১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৯:১৭

ক্লাস না করেও পরীক্ষার সুযোগ সিকৃবির পাঁচ শিক্ষার্থীর, প্রতিবাদ করায় অধ্যাপককে চাকরিচ্যুতি!

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়  © ফাইল ফটো

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (সিকৃবি) ক্লাস না করলেও পাঁচ শিক্ষার্থীকে ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগের ব্যবস্থা করার অভিযোগ তুলেছেন সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ড. নাসরিন সুলতানা লাকী। তার অভিযোগ, এমএস ইন সার্জারি বিভাগের সাত শিক্ষার্থীর মধ্যে পাঁচজন শ্রেণিকক্ষে আসেননি। ব্যবহারিক ক্লাসের সময় ব্যক্তিগতভাবে প্র্যাকটিস করেছেন। এই অনিয়মের প্রতিবাদ করায় তাকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

তবে এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন জানিয়ে বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. অনিমেষ চন্দ্র রায় দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘যে পাঁচ শিক্ষার্থীর কথা বলা হচ্ছে তারা নিয়মিত ক্লাস করেছে। অন্য শিক্ষকরা তাদের ক্লাস নিয়েছেন। তবে ড. নাসরিন সুলতানা বিষয়টি অস্বীকার করে কী কারণে ওই শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা দিতে দেয়নি তা আমার বোধগম্য নয়। শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিতে হলে তা বিভাগীয় চেয়ারম্যানের মারফতে ডিন অফিসে দিতে হয়। তবে নাসরিন সুলতানা এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সরাসরি ডিন বরাবর অভিযোগ দিয়ে নিয়ম লঙ্ঘন করেছেন। বিষয়গুলো নিয়ে তদন্ত চলছে।’

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র ও প্রাপ্ত নথিপত্র ঘেটে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সেমিস্টারে সার্জারি ও থেরিওজেনোলজি বিভাগে এমএস ইন সার্জারি বিষয়ে সাতজন শিক্ষার্থী ভর্তি হন। অভিযোগ রয়েছে, ভর্তির পর ও এনরোলমেন্ট সম্পন্ন হওয়ার আগেই তাদের জন্য ক্লাস রুটিন প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু নির্ধারিত ক্লাস সময়ের মধ্যে ওই সাত শিক্ষার্থীর পাঁচজনকে নিয়মিত ক্লাসে পাওয়া যায়নি। এমনকি ক্লাস পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট বা শ্রেণিশিক্ষকের সঙ্গে একাডেমিক যোগাযোগও ছিল না।

উপাচার্যের তদন্ত কমিটির সুপারিশে সাময়িক বহিষ্কারের বিষয়ে বক্তব্য জানতে তদন্ত কমিটির সভাপতি সিকৃবির ভেটেরিনারি এনিম্যাল ও বায়োমেডিক্যাল সায়েন্সেস অনুষদের ডিন অধ্যাপক এ এসএম মাহবুবকে কল দেওয়া হলে সাংবাদিক পরিচয় শুনে তিনি কিছু শুনতে পাচ্ছেন না বলে জানান। পরে তার হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠানো হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।

ড. নাসরিন সুলতানা লাকীর দাবি, তিনি সংশ্লিষ্ট কোর্সের শিক্ষক ও সুপারভাইজার হওয়া সত্ত্বেও তাকে না জানিয়ে শ্রেণিকক্ষে অনুপস্থিত থাকা শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। পরে খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারেন, কেউ ক্লাসের সময় ক্লিনিক পরিচালনা করেছেন, কেউ বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ছিলেন, আবার কেউ ব্যক্তিগত কাজে বাইরে অবস্থান করেছেন। এই পাঁচ শিক্ষার্থী নিয়ম বহির্ভূতভাবে ফর্ম পূরণ করে ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পান। এমএস অর্ডিন্যান্স ২০১৭” অনুচ্ছেদ ৩.১ ভঙ্গ করে অবৈধভাবে পরীক্ষা গ্রহণ করে পরবর্তী সেমিস্টারে ক্লাশ পরীক্ষার সুযোগ দেওয়া হয়েছে যা সিকৃবি আইন ৫.৭ এর সাথে সাংঘর্ষিক। চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারির পর  কোনভাবেই শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা পদ্ধতিতে অংশ গ্রহন করার জন্য ১৮ কর্মসপ্তাহ ক্লাশ করার সুযোগ পায়নি। এ ধরনের অনিয়ম সিকৃবিতে নেই। 

