বাংলা ভাষায় এত ফারসি শব্দ যেভাবে এলো
বাংলা ভাষায় বিভিন্ন ভাষার শব্দ যুক্ত হওয়ায় একে যে ‘মিশ্র ভাষা’ বলা হয়। পাঠ্যবইয়ের সংজ্ঞায় এটা আমরা সবাই কম বেশি জানি। আমাদের ভাষায় প্রবেশ করা বিদেশি শব্দগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবেশ করেছে ফারসি ভাষার শব্দ। ভাষাবিদরা মনে করেন, দীর্ঘদিন বাংলা মুসলিম শাসনের অধীনে থাকায় এবং একইসঙ্গে দাপ্তরিক ও সাহিত্যকর্মে ফারসি শব্দ গ্রহণ করায় ভাষাটি থেকে বিপুল পরিমাণ শব্দ বাংলা ভাষায় প্রবেশ করেছে।
‘বাংলায় ভাষায় সবচেয়ে বেশি বিদেশি শব্দ ফারসির’
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তার ‘বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত’ বইতে প্রথমবারের মতো দাবি করেন যে বাংলায় সবচেয়ে বেশি আছে ফারসি ভাষার শব্দ। ১৯৬৫ সালে বাংলা একাডেমি থেকে এটি প্রকাশিত হয়।
বইটির ‘বৈদেশিক প্রভাব’ পরিচ্ছদে তিনি লিখেছেন, “সম্রাট আকবরের কালে বাঙ্গালা দেশ মোগল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। এই সময়ে রাজসরকারের ভাষা ফারসী ছিল। এই ফারসী প্রভাব লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের আমল পর্যন্ত ছিল—এই দীর্ঘ ৬০০ শত বৎসরের মুসলমান প্রভাবের ফলে বাঙ্গালা ভাষায় দুই সহস্রের অধিক ফারসী শব্দ এবং ফারসীর মাধ্যমে আরবী এবং কিছু তুর্কী শব্দ প্রবিষ্ট হইয়াছে”।
অর্থাৎ, দুই হাজারেরও বেশি ফারসি শব্দ বাংলা ভাষায় আত্মীকরণ হয়েছে বলে মত ছিল এই ভাষাবিদের।
তবে ড. শহীদুল্লাহ বাংলা ভাষায় যে পরিমাণ ফারসি শব্দ আছে বলে ধারণা করেছেন, সেই সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ বলে মত ছিল আরেক ভাষাবিদ মুহম্মদ এনামুল হকের। সবশেষ বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত, ‘বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত আরবি ফারসি উর্দু শব্দের অভিধান’ গ্রন্থে প্রায় সাড়ে চার হাজার ফারসি শব্দ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বাংলা ভাষায় ফারসির প্রচলন—
ভাষাবিদদের মতে, বাংলা ভাষায় ফারসির প্রচলন হয়েছে মূলত মুসলমান শাসকদের হাত ধরে। তেরো শতকের শুরুর দিকে তুর্কি বংশোদ্ভূত শাসক ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজি পশ্চিমবঙ্গ দখলে নেয়। মূলত সেখান থেকেই বাংলায় মুসলিম শাসনের শুরু। তবে পুরো বাংলা মুসলিম শাসকদের অধীনে যেতে আরও ১০০’শ বছর সময় লেগেছিল।
তারপর থেকে ধাপে ধাপে সুলতানি ও মোগল শাসকদের মধ্যে যারাই বাংলার শাসন ক্ষমতায় এসেছেন, তাদের প্রায় সবাই ছিলেন ইরান ও আফগানিস্তান বংশোদ্ভূত, বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য ও সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ । তবে ফারসি অনেক বেশি ছড়িয়ে পড়ে মধ্যযুগে, মোগল সম্রাট আকবরের শাসনামলে।
ভাষাবিদ ড. শহীদুল্লাহর মতে, সম্রাট আকবরের সময়ই বাংলা মোগল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। আর সে সময় রাজভাষা ছিল ফারসি, যা দীর্ঘ ছয়শ বছর একই অবস্থানে থেকে আধিপত্য করেছে।
ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ
ফারসি প্রভাবের কারণ—
ভাষাবিদদের মতে, মূলত দুইভাবে ফারসি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। প্রথমত দাপ্তরিক কাজে আনুষ্ঠানিকভাবে ভাষাটির ব্যবহার এবং দ্বিতীয়ত সাহিত্য কর্মে ফারসি শব্দের ব্যাপক উপস্থিতি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. তারিক মনজুরের মতে, ভারতীয় উপমহাদেশে মধ্যযুগের প্রায় ৬০০ বছর ধরে মুসলিম শাসনের বড় একটা প্রভাব রয়ে গেছে এই ভাষার মধ্যে।
