রুটি খেয়ে শক্তি বাড়াও, নারী নিয়ে ফূর্তি কর
রাইফেল রোটি আওরাত। আনোয়ার পাশার লেখা মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক একটি উপন্যাস। এটিই একমাত্র উপন্যাস যেটি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে লেখা হয়। ২৫ মার্চ রাতে বাংলাদেশ যে মৃত্যুর বিভীষিকায় ডুবেছিল, তার ভেতরে রক্ত, লাশ আর নরক সমান ভয়াবহতার মধ্যে আনোয়ার পাশা লিখছেন ওই মৃত্যুরই আখ্যান। সে হিসেবে বলাই যায়, রক্ত দিয়ে লেখা হয়েছে এই উপন্যাস।
উপন্যাস হচ্ছে বাস্তবজীবনের প্রতিচ্ছবি; অর্থাৎ বাস্তবজীবনের সম্ভাব্য ঘটনাবলীকে যখন লেখক কল্পনার রঙে রাঙিয়ে সুনির্বাচিত ঘটনা ও চরিত্রের মধ্য দিয়ে উপস্থাপিত করেন; তখনই তা উপন্যাসের পদবাচ্য হয়ে ওঠে। অন্য কথায় বলা যেতে পারে, লেখকের ব্যক্তিগত জীবনদর্শন ও জীবনানুভূতি কোন বাস্তব কাহিনী অবলম্বনে যে বর্ণনাত্বক শিল্পকর্মে রূপায়িত হয় তাকে উপন্যাস বলে। উপন্যাসের সংজ্ঞা ও কাহিনী সম্পর্কে আমাদের যে ধারণা রয়েছে ‘রাইফেল রোটি আওরাত’এ তেমন সংজ্ঞায়িত কাহিনী নেই। তবু কাহিনী তো একটা রয়েছেই।
মূলত যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী রাইফেলের মুখে আমাদের অস্তিত্ব হরণ করে। শুধু তাই নয়, তারা রোটি (রুটি) খেয়ে আওরাত তথা সেই ৩ লক্ষ মা বোন যাদের সম্ভ্রম হানি করতে শুরু করে। অর্থ্যৎ বন্দুক, খাবার-দাবার আর নারীর যৌবনকে পূঁজি করেই চলছিল একাত্তরের হানাদার বাহিনীর এগিয়ে চলা। উপন্যাসে এ বিষয়টিই নানাভাবে প্রকাশ পেয়েছে। আরেকটু স্পষ্ট করলে বলতে হয়, বইটিতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীদের চরিত্র এটাই যে- “রোটি (রুটি) খেয়ে গায়ের তাকত বাড়াও, আর রাইফেল ধরে প্রতিপক্ষকে খতম কর, তারপর আওরাত নিয়ে ফুর্তি কর।”
‘রাইফেল রোটি আওরাত’,শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক আনোয়ার পাশা’র (১৯২৮-১৯৭১) মৃত্যুর আগে লেখা শেষ বই। বইটা পড়ার সময় মনে হতে পারে, লেখক মৃত্যুর মিছিলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে এই উপন্যাসটা লেখার সময় কি জানতেন, সেই মিছিলে তিনিও যোগ দিতে চলেছেন?
আনোয়ার পাশা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। বিজয়ের ঠিক দুদিন আগে, ১৪ ডিসেম্বর তারিখে এ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করে জাতিকে মেধাশূন্য করার যে নীল-নকশা বাস্তবায়ন করেছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা, সেই ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হয়েছিল মেধাবী এই শিক্ষককেও।
অধ্যাপক আনোয়ার পাশা উপন্যাসটা রচনা করেছিলেন ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে জুন মাস। যদিও বইটা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে। সম্ভবত এটাই বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় লেখা একমাত্র উপন্যাস। উপন্যাসের কেন্দ্রিয় চরিত্রের নাম সুদীপ্ত শাহীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক। মূলত লেখক ওই সময়টাতে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাগুলোই সুদীপ্ত শাহীন চরিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন।
২৫ শে মার্চের গণহত্যা,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের হত্যার নির্মম কাহিনী,বিশ্ববিদ্যালয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষের শিক্ষকদের বিশ্বাসঘাতকতার কথা,মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের নানাভাবে সহযোগিতাকারী মানুষদের ত্যাগের গল্প, শহীদ পরিবারের সদস্যদের হাহাকার, চারপাশের মানুষের মননে-আচরণে সাম্প্রদায়িকতা-অসাম্প্রদায়িকতার দ্বন্দ্ব- সবই উঠে এসেছে এ উপন্যাসে।
