যতটা পারেন ভালই লিখেছেন।’ তাই সে কারণেই হয়তো বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা, ইতিহাস চর্চা, কিংবা রবীন্দ্র গবেষণাতে প্রাক্তন বিচারপতির অবদান অনস্বীকার্য।
অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানের পূর্ব প্রকাশিত অধিকাংশ লেখাই বাংলায় পাওয়া যায়। আলোচ্য গ্রন্থটিও শুধু বাংলায় নয়; অন্যগুলোর মত সাধু ভাষায় লিখেছেন। সাধু ভাষায় সবগুলো লেখায় আমাদের কাছে এসেছে বটে কিন্তু সেটি কোন সমস্যা নয়। আমার মনে হয় সাধু ভাষায় লিখে অধ্যাপক খান ভাষার সংগঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন।
‘প্রার্থনা’ নিছক প্রবন্ধ সঙ্কলন বা চিরাচরিত কথামালার ফুলঝুরি নয়। অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানের আলোচনা এবং জিজ্ঞাসা পদ্ধতির সাথে যাদের পরিচিত হবার সুযোগ হয় নাই, তাদের জন্য এই গ্রন্থ নতুন দিগন্তের সূচনা করবে। গ্রন্থের ভাঁজে ভাঁজে পাঠক জানতে পারবে অধ্যাপক খান কতটা যত্ন নিয়ে বাংলাদেশের কৃতকর্মাদের উপস্থাপনের পাশাপাশি বিশ্ব ইতিহাসের অগ্রণীদের তুলে এনেছেন। এই গ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে তিনি নিজেও হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের ইতিহাসের সন্তান।
লেখক: আলী নিয়ামত,
প্রভাষক, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি