ভারতে সিলেবাস থেকে ডারউইনের থিওরি বাদ পড়ায় ক্ষুব্ধ বিজ্ঞানীরা

  © সংগৃহীত

ভারতে জাতীয় স্তরের স্কুল পাঠক্রম থেকে চার্লস ডারউইনের প্রবর্তিত জৈব বিবর্তনবাদের তত্ত্ব (থিওরি অব বায়োলজিক্যাল ইভোলিউশন) বাদ পড়ার পর দেশের শত শত বিজ্ঞানী, গবেষক ও শিক্ষাবিদ এক খোলা চিঠিতে সেই পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করেছেন।

ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং (এনসিইআরটি) নামে যে সংস্থা দেশে সিলেবাস ‘র‍্যাশনালাইজেশনে’র কাজ করে থাকে, তারাই দশম শ্রেণির বিজ্ঞান টেক্সটবুক থেকে এই বিষয়টি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এর আগে করোনা মহামারির সময় ছাত্রছাত্রীদের ‘সিলেবাসের বোঝা’ কমানোর যুক্তিতে সাময়িকভাবে বিবর্তনবাদকে পাঠক্রমের বাইরে রাখা হয়েছিল। কিন্তু এখন সেই সিদ্ধান্তকেই স্থায়ী রূপ দেওয়া হয়েছে।

এই সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা করে ভারতের ১৮’শরও বেশি বিজ্ঞানী ও গবেষক এক খোলা চিঠিতে বলেছেন, শিক্ষার্থীদের বৈজ্ঞানিক মানসিকতা গড়ে তোলার জন্য ডারউইনের বিবর্তনবাদ বুঝতে শেখাটা অপরিহার্য।

ছাত্রছাত্রীদের বিবর্তনবাদ সম্বন্ধে জানতে না-দেওয়াটা ‘শিক্ষার নামে প্রহসন’ বলেও মন্তব্য করেছেন ‘ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটি’ নামে ওই সংগঠন, যাদের লেটারহেডে ওই চিঠিটি লেখা হয়েছে।

এই চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সেস এবং একাধিক আইআইটির মতো নামীদামী বহু প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।

স্কুলের বিজ্ঞান পাঠক্রমে যাতে বিবর্তনবাদ অবিলম্বে আবার ফিরিয়ে আনা হয়, ওই খোলা চিঠিতে সেই দাবিও জানা হয়েছে।

ডারউইনের থিওরি নিয়ে বিশ্বের বহু দেশেই অবশ্য বিতর্ক আছে, ধর্মীয় কারণে পৃথিবীর নানা দেশেই এটি স্কুল বা কলেজ পর্যায়ে পড়ানো হয় না। কিন্তু ভারতে বিজ্ঞানের সিলেবাস থেকে এটিকে বাইরে রাখার ঘটনা এই প্রথম।

দেশটির বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদরা অনেকেই মনে করছেন, যে দক্ষিণপন্থী আদর্শের দল এখন ভারতে ক্ষমতায় রয়েছে তাদের সমাজদর্শন ও ধ্যানধারণার ভিত্তিতেই এনসিইআরটি এই পদক্ষেপ নিয়েছে।

সত্যপাল সিংয়ের থিওরি
ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রথম দফার সরকারেই বিবর্তনবাদ নিয়ে তীব্র বিতর্ক উসকে দিয়েছিলেন তৎকালীন মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী সত্যপাল সিং।

মুম্বাই পুলিশের এই সাবেক কমিশনার ২০১৮ সালে দেশের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী থাকাকালীন দাবি করেছিলেন, ডারউইনের থিওরি বৈজ্ঞানিকভাবেই ‘ভুল’। তার যুক্তি ছিল, “কেউ কি কখনো দেখেছে একটা বাঁদর ধীরে ধীরে মানুষে পরিণত হচ্ছে?”