কী আছে বইয়ের ভূমিকায়
মানুষ এবং পশুর মধ্যে বড় একটা পার্থক্য হচ্ছে, পশু একমাত্র বর্তমানকেই দেখে, মানুষ দেখে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতকে এক সঙ্গে বিবচেনা করে। যখন কোন ব্যক্তি এবং সমাজ একমাত্র বর্তমানের মধ্যেই আবর্তিত হতে থাকে তখন সর্বনাশের ইশারা প্রকট হতে থাকে।
বাঙালির সুদীর্ঘ ইতিহাসের বোধ করি সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায় হচ্ছে তার সংগ্রামের কালগুলো। এবং এক্ষেত্রে উজ্জ্বলতম ঘটনা হচ্ছে, ১৯৭১-এ পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের অসাধারণ লড়াই। এ ছিল সমগ্ৰ জাতির একতাবদ্ধ দৃঢ়প্ৰতিজ্ঞ সংগ্রাম। আমাদের পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্য, আমাদের বর্তমানের গৌরব এবং আমাদের ভবিষ্যতের প্রেরণা বাঙালির এ সংগ্রামের ইতিহাস।
অত্যন্ত শঙ্কিত চিত্তে লক্ষ্য করার মত ব্যাপার হচ্ছে, আমরা এটাকে যেন ভুলে যেতে বসেছি। যেসব লক্ষ্য নিয়ে আমাদের লড়াই তাকে বাস্তবে রূপায়িত করার ব্যর্থতা থেকেই এ বিস্মৃতির সূত্রপাত হচ্ছে। কিন্তু ব্যৰ্থ বর্তমান তো কোন জাতিরই চিরকালের সত্য ইতিহাস নয়, সত্য অনুভূতিও নয়। যে আবেগ এবং অনুভূতি চক্রান্তের ধূর্তচক্রে আচ্ছন্ন হচ্ছে, তাকে উজ্জীবিত করার জন্যই দরকার সংগ্রামের কালের মানুষের মহান ত্যাগ এবং নিষ্ঠাকে বারংবার স্মরণ করা। তার থেকেই আসবে কুশায়াকে দূর করার উজ্জ্বল সম্ভাবনা। আমাদের চিত্তের পবিত্ৰতা রক্ষা পাবে।
সেকালের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের মধ্যে বসে লেখা আমাদের সমগ্র ইতিহাসে একটি মাত্র উপন্যাসই পাওয়া যায়-এ উপন্যাসই হচ্ছে “রাইফেল রোটি আওরাত"। ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে জুন মাস এর রচনাকাল। লেখক শহীদ আনোয়ার পাশা নিহত হলেন ১৯৭১ সালেরই ১৪ই ডিসেম্বর। স্বাধীনতা লাভের মাত্র দু'দিন আগে তিনি যে অমর কাহিনী উপন্যাসে বিধৃত করেছেন নিজেই হয়ে গেলেন তারই অঙ্গ চিরকালের জন্য।
আনোয়ার পাশার উপন্যাসটি একদিক দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে বসে একজনের প্রতিটি মুহুর্তের কাহিনী। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যে সৃষ্ট এ শিল্পকর্ম কতটা সত্যনিষ্ঠা লেখকের জীবনের পরিণতিই তার মহান সাক্ষ্য হয়ে থাকবে।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-জীবনে জীবন যোগ করা
না হলে, কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পসরা।
আনোয়ার পাশার উপন্যাস, তাঁর শেষ উচ্চারণঃ “নতুন মানুষ, নতুন পরিচয় এবং নতুন একটি প্রভা। সে আর কতো দূরে। বেশি দূর হতে পারে না। মাত্র এই রাতটুকু তো। মা ভৈঃ। কেটে যাবে।” তাঁর এবং আমাদের সকলের কামনা ও প্রত্যাশারই অভিব্যক্তি। শিল্পী তাঁর জীবনকে আমাদের জীবনের মধ্যে পরিব্যাপ্ত করে দিয়েছেন। ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ আনোয়ার পাশার শহীদ আত্মার আকাঙক্ষাকেই যেন আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত করে চলেছে নিরন্তর এবং অম্লান। উপন্যাসটির পরতে পরতে নানা ঘটনার বর্ণনা ও লেখকের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যমে বোঝা যায় সেই সময়কার অবস্থার ভয়াবহতা।
