কবির আত্মবিশ্বাস

কবি আল মাহমুদের একটি মাস্টারপিস বইয়ের রিভিউ

‘কবির আত্মবিশ্বাস’ বইয়ের প্রচ্ছদ এবং রিভিউ লেখক সোহেল রানা (ডানে)
‘কবির আত্মবিশ্বাস’ বইয়ের প্রচ্ছদ এবং রিভিউ লেখক সোহেল রানা (ডানে)  © টিডিসি ফটো

কবির আত্মবিশ্বাস। বইটি মূলত এটি প্রবন্ধ সংকলন। বাংলা সাহিত্য ও সাহিত্যগোত্রের নানা অসঙ্গতি এবং সাহিত্য ও কালচারসহ বেশকিছু বিষয়ে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি কোনরকম রাখঢাক না করেই পাঠকদের কাছে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন আল মাহমুদ। জেলে যাওয়ার পর তার ধর্মবিশ্বাসে যে রূপান্তর ঘটল তারও কারণ ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে তিনি ইহুদিদের সুদের কারবারকে লেখায় টেনে এনেছেন আর বলেছেন, ‘আরবের বিতাড়িত ইহুদি পুঁজিই শেষ পর্যন্ত ধনতন্ত্রের উদগাতা।’

আল মাহমুদ মোটাদাগে আমাদের এখানকার বাংলা সাহিত্য যে আগ্রাসনের শিকার সেটা তুলে ধরেছেন নানা উদাহরণ ও ব্যাখ্যার মাধ্যমে। এখানকার লেখকদের কলকাতা প্রেম ও ঢাকাকেন্দ্রিক সাহিত্যের প্রতি ওপার বাংলার যে ঈর্ষা ও হীনমন্যতা আছে সেসবের শানে নুযুল সবিস্তারে তুলে এনেছেন তিনি।

কবির মতে, রাষ্ট্রভাষা বাংলার কোন শত্রু না থাকলেও সাহিত্যভাষা বাংলার শত্রুর অভাব নাই। সাহিত্যভাষা বাংলার প্রধান শত্রু কারা সেটি উল্লেখ করতেও তিনি দ্বিধা করেননি। কবি খুব আক্ষেপ করেই বলেছেন, ‘আমাদের সাহিত্যের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো, তরুণ লেখকগোষ্ঠীর কলকাতার স্বীকৃতির জন্য ভিখিরিপনা। আর এই দুরবস্থার জন্য তিনি দায়ী করেছেন ৪৭-এ দেশভাগ পরবর্তী সময়ের একদল সাহিত্যিককে, যারা সিন্ডিকেট গড়ে ঢাকায় এসে সাহিত্য ও সংবাদপত্রের সমস্ত মাধ্যমগুলো দখল করে বসেছিলেন এবং উদীয়মান ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদী পঞ্চাশের দশকের কবি- সাহিত্যিকদের আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আত্মপ্রকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।

‘এরা যখন দেখলেন দেশবিভাগের বীর, লেখক কবিগণ তাদের গ্রাহ্যের মধ্যেই আনতে চান না তখন তারা কলকাতার প্রগতিবাদী পত্রিকাগুলোর শরণাপন্ন হন। এদের মধ্যে যারা মার্কসবাদ বিরোধী ছিলেন তাদের জন্য ‘কবিতা’ পত্রিকার দরজা খুলে দিলেন বুদ্ধদেব বসু। এভাবেই বাংলাদেশের লেখকদের কলকাতাপ্রীতি শুরু’; যে দলে ছিলেন কবি শামসুর রাহমান এমনকি আল মাহমুদ নিজেও।

আল মাহমুদের মতে, কলকাতা ভাবে- কলকাতা ছাড়া সারা উপমহাদেশে আর কেউ কিছু লিখতে পারেনা। জার্মান কবি ও কথাশিল্পী গুন্টার গ্রাস একবার কলকাতা হয়ে ঢাকা এলে বাংলাদেশের কবিরা তার কলকাতা সফরের অভিজ্ঞতা জানতে চায়। গুন্টার গ্রাস বলেছিলেন, ‘কলকাতা হলো প্যারিসের মত, প্যারিসের লেখক- শিল্পীরা মনে করেন তাদের শহরটির বাইরে বাকী ইউরোপে নাকি কেউ তেমন বড় কিছু লিখতেই পারেনা’। শুধু কি সাহিত্য এমনকি কবিতা আবৃত্তিতেও কলকাতা বিশেষ করে আকাশবাণীর একটা আধিপত্য তৈরি হয়েছে। তবে এখানে তিনি আবৃত্তিকার প্রয়াত অভিনেতা গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ হাসান ইমাম, ফতেহ লোহানি, কবি ফররুখ আহমদ আর শাহাদাৎ হোসেনের অবদান কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন।

বইয়ে আল মাহমুদ লেখেন, ৫০ এর দশকে কবি শামসুর রাহমানকে ঘিরে একটি সাহিত্য আড্ডা জমে উঠেছিলো বাংলাবাজারের বিউটি রেঁস্তেরায়, যেখানে আল মাহমুদ ছাড়াও ছিলেন ফজল শাহাবুদ্দিন ও শহীদ কাদরি। কবির দাবি, তারাই পঞ্চাশ দশকের আধুনিক রোমান্টিক ধারাটির বিবর্তনকারী।

ফেব্রুয়ারি মাসকে আল মাহমুদ আবিষ্কার করেছেন সাংস্কৃতিক মাস্তানির মাস হিসেবে। কবির মতে, ‘এ মাসে বাংলাদেশের মানুষের মনে মিথ্যা আবেগের বান ডাকে। রাজনৈতিক মিথ্যা, সাংস্কৃতিক মিথ্যা ও ইতিহাসকে উল্টে ফেলার মত যতরকম জারিজুরি তথাকথিত বামপন্থী বুদ্ধিজীবী এবং প্রগতিশীল ছাত্র ও কবি- সাহিতি্যকদের জানা আছে সেসবের বাৎসরিক ঝালাইয়ের কাজটা ইংরেজি সনের এ মাসটায় সারতে হয়। এ মাসেই সাইনবোর্ড উল্টে যায়। যাদের ছেলেমেয়েরা ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে বাধাধরা কয়েকটি স্কুলে এবং বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে এটা তাদের পারিবারিক পাঞ্জাবি পরার মাস।’

এছাড়া ৫২ এর ভাষা আন্দোলন,মার্কসবাদ, প্রগতিশীলতা এবং বাংলাদেশে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা কবিদের (রাজনৈতিক কবি) সম্পর্কে অপ্রিয় কিছু তথ্য স্থান পেয়েছে ‘কবির আত্মবিশ্বাসে।’


সর্বশেষ সংবাদ