ছদাহা ডিজিটাল লাইব্রেরি: একটি স্বপ্নের যাত্রা
অনেকদিন পর গ্রামে এসে চায়ের আড্ডা বসেছে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের। আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে উঠে আসছে গ্রাম নিয়ে প্রত্যেকের স্বপ্ন ও প্রত্যাশার কথা। আবার অনেকেই প্রকাশ করেন গ্রাম নিয়ে চরম হতাশার কথা। আড্ডার ফাঁকেই একজন বলেন; অনলাইন আসক্তি গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের চূড়ান্তভাবে পড়াশোনা বিমুখ করে তুলেছে। তার সাথে সুর মিলিয়ে আরেকজন বলেন; গ্রামে অনেক বই পড়ুয়া আছে কিন্তু পাঠ্য বইয়ের বাইরে তেমন কোন সাহিত্য গ্রামে পাওয়া যায় না ফলশ্রুতিতে অনেকের আগ্রহ থাকলেও পড়তে পারে না কাঙ্ক্ষিত বইটি। সেই চায়ের আড্ডা থেকে উঠে আসে গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের জন্য প্রযুক্তিনির্ভর একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার আলাপ। সেই চায়ের আড্ডায় দেখা স্বপ্নের বাস্তব রূপ আজ সবার সম্মুখে।
‘বিনামূল্যে বই পড়ুন ঘরে বসে’ এই স্লোগান ধারণ করে চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত সাতকানিয়া উপজেলায় অবস্থিত ছদাহা ইউনিয়নে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রযুক্তিনির্ভর ভিলেজ কমিউনিটিতে দেশের প্রথম স্মার্ট লাইব্রেরি ‘ছদাহা ডিজিটাল লাইব্রেরি’। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এলাকার কিছু স্বপ্নবাজ তরুণ 'ছদাহা ডিজিটাল লাইব্রেরি' র উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে এসেছে বই বিমুখ এই প্রজন্মের হাতে হাতে বই তুলে দিতে। গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের জ্ঞান-নির্ভর, যুক্তিবাদী ও স্মার্ট সিটিজেন হিসেবে গড়ে তুলার অমোঘ প্রত্যয়ে পথচলা শুরু এই লাইব্রেরির
বলা হয়ে থাকে একটি ভালো বই একটি জনপদ পরিবর্তনের যথেষ্ট। সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে একটি জাতিকে সফলতার হিমাদ্রি শিখরে আরোহণের পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে বই। বই পড়ুয়া শিক্ষার্থী বাংলাদেশের সর্বত্র থাকলেও সবজায়গায় বই সহজলভ্য না। শহুরে জনপদের শিক্ষার্থীরা হাতের নাগালে কাঙ্ক্ষিত বইটি পড়ার জন্য পেলেও গ্রামীণ জনপদে বই ঠিক ততটাই দুষ্প্রাপ্য। তাই বরাবরের মতই গ্রামে অসংখ্য বই পড়ুয়া ও বই পড়তে আগ্রহী শিক্ষার্থী থাকা স্বত্বেও বইয়ের অপ্রতুলতার কারণে থেকে যান বইয়ের সাধ গ্রহণ থেকে বঞ্চিত। এই নিত্য বঞ্চনায় এক সময় বই হয়ে উঠে তার বিরাগভাজন। বই পড়ার যে তীব্র বাসনা সেটা বিনষ্ট হয় অঙ্কুরেই।
অপরদিকে প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে বইয়ের স্থান হয়েছে সুরম্য শেল্ফে বা লাইব্রেরির চার দেয়ালে। শিক্ষার্থীরা পাঠ্য বইয়ের বাইরের যে বিশাল সাহিত্য জগত তার সাথে অপরিচিতই থেকে যায়। তাদের একমাত্র ধ্যান জ্ঞান হয়ে পড়েছে স্মার্ট ফোন এবং এতে থাকা ‘বদনবই’ (ফেসবুক) ও ভিডিও গেইমস। এইসব প্রযুক্তি নির্ভর থ্রিডি দুনিয়ায় আসক্ত হয়ে শিক্ষার্থীরা হয়ে পড়েছে মারাত্মক বই বিমুখ। তৈরি হয়েছে এক বই বিমুখ প্রজন্ম।
এই দুই প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে ছদাহা ডিজিটাল লাইব্রেরির পথচলা। এই লাইব্রেরির অধীনে প্রত্যেক শিক্ষার্থী খুব সহজেই নিজের পছন্দের বইটি পড়তে পারবে
কিভাবে সদস্য হতে হয়?