উপন্যাসটি বর্ণনা প্রধান হওয়ার ফলে এর ভাষা কখনও ছন্দায়িত লালিত্য, আবার কখনও আবেগধর্মী হয়ে উঠেছে। যেমন, ‘আমনের বুক ভরে ফুটলো এক কথার সূর্যমুখী আমরা বাঙালী, স্বাধীনতার সূর্যের দিকে উন্মুখ একটি ফুলের নাম আমরা বাঙালী।’ তবে শিল্পসৃষ্টির ক্ষেত্রে সবচেয়ে যেটা প্রধান বিষয় তা হচ্ছে লেখক ঘটনার উর্ধে উঠে ঘটনা সম্পর্কে নির্লিপ্ত থাকতে পেরেছেন। লেখকের এই সংযত ও সংহত মানসিকতার কারণেই উপন্যাসটি সার্থকতা পেয়েছে। এ প্রসঙ্গে সাহিত্যিক আবুল ফজলের উক্তিটি স্মর্তব্য, আনোয়ার পাশার এই বই কোন অর্থেই গদগদ বাক্যের পালা হয়নি। এ এক সংহত, সংযত নির্লিপ্ত শিল্পী মনেরই যেন উৎসারণ। চোখের সামনে ঘটা টাটকা ঘটনাবলীর উত্তাপ তার শিল্পসত্তাকে কেন্দ্রচ্যুত করেনি কোথাও। লেখকের জন্য এর চেয়ে প্রশংসার কথা আর হতে পারে না।
মূল চরিত্র
১.সুদীপ্ত শাহিন যিনি বইটির মূল চরিত্রে আছেন। তার যুদ্ধকালীন সময়ের কথা বলা আছে বইটিতে।
২.মীনাক্ষি যিনি সুদীপ্ত শাহিনের স্ত্রী।
৩.মহীউদ্দিন ফিরোজ সুদীপ্ত শাহিনের বন্ধু, তারও গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে বইটিতে।
৪. মহীউদ্দিন ফিরোজের স্ত্রী, হামিদা নামক এক ছাত্রী, রাজাকার মালেক সাহেব, রাজাকার মাসুদুর রহমান, নাজিম, সমাজ সেবী বুলা, পাকিস্তানী মিলিটারি বাহিনী সহ আরো অনেকে উক্ত গল্পের চরিত্রে আছেন।
৫.এছাড়াও অনেক বুদ্ধিজীবী যেমন, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ড: গোবিন্দ চন্দ্র দেব, বঙ্গবন্ধুসহ আরো অনেককে উপস্থাপিত করা হয়।
উপন্যাসের নায়ক সুদীপ্ত শাহীন তার স্ত্রী মীনাক্ষি ও এক কন্যা সন্তানকে নিয়ে যুদ্ধের বিভীষিকা থেকে বাঁচতে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছুটে বেড়াচ্ছেন। তার কাছে মৃত্যুর চেয়ে বেশি ভয়ানক এই মৃত্যু আতঙ্কে বেঁচে থাকা। মৃত্যু যেখানে স্বাভাবিক আটপৌরে ঘটনা, তখন বেঁচে থাকাটাই একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার, এটাই তখন সংবাদ। তবু এরই মাঝে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে সুদীপ্ত, স্বপ্ন দেখে পাকিস্তানীদের হঠিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে সমাজতন্ত্রের পতাকা উড়বে। তাই লিখেছেন, “টুঁটি টিপে ধরলে মানুষ কতক্ষণ বাঁচে! বাধা দিতেই তো হবে। হয় মুক্তি, না হয় মৃত্যু।”
তবে উপন্যাসের শেষের কয়েক লাইনে লেখক আশার কথাই বলে গেছেন,“পুরোনো জীবনটা সেই পঁচিশের রাতেই লয় পেয়েছে। আহা,তাই সত্য হোক। নতুন মানুষ, নতুন পরিচয় এবং নতুন একটি প্রভাত।সে আর কতো দূরে? বেশী দূর হতে পারে না। মাত্র এ রাতটুকু তো! মা ভৈ:।কেটে যাবে।”
হ্যা, সেই কালো রাত কেটে যায়, কিন্তু সেই নতুন প্রভাতে নতুন পরিচয়ে নতুন জীবনটা আর কাটাতে পারেননি অধ্যাপক আনোয়ার পাশা। নতুন প্রভাতের ঠিক দু’দিন আগে ভয়ঙ্কর এক কালো রাত নেমে আসে, শহীদ হতে হয় পাশাসহ আরো অনেক বুদ্ধিজীবীদের।
এ বইয়ের লেখক এ বইটি সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য জানা দরকার। লেখকের জন্ম মুর্শিদাবাদ জেলার কাজীশাহ্ গ্রামে। তিনি ১৯৫৩ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. পাশ করেন। একই বছরে বিয়ে করেন মসিনা বেগমকে। তার দুই ছেলে- মাসারুল আফতাব ও রবিউল আফতাব। লেখকের আরও দুটি উপন্যাসের নাম- ‘নীড় সন্ধানী’, ‘নিষুতি রাতের গাথা’। কবিতার বই- ‘নদী নি:শেষিত হলে’। ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ বইটি প্রথম প্রকাশ করে তাজুল ইসলামের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘বর্ণমিছিল’। এর পাণ্ডলিপি শহীদ পাশার পরিবারের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও আনোয়ার পাশার বন্ধু ড. কাজী আব্দুল মান্নান। ২৫ শে মার্চের রাতেও অধ্যাপক পাশা’র বাসায় তার নিমন্ত্রণ ছিল, যদিও তা রক্ষা করা যায়নি। পরবর্তীতে আরেক শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. আলিম চৌধুরীর সহায়তায় ভারতে পালিয়ে যান ড. মান্নান, বন্ধু পাশার মৃত্যুর কথা তিনি দেশে ফিরে আসার পর জানতে পারেন।