“পৃথিবীর অনেক ভাষার ক্ষেত্রে দেখা যায়, সেগুলো অন্য ভাষার প্রভাবের কারণে বিলুপ্ত হয়েছে বা সংকুচিত হয়েছে। কিন্তু বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক বা ব্রিটিশ শাসনামলে এবং তার আগের ৬০০ বছরের মুসলিম শাসনের পরও বাংলা ভাষা বিভিন্ন শব্দ নিজের মতো করে গ্রহণ করেছে”, বলেন তিনি।
তবে মুসলিম শাসনের দীর্ঘ সময়েও যে এই ভাষা রাজভাষা থেকে সাধারণ মানুষের কথ্য ভাষায় প্রবেশ করেছে, তেমনটা মনে করেন না ড. মনজুর। বরং বাংলায় ফারসির শব্দের ব্যবহার অনেক বেশি ‘মনস্তাত্ত্বিক’ বলেই মত এই গবেষকের।
তবে অনেকের মতেই, বাংলায় ফারসির প্রবেশ ঘটেছে মুসলিম শাসনেরও আগে। অষ্টম-নবম শতকে বাণিজ্য এবং ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে আসা মানুষের মাধ্যমেই বাংলার মানুষের প্রথম ফারসির সঙ্গে পরিচয় হয়।
ফারসির সঙ্গে বাংলা ভাষার সাহিত্যিক এবং রাজনৈতিক সম্পর্ক অন্তত আটশো বছরের বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ড. রাফাত আলম মিশু।
তার মতে, বাংলা ফারসি প্রভাবের “মূল কারণ শাসনতান্ত্রিক এবং খানিকটা সাহিত্যিক”। সুলতানি শাসন ও তারপর মোগল শাসনের আওতাভুক্ত সুবেদার এবং যে নবাবরা বাংলায় কাজ করেছেন তারা ধর্মীয় বিবেচনায় মুসলমান হলেও তাদের ব্যবহৃত শব্দগুলো কেবল ধর্ম সম্পর্কিত ছিল না। “ব্যবসা বাণিজ্য, আইন-আদালত, দাপ্তরিক প্রয়োজনে, মোট কথা শাসন কাঠামোর অংশ হিসেবে এই ফারসি শব্দগুলো এসেছে”, বলেন তিনি। তারই ধারাবাহিকতায় দৈনন্দিন জীবনের অনেক শব্দ ফারসি থেকে এসেছে বলে মনে করেন এই গবেষক।
জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর (মুঘল সাম্রাজের প্রতিষ্ঠাতা)
বাংলা ভাষায় ফারসি শব্দের আধিপত্য শুরু—
সুলতানি ও মোগল শাসনামলে বাংলা যখন দিল্লি থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো তখন অনুশাসন পাঠানো হতো ফারসিতে। ফলে সেসময় থেকেই এখানে সরকারি কাজে ফারসির প্রচলন শুরু হয়।
“এই ভারতবর্ষে মোগল আমল থেকে ইংরেজ আমল পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষা ছিল ফারসি। সেখানে যারা চাকরি করতো, তাদের ফারসি শিখতে হতো”, বলেন ড. সামাদ। ফলে একদিকে রাজভাষা হওয়ার কারণে অন্যদিকে শিক্ষিত ব্যক্তিদের সাহিত্য আগ্রহের কারণে ফারসির চর্চা করতে হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
তবে ড. মনজুরের মতে, বাংলা অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ফারসি কখনোই প্রধান ভাষা ছিল না। তাহলে প্রতিদিনের কথ্য ভাষায় এতো বেশি ফারসির প্রবেশ ঘটলো কী করে? কথ্য ভাষায় ফারসি শব্দের ব্যবহারকে অনেক বেশি মনস্তাত্ত্বিক বলে মনে করেন ড. মনজুর। তার মতে, বাংলা ভাষায় ফারসি শব্দ বেশি ঢুকেছে মধ্যযুগের শেষদিকে, অর্থাৎ ১৭শ থেকে ১৮শ সালের দিকে। সেসময় পলাশীর যুদ্ধ এবং সিপাহী বিদ্রোহে হেরে যাবার পর রাজনীতিতে ক্ষমতা হারায় মুসলমানরা।
“মুসলমান প্রধান এই অঞ্চলের মানুষ চেয়েছে তার ভাষা দিয়ে স্বকীয়তা, জাতিবোধ ও স্বাজাত্যবোধ প্রকাশ করার জন্য। ফলে তারা ভাষার মধ্যে প্রচুর পরিমাণে আরবি ফারসি প্রয়োগ করেছে”, বলেন ড. মনজুর।
তবে সে সময়ের সাহিত্যে ফারসি ব্যবহারের পরিমাণ ছিল স্বাভাবিক প্রবণতার চেয়ে বেশি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তার সবটা স্থায়ী হয়নি। এরমধ্যে যেটুকু ভাষার সাথে মিলে যায় সেটাই রয়ে গেছে বলে মনে করেন এই গবেষক।
সাহিত্যে ফারসি শব্দ—
