প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে শেকৃবি উপাচার্যদের দুর্নীতি
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের দুর্নীতি আর অনিয়ম রয়েছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। উপাচার্যদের এসব দুর্নীতি আর অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণ হওয়া সত্বেও তাদের বিরুদ্ধে কোন ধরণের ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। নিয়োগ পাওয়া সকল উপাচার্যই কমবেশি নানা অনিয়মের সাথে যুক্ত ছিলেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসির) নির্দেশনা-সুপারিশ অমান্য করেই পার করেছেন মেয়াদ।
বিগত সকল উপাচার্যের সময়কাল বিশ্লেষণ করে জানা যায়, প্রত্যেকেই একই রকম অনিয়ম আর দুর্নীতির সাথে জড়িত। দুর্নীতির বিরুদেধ সোচ্চার থাকা ব্যক্তি নিজে উপাচার্য হওয়ার পর তিনি নিজেও সেই একই দুর্নীতিতে অভিযুক্ত। প্রত্যেক উপাচার্যই নিজের পছন্দমতো আত্মীয়-স্বজন ও দলীয় কর্মীদের নিয়োগ দিয়ে গেছেন।
নিয়োগ পাওয়া তালিকায় উপাচার্যদের সন্তান, ভাই, ভাতিজা, ভাতিজি, শ্যালক, শ্যালকের স্ত্রী, দূর সম্পর্কের চাচাতো-মামাতো ভাইও রয়েছেন। কোন ধরণের অভিজ্ঞতা ছাড়াই ভূয়া সার্টিফিকেট দেখিয়ে নির্ধারিত বয়সের পরেও চাকরি দিয়েছেন তাদের। এসব নিয়োগ দিতে সিন্ডিকেটের মাধ্যমেও টাকার আদান-প্রদান হতো বলেও কোন কোন উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে।
২০০১ সালে প্রতিষ্ঠা হয় শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার বিশ্ববিদ্যালয়টির একজন সিনিয়র শিক্ষক অধ্যাপক শাদাত উল্লাহকে উপাচার্যের দায়িত্ব দেন। এই নিয়োগের পর নিয়োগ বৈধ হয়নি অভিযোগ তুলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। এরপর সরকার পরিবর্তন হয়ে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসলে তার নিয়োগ বাতিল করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক ড. এ এম ফারুককে উপাচার্যের দায়িত্ব দেওয়া হয়। টানা দুই মেয়াদে আট বছর উপাচার্য ছিলেন তিনি।
দ্বিতীয় এই উপাচার্যের আমলে ভুয়া ও অসত্য তথ্য দিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয় একাধিক শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীকে। সেসময় তার বিরুদ্ধে নিজের আত্মীয়স্বজনকে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ উঠে। অর্থের বিনিময়ে তিনি দলীয় কর্মীদের নিয়োগ দিয়েছেন। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সংখ্যক নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগও আছে এই উপাচার্যের নামে। এনিয়ে বিশ্ববিদ্যারয় মঞ্জুরী কমিশনের কোন পরামর্শ বা সুপারিশ আমলে নেননি তিনি। সেসময় তার নামে শ্বেতপত্রও প্রকাশ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। তবুও সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়াহয়নি কোন ব্যবস্থা।
এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে চতুর্থ উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান অধ্যাপক ড. শাহ ই আলম। নিয়োগের পরেই আগের উপাচার্যের দেওয়া নিয়োগে চার জনকে চাকরিচ্যুত এবং এক জনের পদাবনতি করেন। কিন্তু কিছুদিন পরে তিনি নিজেও বিভাগীয় চেয়ারম্যানের আপত্তি উপেক্ষা করেই শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দায়িত্ব বন্টনের ক্ষেত্রেও তিনি করেছেন অনিয়ম।
এরপরে ২০১২ সালে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক নেতা অধ্যাপক শাদাত উল্লা। তিনি আগের উপাচার্যের আমলে দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। এবং পরে সেই অনিয়মে তিনিই জড়িয়ে পড়েন।
এই উপাচার্যের সময়ে বিভিন্ন উৎসবে আপ্যায়ন ব্যয় বাবদ ২ লাখ টাকা করে মোট ৯ বার বিশ্ববিদ্যালয় তহবিল থেকে টাকা তোলার অভিযোগও রয়েছে। শুধু তাই নয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থে নিজের বাড়ির ক্রোকারিজও কিনেছিলেন তিনি। সেসময় নতুন বাসভবন সংস্কারের নামে বিপুল অর্থ ব্যয়, একাডেমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগেই আবেদন নিয়ে ইন্টারভিউ কার্ড দেওয়া, তিনটি সেকশন অফিসার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে ২৪ জনকে নিয়োগ দেওয়াসহ নানান অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। অভিযোগগুলো প্রমাণিত হওয়ার পরেও শিক্ষামন্ত্রণালয়ের সুপারিশ কোন কাজে আসেনি।
পরের মেয়াদে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি প্রাক্তন উপাচার্য শাদাত উল্লাহর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন। উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি একইভাবে নানা অনিয়মে জড়ান। বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়মের পরও তিনি স্বাভাবিকভাবে উপাচার্যের পদ থেকে অবসরে যান।
ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান বলেন, জনগনের টাকায় বিশ্ববিদ্যালয় চলে। এখানে অবশ্যই জবাবদিহি থাকতে হবে। নীতি-নৈতিকতা ও পাণ্ডিত্য দেখেই উপাচার্যদের নিয়োগ দেওয়া উচিৎ। বাংলাদেশে এখনো অনেক যোগ্য শিক্ষক আছেন যাদেরকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাবে। তবুও কেন অযোগ্যদের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে এমন প্রশ্ন রাখেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের উপাচার্যদের অনিয়ম-দুর্নীতি প্রমাণ হওয়ার পরেও তারা পার পেয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ভারতে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক উপাচার্য অনিয়ম ও দুর্নীতির দায়ে গ্রেফতার হয়ে জেল খেটেছেন এমন অনেক দৃষ্টান্ত আছে। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উপাচার্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার মতো তেমন কোন ক্ষমতা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, দুর্নীতিকারী উপাচার্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আগ্রহের অভাব রয়েছে।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক ড. শহীদুর রশীদ ভুঁইয়া। তিনি গত বছর নভেম্বরে এ পদে নিয়োগ পান।