৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫:৩৮

তিন কারণে বেড়েছে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ব্যয়

শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক  © সংগৃহীত

প্রেস মালিকদের সিন্ডিকেট, স্বল্প সময়ে অধিক বই মুদ্রণের ফলে আনুষঙ্গিক ব্যয় বৃদ্ধি এবং দশম শ্রেণিতে নতুন করে ৬ কোটির বেশি বই ছাপানোর মতো বড় তিন কারণে নতুন বছরে বিনামূল্যে পাঠ্যবই ছাপায় অন্তত ২০ শতাংশ খরচ বেড়েছে সরকারের। নতুন বছরে পুরোনো কারিকুলাম ফিরে আসার ফলে ইতোমধ্যে ৬০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ খরচ করতে হয়েছে সরকারকে। কয়েকটি টেন্ডার এখনো বাকি, ফলে সর্বমোট সরকারের অতিরিক্ত খরচ হতে পারে ৮০০ কোটির বেশি অর্থ। 

জানা গেছে, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) প্রাক্কলিত দরের চেয়ে অন্তত ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি দর দিয়ে প্রেস মালিকরা পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা (পিপিআর) অনুযায়ী বই ছাপার কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন। এনসিটিবি সূত্র বলছে, স্বল্প সময়ে কাজের চাপ বেশি থাকার সুযোগ নিয়েছে প্রেস মালিকদের সিন্ডিকেট। ফলে সিন্ডিকেট সম্পর্কে বুঝতে পারলেও দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। যদিও প্রেস মালিক কর্তৃপক্ষের দাবি, বাজার দর বেড়ে যাওয়ায় তাদের তেমন করণীয় ছিল না।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বড় পরিবর্তনের ফলে নতুন বছরে ছাপা মোট বইয়ের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ কোটি ১৬ লাখ। নতুন বছরে প্রাক-প্রাথমিক থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিপুল সংখ্যক বই ছাপতে আরও সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়িয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রথমে ১২০০ কোটি টাকা বাজেট নির্ধারণ করা হলেও এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭৫০ কোটি টাকা। চলতি বছর নতুন বই ছাপার খরচের চেয়ে তা ৩৫০ কোটি টাকা বেশি।

তবে এনসিটিবির অভিযোগের বিপরীতে কথা বলেছেন বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির ভাইস চেয়ারম্যান মো. হুমায়ুন কবির। একটি গণমাধ্যমকে তিনি জানান, বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দামের ওপর নির্ভর করে তারা টেন্ডারের রেট দেয়। ফলে এনসিটিবির যে অভিযোগ সত্য নয়। এই প্রেস মালিক আরও বলেন, এনসিটিবি শুধু কাগজের দামের ওপর নির্ভর করে এস্টিমেটেড কষ্ট নির্ধারণ করেছে। এর সঙ্গে কালি, গ্লুসহ অনেক কিছুর দামই যোগ করতে হয়। এ বছর যে মানের কাগজ চাওয়া হয়েছে, সেগুলো পাল্প ছাড়া সম্ভব নয়। কাগজের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় তার সুযোগ নিচ্ছেন মিল মালিকরা।