মধ্যযুগের শেষ অংশে অর্থাৎ ১৮ শতকের আগে পরে প্রচুর পরিমাণে পুঁথি সাহিত্য রচিত হয়েছে। এতে মুসলিমদের গৌরবগাঁথা বর্ণনা করা হয়েছে, আর সেই বর্ণনায় ব্যবহার করা হয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফারসি, আরবি, উর্দুর মতো শব্দ। মূলত মুসলমানরা ক্ষমতা হারানোর পর থেকে ভাষা দিয়ে যে নিজেদের ক্ষমতা প্রকাশ করতে চেয়েছে সাহিত্যকর্মের মধ্যেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। কারণ এর আগে চর্যাপদ বা শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মতো মধ্যযুগের সাহিত্যে ফরাসি শব্দের প্রয়োগ প্রায় ছিলই না। ফলে রাজভাষা হওয়ার পরও যে তা জনসাধারণ খুব বেশি গ্রহণ করেছিল, তা বলা যায় না।
“রাজভাষা হিসেবে ফারসির গ্রহণযোগ্যতা তখন থেকেই শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু জনসাধারণের মধ্যে- মধ্যযুগের শেষের ২০০ বছর ছাড়া- বিদেশি শব্দের হার খুবই সামান্য বা নেই বললেই চলে”, বলেন ড. মনজুর। অন্যদিকে মধ্যযুগের শেষ দিকে এসে এই দৃশ্য অনেকটাই বদলে যায়।
“লাইলী-মজনু, এমনকি আরবি প্রভাবিত চতুর্দশ শতকে শাহ কবি শাহ মুহম্মদ সগীরের রচিত সাহিত্য- ইউসুফ জুলেখাও হয়ে ওঠে ফারসি প্রভাবিত”, বলেন ড. মিশু। আধুনিক সাহিত্যকদের মধ্যে কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার লেখায় প্রচুর ফারসি শব্দের ব্যবহার করেছেন। তবে বাংলা ভাষায় বর্তমানে প্রচলিত বিদেশি শব্দগুলোকে আর ওই ভাষার শব্দ নেই বলেই মত ভাষাবিদদের। কেননা ভাষার স্বাভাবিক নিয়মে যখন কোন একটি ভাষার মধ্যে অন্য ভাষার শব্দ ঢুকে, তখন শব্দটি ওই ভাষারই হয়ে যায়।
ফলে জরিমানা, কাগজ, গোলাপের মতো বহুল ব্যবহৃত ফারসি শব্দগুলো এখন বাংলা শব্দ হিসেবেই বিবেচিত হবে। কেবল এগুলোর ব্যুৎপত্তি খুঁজতে গেলে বিভিন্ন উৎস পাওয়া যাবে। বর্তমানে এগুলো বাংলা ভাষারই সম্পদ। আর এগুলো বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করছে বলেই মত ভাষাবিদদের।
রাজভাষা ইংরেজি—
ইংরেজদের আমলেও ফারসি রাজভাষা ছিল বলে জানান ড. সামাদ। ইংরেজরা শাসন গ্রহণের পর প্রায় ১০০ বছর বাংলায় এটিই ছিল রাজভাষা। খাজনা আদায় কিংবা সরকারি দপ্তরের কাজে তখনও ফারসিরই প্রচলন ছিল। কিন্তু সেই দৃশ্যপট বদলে যায় ১৮৩৬ সালে।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ‘বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত’ বইতে বলা হয়েছে, ১৮৩৬ সালে ফারসির পরিবর্তে ইংরেজিকে প্রধান এবং বাংলাকে দ্বিতীয় রাজভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এরপরই বাংলায় ফারসির প্রভাব কমতে থাকে। মূলত অফিস-আদালত থেকে শুরু করে স্কুলে পর্যন্ত সব জায়গায় ইংরেজি চালুর ফলে একদিকে ফারসির চর্চা যেমন কমে আসে, একইসঙ্গে শুরু হয় ইংরেজির আধিপত্য।
বদলেছে বাস্তবতা—
তবে একালে এসে বাংলা ভাষায় সবচেয়ে বেশি বিদেশি শব্দের দখল হারিয়েছে ফারসি। বর্তমানে বিদেশি শব্দের মধ্যে ইংরেজি ভাষার শব্দই সবচেয়ে বেশি আছে বলে মনে করেন ভাষাবিদরা। তবে এই পরিবর্তন কেবল বাংলার ক্ষেত্রেই হয়নি। চীন, জাপানের মতো যে ভাষাগুলো বিদেশি শব্দ গ্রহণে বরাবরই অনীহা দেখিয়েছে, সেগুলোতেও ইংরেজি শব্দ বেশ ভালো মাত্রায় ঢুকে পড়েছে।
বিশেষ করে শিল্প বিপ্লবের পর যে অঞ্চলেই ব্রিটিশ শাসন ছড়িয়েছে তথা ইংরেজরা উপনিবেশ তৈরি করেছে সেখানেই ইংরেজির ভাষার বিস্তারের জন্য তারা নানা উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বজুড়ে যে ইংরেজির আধিপত্য দেখা যাচ্ছে, তার রেশ বাংলাতেও পড়েছে বলে মনে করছেন ভাষাবিদরা। [সূত্র: বিবিসি বাংলা]