লেখক সত্তার সব গুণ নিংড়ে বইটি লিখেছিলেন হুমায়ূন
বইয়ের নাম ‘জোছনা ও জননীর গল্প’। লেখক জনপ্রিয় সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। বইটি অন্যপ্রকাশ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত। পাঠকদের ভাষ্য, মুক্তিযুদ্ধের উপর যত উপন্যাস লেখা হয়েছে; তার মধ্যে অন্যতম ‘জোছনা ও জননীর গল্প’। এটি কোন ইতিহাসের বই না; কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ এটা এমন একটা উপন্যাস রচনা করেছেন যা ইতিহাসের আদলে গড়া উপন্যাস। লিখেছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী- আনিকা তাসনিম (সুপ্তি)
প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তখন ২৩ বছরের যুবক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সুন্দর সময় কাটাচ্ছেন। এমনই সময় শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। সেই সময়ে তিনি নিজের অবস্থা বর্ণনা করেছেন এভাবে- ‘ছায়াঘেরা শান্ত দিঘির একটা মাছকে হঠাৎ যেন নিয়ে যাওয়া হলো চৈত্রের দাবদাহে ঝলসে যাওয়া স্থলভূমিতে’। তাঁর ভাষ্যমতে, তিনি দেশমাতার ঋণ শোধ করেছেন স্বাধীনতার উপর ভিত্তি করে ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ উপন্যাসটি রচনার মাধ্যমে।
ফেব্রুয়ারী ২০০৪ সালে একুশে গ্রন্থমেলায় বইটি প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে এই উপন্যাস ছিলো তার কাছে কঠিন সাধনা। ৫২৮ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটি লিখতে উনি মোট ৯৩টি বইয়ের সাহায্য নিয়েছেন, পড়েছেন ১৫ খন্ড বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দলিলের ৭টি খন্ড।
‘জোছনা ও জননীর গল্প’ স্বাধীনতা যুদ্ধের উপন্যাস হলেও তিনি উপন্যাসটির সূচনা করেছেন গতানুগতিক উপন্যাসের মতোই। এরপর ধীরে ধীরে তুলে ধরেছেন মুক্তিযুদ্ধের ক্রমিক ইতিহাস। নয় মাসের ভয়াবহতা, গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, রাজাকার দালালী, ভারতের শরণার্থী শিবির, শেখ মুজিবের বন্দিজীবন, ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণ, বুদ্ধিজীবী হত্যা, গেরিলা অভিযান, ভারতীয় মিত্রবাহিনী, শক্তিশালী দেশগুলোর ভূমিকা- কোনো কিছুই বাদ পড়েনি এই বইয়ে। ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র’ থেকে বেশ কজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা হুবহু দেওয়া আছে এই উপন্যাসে; যার মাধ্যমে নিপুণভাবে নয় মাসের ভয়াবহতা উপলব্ধি করা যায়।
উপন্যাসে চরিত্র হিসেবে সেই সময়ের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের অবস্থা দেখানো হয়েছে। হাইস্কুলের আরবী শিক্ষক মাওলানা ইরতাজউদ্দিনের মতো খাঁটি মুসলমান একটা সময় জালেমের শাসনে জুমার নামাজ পড়াতে অস্বীকার করে শহীদ হন। ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরীর মতো আত্মভোলা মানুষ সকল বুদ্ধিজীবীর প্রতীক; যাকে ১৪ই ডিসেম্বর বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হয়।
কবি শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ যুদ্ধের এই সময় মহান সব কবিতা রচনা করেছিলেন। পুলিশ অফিসার মোবারক হোসেনের মৃত্যুর কথা তার পরিবার জানতেও পারেনি। দেশের চরম দুঃসময়ে বিয়ে হয় মরিয়ম-নাইমুলের, যুদ্ধে যায় নাইমুল, মরিয়মের অপেক্ষার আর অবসান হয় না। কবি কলিমুল্লাহ ও পীর সাহেবের মতো ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলানো গিরগিটিরও দেখা মেলে। হিন্দু গৌরাঙ্গের চোখের সামনে তার শিশু কন্যাকে মিলিটারীরা মেরে ফেলে ও স্ত্রীকে ধরে নিয়ে যায়; কিছুদিন পর রাস্তায় পাগল হয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় তাকে।
লেখক ব্যক্তিগত স্মৃতি বর্ণনায় নিজের পিতার কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন- ‘পিরোজপুর মহকুমার সাবডিভিশনাল পুলিশ অফিসার ফয়জুর রহমান আহমেদ যুদ্ধের ঘোষণা শুনে পুলিশদের অস্ত্রভাণ্ডার থেকে দুইশ রাইফেল স্থানীয় জনগণদের দিয়ে দেন যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে। পাকিস্তানি মিলিটারী ৫ই মে তাকে হত্যা করে’। কাদের সিদ্দিকীর মতো অসংখ্য বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় পাওয়া যায়; যাদের সংগ্রামের বর্ণনা রূপকথার কাহিনীকেও হার মানায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার পরিবারের অবস্থার সঠিক বর্ণনা পাওয়া যায়।
এখানেই কাহিনী শেষ নয়। এরপর লেখক সারা বিশ্বের ভূমিকার দিকে নজর দিয়েছেন। তৎকালীন সকল মুসলিম অধ্যুষিত দেশের নিরবতা, ভারতকে দাবিয়ে রাখার কৌশল হিসেবে পাকিস্তান কর্তৃক ভারত আক্রমণ, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানের পক্ষে দেয়া বিবৃতি ও ভারতের প্রতি রাশিয়ার সাহায্য..... সবশেষে রেসকোর্সে জেনারেল নিয়াজীর আত্মসমর্পনের দলিলে দস্তখত।
পৃথিবীর সমস্ত বীভৎস ও নারকীয় হত্যাকাণ্ডগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের হত্যাকাণ্ড নিঃসন্দেহে অন্যতম। কিছু মর্মস্পর্শী বর্ণনা এমন ছিলো যে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলতে হয়। মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত স্ত্রী-কন্যাকে খুঁজতে খুঁজতে অর্ধপাগল শাহেদ যখন বারাসাতের ছোট্ট গ্রামে আসমানী আর রানুকে খুঁজে পায়; সেই শ্বাসরুদ্ধকর জায়গাটি উপন্যাসের সেরা জায়গা মনে হয়েছে।
উপন্যাসের শুরুর দিকে তৎকালীন পরিস্থিতি সাপেক্ষে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে একটি মন্তব্য খুব ভালো লেগেছে- ‘গ্রহকে ঘিরে উপগ্রহ ঘুরপাক খায়। শেখ সাহেব বিশাল গ্রহ। তাকে ঘিরে ঘুরপাক খাওয়া উপগ্রহের সংখ্যাও অনেক। তাদের ডিঙিয়ে শেখ সাহেবের দেখা পাওয়া মুশকিল’। বইটি পড়ে এটাই মনে হচ্ছে যে লেখক নিজের লেখকসত্তার সমস্ত গুণ নিংড়ে বইটি লিখেছেন। উনার গতানুগতিক অন্যান্য বই থেকে এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। হুমায়ূন আহমেদের ভিন্ন লেখকসত্তা উপলব্ধিকরণে পড়তে হবে বইটি।