জানা গেছে, ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহন করতে হলে সুপারিশকৃত কোর্স কর্মসূচীর অন্তর্ভূক্ত কোর্সের জন্য অনুষ্ঠিত ক্লাশের কমপক্ষে ৭৫% উপস্থিতি থাকতে হবে। শ্রেনি শিক্ষক ব্যতিত কেউ উপস্থিতির জন্য সুপারিশ করতে পারবেন না। তবে এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে পাঁচ শিক্ষার্থীকে পরীক্ষার সুযোগ করে দেওয়া হয়। কেন এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা জানতে চেয়ে চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি পোস্ট গ্রাজুয়েট স্টাডিজের ডিন বরাবর আবেদনের অগ্রিম কপি পাঠান অধ্যাপন নাসরিন সুলতানা। আবেদনের প্রেক্ষিতে ডিন ড. কাজী মেহেতাজুল ইসলাম বিভাগীয় চেয়ারম্যান প্রফেসর ড: মোহাম্মদ আতিকুজ্জামান বরাবর শিক্ষার্থীদের শ্রেণি উপস্থিতির শতকরা হার, ক্লাশরুম টেস্ট, এসাইনমেন্ট মার্কস চেয়ে পত্র প্রেরণ করেন। কিন্তু শিক্ষার্থীদের শ্রেণি উপস্থিতি, ক্লাশরুম টেস্ট, এসাইনমেন্ট মার্কসের রেকর্ড না থাকায় চেয়ারম্যান এসকল ডকুমেন্টস পাঠাতে ব্যর্থ হন। পরে ওই পাঁচ শিক্ষার্থীর পরীক্ষা স্থগিত করা হয়।

এ নিয়ে প্রশ্ন তুললে বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. অনিমেষ চন্দ্র রায় এবং পোস্ট গ্রাজুয়েট স্টাডিজ অনুষদের ডিনের ভূমিকা নিয়েও আপত্তি জানান ড. নাসরিন। তার ভাষ্য অনুযায়ী, শ্রেণিশিক্ষকের মতামত ছাড়াই কীভাবে পরীক্ষার ফর্ম অনুমোদন ও প্রেরণ হলো তার কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা তিনি পাননি। উল্টো তাকে তদন্তের নাম করে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে।

শিক্ষকদের একটি অংশ বলছে, নিয়ম ভাঙার প্রতিবাদ করলে যদি শাস্তি পেতে হয়, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক শৃঙ্খলা রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। তদন্তের নামে নেওয়া সিদ্ধান্ত ও সাময়িক বরখাস্তের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, নিরপেক্ষ তদন্ত ও স্বচ্ছ সিদ্ধান্ত ছাড়া এই সংকট থেকে সিকৃবি বের হতে পারবে না।

এ ঘটনায় অভিযুক্ত পাঁচ শিক্ষার্থী ও বিভাগীয় চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অধ্যাপক নাসরিন সুলতানা লাকীকে হেনস্তা ও শারীরিকভাবে ধাক্কা দেওয়ার অভিযোগও ওঠে। এর বিচার চেয়ে চলতি বছরের ৯ সেপ্টেম্বর রেজিস্ট্রার বরাবর লিখিত আবেদন করেন তিনি। ওই আবেদনের পর অধ্যাপক লাকীকে হেনস্তার ঘটনায় তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক গঠিত এই কমিটি নিরপেক্ষ ছিল না বলে ড. নাসরিন তাতে অনাস্থা জানিয়ে আবেদন করেন।  এই অভিযোগের প্রকৃত বিষয়  ভিন্ন খাতে চালানোর  অভিযোগ উঠেছে। তদন্ত হয়নি এবং  কোনো চূড়ান্ত রিপোর্ট প্রকাশ ছাড়াই গত ১০ ডিসেম্বর থেকে ড. নাসরিনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। অথচ সিন্ডিকেটের এজেন্ডায় তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল না বলে দাবি একাধিক শিক্ষকের।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘এজেন্ডাবিহীনভাবে, বহিঃসদস্য সরাসরি অনুপস্থিত রেখে শুধু ‘টেবিল এজেন্ডা’র মাধ্যমে একজন গ্রেড ওয়ান অধ্যাপককে সাসপেন্ড করা গুরুতর প্রক্রিয়াগত অনিয়ম। এটি প্রশাসনিক ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। তাকে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগ না দিয়েই শাস্তিমূলক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা ‘ন্যাচারাল জাস্টিস’-এর পরিপন্থী।