প্রাইমারিতে প্রায় ২২ থেকে ২৩ কোটি টাকার মতো অর্থ বেশি খরচ হয়েছে। কিন্তু অর্থ ব্যয় বেশি বেড়েছে মাধ্যমিক শাখার বইগুলোর উৎপাদনে। মাধ্যমিকের বইগুলোর উৎপাদনে ক্ষেত্রে আগের বছরের তুলনায় বাজার দর বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বইয়ের ভলিউম ও সংখ্যা বৃদ্ধি, একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে এর বাইরে প্রেস মালিকদের সিন্ডিকেট ও বেশি অর্থ ব্যয়ের একটি অন্যতম কারণ।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) বিতরণ নিয়ন্ত্রক মো: হাফিজুর রহমানের সাথে কথা হলে তিনি জানান, আমরা বই ছাপানোর কাজ প্রদানের পাশাপাশি বাজারেও খোঁজ নিয়েছি। প্রেস মালিকদের বক্ত্যব্যের সত্যতা রয়েছে। তবে এখানে তারা চাইলে দাম আরও কমাতে পারত। কিন্তু তারা সেটি করেনি। তবে এটাও সত্য, এবার বইয়ের সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে। আগের পাঠ্যক্রমে শিক্ষার্থীরা যে বইগুলো পড়ত এবার তার তুলনায় সংখ্যা ও ভলিউম বেড়েছে। এছাড়া কাগজের মানও আমরা আগের চেয়ে ভালো দিতে চাই। সার্বিকভাবেই বইয়ের উৎপাদন খরচ আগের তুলনায় বেড়েছে। যদিও এই বৃদ্ধির পরিমাণটা অনেক বেশি। যেটা কাম্য নয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির একজন ভাইস চেয়ারম্যান জানান, সার্বিকভাবে ব্যয় বৃদ্ধির জন্য সময় স্বল্পতা একটা বড় কারণ। প্রেস মালিকরা খুব স্বাভাবিকভাবে এক মাসের মধ্যে সবকিছু করতে গিয়ে দাম বাড়িয়েছে। এনসিটিবিরও তাদের বাইরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। তবে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সবগুলো কাজ হলে এই সমস্যার সৃষ্টি হত না।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক একেএম রিয়াজুল হাসান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পসকে বলেন, পুরোনো কারিকুলামে ফিরে যাওয়ার ফলে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণে অনেকগুলো পরিবর্তন এসেছে। আগে দশম শ্রেণির বই দেয়া হতো না, কিন্তু এবার সেটাও দিতে হচ্ছে। ফলে এখানে নতুন করে প্রায় ৬ কোটি ৪৪ লক্ষ বই বেশি ছাপতে হচ্ছে। আবার বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি, কারিকুলাম পরিবর্তনের কারণে আমাদের কাজের পরিধি বাড়লেও সময়ের স্বল্পতা ছিল। 

তিনি আরও বলেন, স্বাভাবিকভাবে বই ছাপানোর টেন্ডার থেকে সব কাজ হয় প্রতি বছর জুনের দিকে, কিন্তু এবার টেন্ডারের কাজ শুরু হয় সেপ্টেম্বর থেকে। আমাদের রি টেন্ডার করার মতো সময়ও ছিল না। প্রেস মালিকরা এসব দুর্বলতাগুলোর সুযোগ নেয়। আগে তারা নিম্ন দরে করতো, কিন্তু মান নিশ্চিতের জন্য এবার আমরা কড়াকড়ি আরোপ করায় তারা নিজেদের লাভের কথা চিন্তা করে এমন করেছে বলে মনে করছি।

সিন্ডিকেটের বিষয়ে চেয়ারম্যান জানান, আমরা দেখেছি প্রায় প্রতিটি প্রেস মালিকরা প্রাক্কলিত ব্যয়ের থেকে মালিকরা ১৯ দশমিক ১, ১৯ দশমিক ২ কিংবা ২০ শতাংশ বাড়িয়ে টেন্ডার জমা দেয়। কিন্তু তাদের সবার মধ্যে একটা মিল ছিল বলে আমরা দেখেছি৷ ফলে এটা বোঝা যায় যে, তারা সবাই যোগসাজশ করে টেন্ডার জমা দিয়েছেন। ফলে আমাদের সামনে তেমন কোনো বিকল্প ছিল না 

সমস্যা মোকাবেলায় পরিকল্পনার কথা জানিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, আর্মি প্রেসের সক্ষমতা বৃদ্ধি, এনসিটিবির নিজস্ব প্রেসের দিকে নজর দেয়া কিংবা বাজারের উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ তৈরি করা গেলে সমস্যাটা সমাধান সম্ভব। আমরা ইতোমধ্যে সরকারকে বিষয়টি জানিয়েছি। পরবর্তীতে যাতে এই সমস্যার উদ্ভব না হয়, সেটার জন্য আমরা সতর্ক রয়েছি৷