প্রিয়জনের অনুভূতিও সংক্রামক
নিমাই ভট্টাচার্য তার ‘তোমাকে’ উপন্যাসে বার বার প্রিয়জনের অনুভূতি হৃদয়ের উপলব্ধিতে ছোটো ছোটো ঘটনার সমাহার ঘটিয়েছেন। তিনি সাংবাদিকতার মাধ্যমে তার কর্মজীবনের সূচনা করলেও ভাগ্যের বিড়ম্বনার শিকার হন। কিন্তু সাহিত্য চিন্তা তাকে দেখিয়েছিলো সাফল্যের মুখ। তার লেখা উপন্যাসগুলোতে বিষয়গত বৈচিত্র্য থাকলেও বিষয়ের বিশ্লেষণের ব্যাপারে অনেকটা প্রচলিত কিছু ধারণার আভাস পাওয়া যায়।
উপন্যাসের সূচনায় লেখক ‘সাগর চট্টোপাধ্যায়’ এর সাথে পাঠকের পরিচয় করায় খুব অদ্ভূতভাবে। নিঃসঙ্গতায় ভরপুর যার জীবন, সোসিও ইকনমিক সার্ভের কাজে ডেরাডুনে এসে হঠাৎ যেনো নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে প্ল্যানিং কমিশনের এই কর্মকর্তা। শিলচরে মামা মামির অসীম ভালোবাসায় বড় হয়ে উঠা সাগর সবাইকে হারিয়ে আজ নিঃস্ব তবুও তার মনে সবসময় দুটি নাম জ্বলজ্বল করছে- ‘মাগো’ আর ‘মানসী’।
ডেরাডুনে মিসেস রায় এর আদর যত্ন সাগরকে বারবার তার ‘মাগোর’ স্মৃতিই মনে করিয়ে দেয়। মানসী এই উপন্যাসে এক অদ্ভূত আবছায়ার নাম। ভূতত্ত্ববিদ ডক্টর এস.পি সরকারের মেয়ে বুলার মধ্যে যেনো সে মানসীকে দেখতে পায়। ডেরাডুনে এসে দুই পরিবারের অকৃত্রিম ভালোবাসা আর আন্তরিকতায় সাগরের মনে হয়েছিলো এসেছে তার ভালোবাসা পাবার মৌসুম। খুব কম সময়ের ব্যবধানে বুলার সাথে অনেকটাই ঘনিষ্ঠতার সত্যিই কি কোনো পরিণতি ছিলো?
ছয়মাসের মধ্যেই হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পর যখন সার্ভের কাজ শেষ হল, ডেরাডুন এক্সপ্রেসে সাগর ছুটলো নতুন জায়গায় তখনও কি ভেবেছিলাম কাহিনীর শেষটা এমন হবে! হঠাৎ পটভূমিতে আগমন ঘটে গাইনী ডাক্তার ‘চিত্রলেখা রায়’ এর। সে যেনো সাগর চট্টোপাধ্যায়ের চাইতে আরো বেশি নিঃসঙ্গ আরো বেশি দুঃখী। কলকাতা থেকে ঢেংকানলে পোস্টিং নিয়ে যাচ্ছে চিত্রলেখা, কিন্তু সেখানে গেলেই যেনো সে হাফ ছেড়ে বাঁচে। কলকাতার অতীত তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।
স্পষ্ট প্রতারণার স্বীকার তবুও সে তা মানতে নারাজ! সুনীলের সাথে সুন্দর সময়টা অল্প হলেও কখনো ঘৃণার কথা ভাবতে পারেনি চিত্রলেখা। ভালোবাসা হয়তো এমনি হয়! তাইতো সব ছেড়ে একবুক অভিমান নিয়ে ঢেংকানলে এসে হাসপাতালে রোগীর সেবা শুরু করে। সাগরবাবুর সাথে ঢেংকানলে পরিচয়ও হয় এক সংকটময় মুহূর্তে। প্যারাটাইফয়েডের দিনগুলোতে চিত্রলেখা না থাকলে হয়তো জীবনের ইতি ঘটাতে হতো তাকে।
সময়টা খুব অল্প কিন্তু এরপর এখানেও যখন সাগরের সার্ভের কাজ শেষ হয়ে যায় সে কি নতুন জায়গা ভুবনেশ্বরে যেতে পেরেছিলো? সাগরের মনের সেই অবচেতনের মানসী, যে পুরো উপন্যাস জুড়ে থাকলো ধোয়াশায় উপন্যাসের শেষে তার পরিচয় স্পষ্ট না হলেও পরিণতিটা জানা যায়। মানসীকে সাগর চিত্রলেখার মধ্যেও খুঁজে পায়, খুঁজে পেয়েছিলো বুলার মধ্যেও। চিত্রলেখা কি আগেই বুঝেছিলো কিছু? তা না হলে আবার চোখে রঙিন নেশার আশংকায় কাতর ছিলো কেনো? বুলাও তো জানতো মা বাবার অবাধ্য সে হতে পারবে না, তবুও পেয়েছিলো অনাগত বসন্তের ইঙ্গিত, তখন তো এতোকিছু ভাবেনি সে! বুলা বা চিত্রলেখা কে ধরা দিয়েছিল সাগরের কাছে? কাউকে কি সে গ্রহণ করতে পেরেছিলো?
বইটি পড়ে মনে হচ্ছিলো কারো আত্নজীবনী পড়ছি। আত্নজীবনী বললে ভুল হবে, মনে হচ্ছিলো আলাদাভাবে তিনজন মানুষের স্বীকারোক্তি পড়ছি। তারা যেনো অকপটে নিজের কাছেই স্বীকার করছে নিজের অতীত জীবনের কথা। হয়তো নিজেরাও মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় নি৷ যা ঘটেছে তা তাদের কারো জন্যই মিথ্যে হয়ে যায়নি। ভালো লেগেছে চরিত্রগুলোর মনের স্পষ্টতা, কোথাও কোনো জড়তা ছিলো না। ভালোবাসতে কেউ কার্পণ্য করে নি।
কার্পণ্য করেনি নিজের পরিত্যক্ততা বর্ণনায়। এই উপন্যাসটি লেখকের ‘মেমসাহেবের’ মতো এতো আলোচিত না। বলতে গেলে এই বই নিয়ে কখনো কোনো পর্যালোচনা কোথাও দেখিনি এখন পর্যন্ত। বইটিতে আহামরি ধরনের কিছু না থাকাতে খুব একটা আগ্রহ পাইনি৷ কিন্তু কাহিনীর ধারাবাহিকতায় এগিয়েছি। অনেক কিছুর সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ পেয়েছি।