অধ্যাপক ড. নাসরিনে সুলতানা বলেন, “আমি শুধু নিয়ম মানার কথা বলেছি। এর বিনিময়ে আমাকে অপমান, হয়রানি ও শেষ পর্যন্ত চাকরিচ্যুতির মুখোমুখি হতে হলো।’ ড. অনিমেষের প্রশ্নে অধ্যাপক নাসরিন বলেন, অনিমেষ প্রথমবার চেয়ারম্যান হয়েছে সে সকল কিছু সঠিক হয়ত জানেনা, তিনি সত্য বলেননি।

তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের আবেদনের কোন প্রকার সুযোগ না থাকা সত্ত্বেও সেটি উল্লেখ করেছেন অথচ মিটিংয়ে সেটি উত্থাপন করা হয়নি। ফাইনাল পরীক্ষার সময় শেষ হওয়ার পর নিয়ম বহির্ভূতভাবে সেমিস্টারের ক্লাশ-টার্ম পরীক্ষা, এসাইনমেন্ট গ্রহনের জন্য বাধ্য করতে না পেরে নানাবিধ পন্থায় তাকে হয়রানি, নাজেহাল ও অপমান করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও অধ্যাপক ড. নাসরিন সুলতানা লাকীকে নানাভাবে বাধা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কমিটির নথিপত্র হস্তান্তর নিয়েও জটিলতা সৃষ্টি করা হয়েছে, যা প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

সিকৃবির এই ঘটনায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও প্রশাসনের মধ্যে তীব্র অস্থিরতা বিরাজ করছে। শিক্ষকদের একটি অংশ বলছে, নিয়ম ভাঙার প্রতিবাদ করলে যদি শাস্তি পেতে হয়, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক শৃঙ্খলা রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। তদন্তের নামে নেওয়া সিদ্ধান্ত ও সাময়িক বরখাস্তের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, নিরপেক্ষ তদন্ত ও স্বচ্ছ সিদ্ধান্ত ছাড়া এই সংকট থেকে সিকৃবি বের হতে পারবে না।

ক্লাস না করে পরীক্ষায় বসার সুযোগ নেই। সেজন্য শিক্ষার্থীদের পরবর্তীতে পরীক্ষার সুযোগ দেওয়া হয়নি জানিয়ে সিকৃবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. আলিমুল ইসলাম দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘নাসরিন সুলতানা লাকী এবং ড. অনিমেষের বিষয়টি গত ১২-১৩ মাস ধরে চলছে। ড. অনিমেষের বিরুদ্ধেও তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। তবে ওই কমিটি ড. অনিমেষের বিরুদ্ধে এমন কোনো সুপারিশ করেনি। চারজন ডিনের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি নাসরিন সুলতানা লাকীকে সাময়িক বরখাস্ত করার সুপারিশ করেছে। নাসরিন সুলতানা লাকীর কারণে শিক্ষার্থীরা এই বিভাগে ভর্তি হতে চাচ্ছেন না। সেজন্য বিষয়টি অধিকতর তদন্তের জন্য তাকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তিনি অপরাধী না হলে তার আগের সম্মান তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে।’

উপাচার্যের দাবি অনুযায়ী কোনো শিক্ষার্থী ভর্তির তথ্য যাচাই করতে গিয়ে দেখা যায়, এমএস ইন সার্জারি বিষয়ে সেপ্টেম্বর-ফেব্রুয়ারি ২০২৫/২০২৬ সেমিস্টারের দুজন শিক্ষার্থীর সুপারভাইজার ছিলেন ড. নাসরিন সুলতানা লাকী।

উপাচার্যের তদন্ত কমিটির সুপারিশে সাময়িক বহিষ্কারের দাবি সত্য নয় বলে জানা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, তদন্ত কমিটি অধ্যাপক ড. নাসরিন সুলতানা লাকীকে সাময়িক বহিষ্কারের কোনো সুপারিশ করেনি। এছাড়া অনাস্থাপত্র প্রদান করার পর তারা কোনপ্রকার তদন্তও করেনি।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে তদন্ত কমিটির সভাপতি সিকৃবির ভেটেরিনারি এনিম্যাল ও বায়োমেডিক্যাল সায়েন্সেস অনুষদের ডিন অধ্যাপক এ এসএম মাহবুবকে কল দেওয়া হলে সাংবাদিক পরিচয় শুনে তিনি কিছু শুনতে পাচ্ছেন না বলে জানান। পরে তার হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠানো হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) আলিফ রুদাবা দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘বিষয়টি অধ্যাপক নাসরিন আমাকে মৌখিকভাবে জানিয়েছেন। এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’