“মানুষ যখন থেকে পৃথিবীতে এসেছে, তখন থেকেই সে মানুষই ছিল” বলেও দাবি করেন তিনি। এই মন্তব্য নিয়ে হইচই শুরু হওয়ার পরও সত্যপাল সিং নিজের অবস্থান থেকে সরে আসেননি। বরং সওয়াল করেছিলেন, দেশের স্কুল-কলেজে অবিলম্বে বিবর্তনবাদ পড়ানো বন্ধ করা উচিত।

সত্যপাল সিং এখন আর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যুক্ত নন, কিন্তু দেশের সরকার তার সেই বক্তব্যই বাস্তবায়ন করছে বলে বিশেষজ্ঞরা অনেকে বলছেন।

ভারতের কোনও কোনও বিজ্ঞানী এমনও দাবি করে থাকেন, হিন্দু ধর্মশাস্ত্রে ভগবান বিষ্ণুর যে ‘দশাবতারে’র কথা বলা হয়েছে – তাতে বিবর্তনবাদ ডারউইনের থিওরির চেয়ে অনেক ভালভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

অন্ধ্র ইউনিভার্সিটির উপাচার্য জি নাগেশ্বর রাও ২০১৯ সালে ভারতের জাতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশনে বিবর্তনবাদের এই ‘দশাবতার তত্ত্ব’ প্রতিষ্ঠা করতে একটি পেপারও উপস্থাপন করেছিলেন।

ডারউইনের থিওরিকে যেভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হচ্ছে তাতে ভারতের বিজ্ঞানচর্চা তথা বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে বলেই শিক্ষাবিদরা অনেকেই মনে করছেন।

দিল্লিতে লেখক ও গবেষক দীনেশ চন্দ্র শর্মার কথায়, আজ ডারউইনকে বাদ দিয়ে জীববিদ্যা পড়ানো হচ্ছে। এরপর হয়তো নিউটন আর আইনস্টাইনকে বাদ দিয়ে ফিজিক্স পড়ানোর চেষ্টা হবে।

দেশে দেশে যে বিতর্ক
ডারউইনের থিওরি অব ইভোলিউশন বা বিবর্তনবাদ নিয়ে বিতর্ক অবশ্য দুনিয়াতে নতুন নয়। বিগত বহু দশক ধরে আমেরিকা-সহ পৃথিবীর নানা দেশে নানা ধর্মীয় সম্প্রদায় ও রক্ষণশীল গোষ্ঠী চার্লস ডারউইনের এই তত্ত্ব নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে।

তবে সিলেবাস থেকেই এই থিওরি বাদ দেওয়ার মতো চরম পদক্ষেপ নিয়েছে হাতে-গোনা মাত্র কয়েকটি দেশ, যার মধ্যে বেশির ভাগই মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়াতে।

যেমন, ভারতের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানেই ডারউইনের থিওরি খারিজ করা হয়ে আসছে বহুকাল ধরে। বিবর্তনবাদের এই তত্ত্ব সৌদি আরব, ওমান, আলজেরিয়া ও মরক্কোতে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। মধ্যপ্রাচ্যের আর একটি দেশ লেবাননেও তা পড়ানো হয় না।

জর্ডানে এটি পড়ানো হয় ধর্মীয় ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে, আর মিশর ও তিউনিসিয়ার টেক্সটবুকে এই বিবর্তনবাদকে তুলে ধরা হয়েছে ‘অপ্রমাণিত’ একটি হাইপোথিসিস হিসেবে।

ডারউইনের থিওরি নিয়ে বহু ইসলামিক ধর্মগুরু নানা সময়ে নানা ফতোয়াও জারি করেছেন। আমেরিকাতে আবার বেশ কিছু ক্যাথলিক খ্রীষ্টান গোষ্ঠী বিবর্তনবাদের বিকল্প হিসেবে ‘ক্রিয়েশনিজম’ বা সৃষ্টিতত্ত্বর পক্ষে সওয়াল করে থাকে।

এই ‘ক্রিয়েশনিজম লবি’র প্রবক্তারা বলে থাকেন মানুষ, জীবজন্তু বা বিশ্বব্রহ্মান্ডের যা কিছু সবই ঈশ্বরের সৃষ্টি – এর কখনো কোনও বিবর্তন হয়নি।

বাংলাদেশেও মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যবইয়ে ডারউইনের মতবাদের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে চলতি বছরের গোড়ার দিকেই তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছিল। সে দেশের সরকার এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেওয়ার পরও ইসলামি দলগুলো তাদের প্রতিবাদ বিক্ষোভ অব্যাহত রাখে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা


সর্বশেষ সংবাদ