প্রাথমিকভাবে ছদাহা ইউনিয়নের যেকোনো নাগরিক www.digitallibrary.chadaha.com লিংকে গিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে পারবেন। এডমিন প্যানেল তথ্য নিশ্চিত করে এপ্রোভ করলেই সেই ব্যক্তি ছদাহা ডিজিটাল লাইব্রেরির সদস্য হয়ে যাবেন। তাঁর নামে ওয়েবসাইটে আলাদা প্রোফাইল তৈরি হবে। যেটি ব্যবহার করে তিনি বই আদান-প্রদান করতে পারবেন। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য এই অভূতপূর্ব সেবা পেতে শিক্ষার্থীকে গুনতে হবে না কোন টাকা পয়সা। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এই সেবা গ্রহণ করতে পারবে ঘরে বসেই।
কিভাবে বই আদান প্রদান করা হয়?
যেকোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইটে প্রবেশ করার পর সেখানে নির্দিষ্ট ক্যাটাগরিতে বইয়ের ছবিসহ তালিকা দেখতে পাবেন। বইয়ের ছবিতে ক্লিক করলেই সেখানে বইটি পড়ার জন্য আবেদনের অপশন পাবেন। অপশনে গিয়ে বই গ্রহণের বিস্তারিত ঠিকানা ও সময় উল্লেখ করবেন। ব্যক্তির আবেদনের প্রেক্ষিতে 'বই বন্ধু' নির্ধারিত স্থানে বইটি ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দিবেন। বই আদান-প্রদানের জন্য শিক্ষার্থীকে কোন অর্থ প্রদান করতে হবে না। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে হাতের নাগালে কাঙ্ক্ষিত বইটি পৌঁছে যাবে তাঁর বাড়ির দরজায়।
বই বন্ধু, হ্যাঁ, শিক্ষার্থী যাতে বইটি ঘরে বসেই পেয়ে যায় তার জন্য কাজ করছে আরও একদল উদ্যমী সেচ্ছাসেবী। যাদেরকে আমরা 'বই বন্ধু' হিসেবে চিনবো। ওয়েবসাইটে প্রত্যেক বই বন্ধুর ফোন নম্বরসহ যোগাযোগের বিস্তারিত তথ্য সংযুক্ত আছে। বই আদান-প্রদান সংক্রান্ত যেকোনো বিষয়ে বই বন্ধু আন্তরিক সহযোগিতা করবে। ছদাহা ডিজিটাল লাইব্রেরির শুরু থেকেই বই বন্ধু হিসেবে সবার বাড়ি বাড়ি বই পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পালন করছেন বান্দরবন সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মুহাম্মদ ইয়াসিন আরাফাত। তাঁর স্বপ্ন গ্রামের প্রতিটি শিক্ষার্থীর হাতে বই তুলে দেয়া। তিনি বলেন: বই বিমুখ এই প্রজন্মের হাতে বই তুলে দিতে পারার চেয়ে আনন্দের আর কিছু হতে পারে না। আমি এই কাজে নিজেকে যুক্ত করতে পেরে গৌরব বোধ করি।
বই পড়াকে আন্দোলনে রূপ দিতে ছদাহা ডিজিটাল লাইব্রেরী গ্রহণ করেছে বই কেন্দ্রিক ব্যতিক্রমধর্মী আয়োজন। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বই আড্ডার আয়োজন, বুক রিভিউ প্রতিযোগিতা, নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর বক্তৃতা ও রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন, কুইজ প্রতিযোগিতা, আবৃত্তি ও কবিতা, গল্প লেখা প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। এছাড়াও, শিক্ষার্থীদের দক্ষ ও যোগ্য করে গড়ে তুলার জন্য নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর প্রশিক্ষণের আয়োজন।
ভিলেজ কমিউনিটিতে দেশের প্রথম স্মার্ট লাইব্রেরির এই মহতী উদ্যোগে নেতৃত্ব দিচ্ছে একদল সাবেক ও বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ। তারা হলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ে সদ্য স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা মোহাম্মদ জাহেদুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী রায়হান উদ্দীন, চট্টগ্রাম কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী জমির উদ্দীন (হা-মীম), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ জিসানুর রহমান, কমার্স কলেজ চট্টগ্রামের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী এহসানুল কবির এহসান, চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ রিদুওয়ান, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের দা'ওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী ইমদাদ-উল-লাহ, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের ইকনোমিকস এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল জাবের, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী তারেক মুনাওয়ারসহ আরও অনেকে।
বর্তমান সরকার ঘোষিত স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের এই অগ্রযাত্রায় গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের স্মার্ট সিটিজেন হিসেবে গড়ে তুলার মহান লক্ষ্যে কাজ করছে ‘ছদাহা ডিজিটাল লাইব্রেরি’। জ্ঞান নির্ভর পড়ুয়া প্রজন্ম তৈরির মাধ্যমে আদর্শ গ্রাম ও সর্বোপরি স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে ছদাহা ডিজিটাল লাইব্রেরির এই পথচলায় আপনাদের আন্তরিক শুভকামনা প্রত্যাশী।
শিক্ষার্থী : ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।