২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:০৯

বই রিভিউ: অপেক্ষা - হুমায়ূন আহমেদ

'অপেক্ষা' বইয়ের প্রচ্ছদ এবং হুমায়ূন আহমেদের ছবি।  © সংগৃহীত

আচ্ছা মৃত্যুর পর মানুষকে ভুলে যেতে মানুষের কতদিন লাগে? কীভাবে ভুলে যায় মানুষ? বোধহয় খুব আস্তে আস্তে তার অজান্তেই প্রিয়জনের স্মৃতি আবছা হতে থাকে। আস্তে আস্তে মুখ ঝাপসা হয়ে আসে, কান্না কমতে কমতে দীর্ঘশ্বাসে থমকে থাকে, শূণ্যতাও ঢেকে যায় একসময়। এই বিস্মৃতিই আসল মৃত্যু। আর বিস্মৃতিকেই মানুষের যত ভয়।

কিন্তু মানুষ যদি হারিয়ে যায়?

বলছি হুমায়ূন আহমেদের "অপেক্ষা" উপন্যাসটার কথা। খুব সহজ গল্প এই উপন্যাসটার। একজন লোক হঠাৎ একদিন বাড়ি থেকে চলে যায় কিংবা হারিয়ে যায়। কোথায় চলে যায় কেউ বলতে পারেনা। তার স্ত্রী এবং দুই সন্তান রয়ে যায় বাড়িতে। গল্পটা তার স্ত্রীর, সুরাইয়ার। সুরাইয়ার চোখের সামনে সময় বয়ে যায়, শোক থেকে বিস্মৃতি হয়ে একদম ধ্বংস অবধি। বা ধ্বংস থেকে সৃষ্টি হয়ে বিস্মৃতি, শোক ও সৃষ্টি অবধি। চোখের সামনে জীবন বয়ে চলে। বয়ে চলে বিস্মৃতির পরেও। গল্পে ফিরি। অনেক অনেক বছর কেটে যায়। 

গোটা উপন্যাস জুড়ে সুরাইয়া  ভালোবাসে, ভালোবাসতে বাসতে সে কখনো এসে দাঁড়ায় নিজের সামনে, নিজেকে দেখতে পেয়ে চমকে ওঠে, চিনতে পারে না। গোটা উপন্যাস জুড়ে সুরাইয়ার বিচ্ছেদ হয়। বিচ্ছেদের ঘুমে সুরাইয়া হাঁটতে বেরোয় নিজের ভেতরের রাজপথে, একা, নিঃসঙ্গ, অভিযোগহীনা। গোটা উপন্যাস জুড়ে সুরাইয়ার স্মৃতি তৈরি হয়, সে স্মৃতির বালি আঁকড়ে ধরে নরম মুঠোয়, তারপর ধুয়ে যেতে দেয় প্রশ্নাতীত সময়স্রোতে। গোটা উপন্যাস জুড়ে সুরাইয়া নিজেকে খোঁজে, খুঁজতে খুঁজতে সে ভালোবাসার সামনে এসে দাঁড়ায়। বা তার ভালোবাসা গোটা উপন্যাস জুড়ে তাকে খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে দেখতে পায় নিজের সমস্ত দ্বিধা ও মৃত্যুবোধ, আদর ও অবজ্ঞা, ভুল ও সময়হীনতা নিয়ে সে নিজেই তার মুখোমুখি। ভালোবাসলে আসলেই মানুষ নিজের মুখোমুখি দাঁড়ায়, সুরাইয়ার মতো। 

সুরাইয়ার দুই সন্তান বড় হয়ে যায়। সুরাইয়ার কেন যেন মনে হতো তার ছেলে ইমনের বিয়েতে তার স্বামী ফিরে আসবে। বিয়ের রাতে কলিং বেল বাজে। সময় চলতে থাকে। 

শুধু থেমে থাকে কীসের একটা অপেক্ষা। কে যেন কথা দিয়েছিল মনে রাখবে, কে যেন পাঁজরের ভেতর লিখে রেখেছে গোপনতম চিঠি, কে যেন সময়কে ঠাট্টা করে বলেছিল এইটুকুই চিরন্তন। পৃথিবীর সমস্ত সৃষ্টি ও বিস্মৃতি কেবল ভালোবাসার চোখে অমরত্বের প্রত্যাশায় মরে যায় বারবার। আর বেঁচে থাকে শুধু অপেক্ষা।

হুমায়ূন আহমেদ বরাবরের মতোই তার লেখায় ধোঁয়াশা রেখেছেন। দরজা খুলে সুরাইয়া তার স্বামীকে দেখতে পাবে কিনা সেটা ধোঁয়াশা রেখেই গল্প শেষ করেছেন তিনি। তবে এই গল্পটা সুরাইয়ার স্বামীর ফিরে আসার নয়। গল্পটা একটা নিরেট, নির্ভেজাল অপেক্ষার। সেটিই বুঝতে হলে পড়তে হবে হুমায়ূন আহমেদের কালজয়ী উপন্যাস 'অপেক্ষা'।

হুমায়ূন আহমেদের পাঠক প্রিয়তার জন্য তিনি সবার কাছেই পরিচিত এবং সমাদৃত। তাকে নিয়ে বেশি কিছু তাই বলব না। শুধু বলতে চাই যারা হুমায়ূনকে প্রথাগত সাহিত্য সমালোচনার তাক ধরা কাঠামোতে বিচার করতে চান- তারা তার বৈচিত্র্যময় সৃষ্টিভাণ্ডারের অতলে পড়ে যাবেন।