হাজার টাকার বিশ্ববিখ্যাত বই নীলক্ষেতে একশ টাকা!
- তাওসিফুল ইসলাম
- প্রকাশ: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৫:৩৯ PM , আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৬:০৬ PM

বিশ্ববিখ্যাত বই কিনতে কি হাজার টাকা খরচ করতে হবে? নীলক্ষেত গেলে উত্তর হবে—না! জনপ্রিয় ও বিখ্যাত বইগুলোর দাম যেখানে হাজারের ঘরে, সেখানে ঢাকার নীলক্ষেত বই পল্লিতে মিলছে মাত্র এক-দুইশো টাকায়। বিশ্বের সর্বাধিক বিক্রিত বইগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘রিচ ড্যাড পুওর ড্যাড’ বইটি মার্কিন লেখক রবার্ট কিওসাকি লিখেছেন ১৯৯৭ সালে। বিশ্বব্যাপী ৪ কোটিরও বেশি কপি বিক্রি হওয়া এই বইটির দাম অ্যামাজনে ৭ দশমিক ১৪ ডলার (৮৭৭ টাকা), আর রকমারিতে ২৪০ টাকা। কিন্তু নীলক্ষেতে? মাত্র ১৫০ টাকা।
আফগান বংশোদ্ভূত আমেরিকান লেখক খালেদ হোসাইনির জনপ্রিয় উপন্যাস দ্য কাইট রানার বইটি অ্যামাজনে ১০ দশমিক ৬১ ডলার (১ হাজার ৩০৩ টাকা), বাতিঘরে যার দাম ১ হাজার ৭৮ টাকা। অথচ নীলক্ষেতে এর মূল্য মাত্র ১০০ টাকা। জেমস ক্লিয়ারের আত্মউন্নয়নমূলক বই অ্যাটমিক হ্যাবিটস বইটি অ্যামাজনে ১০ দশমিক ৭৫ ডলার (১ হাজার ৩১৯ টাকা)। কিন্তু নীলক্ষেতে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ১৫০ টাকায়।
একইভাবে দ্য সাইকোলজি অব মানি বইটির অ্যামাজন মূল্য ১০ দশমিক ৯৯ ডলার (১ হাজার ৩৪৯ টাকা), রকমারিতে ৬৩৮ টাকা, অথচ নীলক্ষেতে মিলছে মাত্র ১৫০ টাকায়। ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত শিব খেরার বিখ্যাত বই ইউ ক্যান উইন বইটি রকমারিতে ৯০০ টাকা বিক্রি হলেও, নীলক্ষেতে ১২০ টাকা। এই বইটির ভারতীয় সংস্করণ ৩০৫ রুপি (৩৭৪ টাকা), আর অ্যামাজনে ১৭ দশমিক ৩৬ ডলার (২ হাজার ১৩১ টাকা)। সান জুর ক্লাসিক দ্য আর্ট অব ওয়ার রকমারিতে ২৩৮ টাকা, আমাজনে ৪ দশমিক ৯৯ ডলার (৬১৩ টাকা), কিন্তু নীলক্ষেতে ১২০ টাকা।
যারা ইতিহাস ও সভ্যতার বিবর্তন নিয়ে আগ্রহী, তাদের জন্য ইউভাল নোয়া হারারির সেপিয়েন্স: এ ব্রিফ হিস্টোরি অফ হিউম্যানকাইন্ড গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। রকমারিতে বইটির মূল্য ১ হাজার ৩৯৮ টাকা, আমাজনে ১৭ দশমিক ২২ ডলার (২ হাজার ১১৩ টাকা), কিন্তু নীলক্ষেতে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ২০০ টাকায়।
এসব বইয়ের মেধাস্বত্ব রক্ষা হচ্ছে নাকি পাইরেসির উপর নির্ভর করে ?
অস্বাভাবিক কম দামে বিশ্বখ্যাত বই কেনার পেছনে প্রশ্ন ওঠে—এগুলো কি পাইরেটেড? নীলক্ষেতের অনেক বিক্রেতাই বলছেন, এগুলো কম দামের ভারতীয় সংস্করণ বা সহজলভ্য পুনর্মুদ্রণ। তবে বইপ্রেমীদের কাছে প্রশ্নটা নৈতিকতার চেয়ে সহজলভ্যতার।
যদিও বাংলাদেশে আমদানিকৃত বইয়ের ওপর কর ও পরিবহণ খরচ যোগ হয়ে দাম বেড়ে যায়। কিন্তু নীলক্ষেতের বিক্রেতারা বলছেন, ভারত ও অন্যান্য দেশ থেকে বই কম দামে সংগ্রহ করায় তারা স্বল্পমূল্যে বিক্রি করতে পারেন। তাছাড়াও, স্বল্পমূল্যের কাগজে ফটোকপি করে সাপ্লাই দেওয়ার নানান প্রিন্টিং হাউজ আছে ঢাকা শহরে।
নীলক্ষেত ফুটপাতে কয়েকজন বিক্রেতার সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ নামের একজন বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা উচ্চমূল্যে বই পড়তে পারবেনা। এগুলো ফটোকপি করে বাজারে ছাড়া হয়৷ অনেক মানুষ আছে এই বই সরবরাহ করার।’
‘পাইরেসি নীতিপরিপন্থী ’
পাইরেসি হলো একটি অবৈধ কার্যক্রম, যেখানে লেখক বা প্রকাশকের কন্টেন্ট অননুমোদিতভাবে কপি, শেয়ার, এবং বিতরণ করা হয়। কম্পিউটার আইনে এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধ এবং সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রণীত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিন্টিং এন্ড পাবলিকেশন স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মহসিনা ইসলাম মনে করেন, পাইরেসি একেবারেই নীতিপরিপন্থী।
অধ্যাপক মহসিনা ইসলাম বলেন, ‘পাইরেটেড কোনোকিছু ভালো না। নৈতিক প্রশ্নেও এটা সমর্থনযোগ্য নয়। পাইরেসির জন্য লেখক-প্রকাশকরা ক্ষতির সম্মুখীন হোন। লেখা একজন লেখকের ব্রেইন চাইল্ড।’ উন্নত দেশে ফটোকপি করাকেও অনুৎসাহিত করা হয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
আইন কী বলে?
বাংলাদেশের কপিরাইট আইন অনুযায়ী, কোনো বইয়ের অনুমোদনহীন অনুলিপি তৈরি ও বিক্রি করা অবৈধ। ২০০০ সালের কপিরাইট আইন অনুসারে, কোনো বই বা সৃজনশীল কাজের স্বত্বাধিকার সংরক্ষণ করা হয় ৬০ বছর পর্যন্ত। তবে শিক্ষাগত উদ্দেশ্যে কিছু ক্ষেত্রে ফটোকপি বা পুনর্মুদ্রণের সীমিত অনুমতি দেওয়া হয়।
আইন থাকলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ খুবই দুর্বল। অনেক ক্ষেত্রে প্রকাশকরাই আইনি ব্যবস্থা নিতে চান না, কারণ পাইরেটেড বইয়ের চাহিদা বিপুল, এবং সাধারণ ক্রেতারা কম দামে বই কিনতে আগ্রহী। এমন অবস্থায় প্রশ্ন ওঠে, নীতির বাইরে কিন্তু বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিন্টিং এন্ড পাবলিকেশন স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘পাইরেসি নৈতিকভাবে ঠিক না। সেক্ষেত্রে আইনও আছে। প্রকাশকরা যদি আইনানুগভাবে এগোতে চান, তারা পারবেন।’
তবে এমন পরিস্থিতিতে মন্দের ভালো হিসেবে তরুণদের মাঝে পাঠ্যাভ্যাস বাড়ছে বলেও উল্লেখ করেন এই সহকারী অধ্যাপক। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার দিকে তাকালে পাইরেসির একটা ভালো দিক হলো—বইয়ের সহজলভ্যতা। যার কারণে তরুণদের পাঠাভ্যাস বাড়ছে।’
সবার জন্য বই—সঠিক পথে কীভাবে? নীলক্ষেতের বইবাজার সম্পর্কে অনেক বিতর্ক থাকলেও এটি নিশ্চিত যে, এখানে বই সহজলভ্য হওয়ায় শিক্ষার্থীরা উপকৃত হচ্ছেন। তবে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কী হতে পারে, তা নিয়েও ভাবতে হবে। একদিকে, পাইরেটেড বই লেখক ও প্রকাশকদের জন্য ক্ষতিকর। অন্যদিকে, দামের কারণে বই পড়ার সুযোগ কমে গেলে পুরো সমাজই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই নীতির মধ্যে থেকেই বই সহজলভ্য করার উপায় খুঁজতে হবে বলে মত সংশ্লিষ্টদের।