ক্যাম্পাসে রাজনীতি নিষিদ্ধ হলেও বাকৃবিতে ছাত্রদলের দাপট
শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে গত ২৮ আগস্ট বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) সব ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ক্যাম্পাসে রাজনীতি নিষিদ্ধ হলেও রাজনৈতিক দলের নামে নিজেদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল। বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সকল ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ হওয়ার পরেও ছাত্রদল প্রকাশ্যে সকল দলীয় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে ২৫ অক্টোবর শুক্রবার মধ্যে রাতে ৩টি আবাসিক হলের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল করেছেন।
একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, গতকাল (শুক্রবার) কৃষি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার্থীদের মাঝে ছাত্রদলের নাম ও জিয়াউর রহমানের ছবি সম্বলিত পানির বোতল ও দলের নাম লেখা কলম বিতরণ করেছেন ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। পরবর্তীতে তাদের ওই কার্যক্রম নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণাও করেন তারা। এছাড়াও কৃষি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার আগের দিন বাকৃবি শাখা ছাত্রদলের প্রটোকলে বিভিন্ন সমিতির স্টল পরিদর্শন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ. কে. ফজলুল হক ভূঁইয়া। ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের তথ্য ও সহায়তা প্রদান করার জন্য স্টলগুলো পরিদর্শনের সময় উপাচার্যের সাথে ছিলেন বাকৃবি শাখা ছাত্রদলের আহবায়ক মো. আতিকুর রহমান , সদস্যসচিব মো. শফিকুল ইসলামসহ ছাত্রদলের অন্যান্য নেতাকর্মীরা। ছাত্রদলের এ সকল কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে পেরে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
পরে গতকাল মধ্যরাতে ক্যাম্পাসে লেজুড়বৃত্তিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন ফজলুল হক হলের শিক্ষার্থীরা। পরবর্তীতে রাত দেড়টার দিকে মিছিলে যোগ দেন শহীদ শামসুল হক হল ও জামাল হোসেন হলের শিক্ষার্থীরা। প্রায় তিনশতাধিক শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে ওই মিছিল নিয়ে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে আসেন তারা। এসময় ‘রাজনীতির বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘রাজনীতির দোসররা হুঁশিয়ার সাবধান’-সহ রাজনীতির বিরুদ্ধে নানা স্লোগান দিতে থাকেন তারা।
বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফজলুল হক হলের এক শিক্ষার্থী জানান, ‘ফজলুল হক হলে যে সকল শিক্ষার্থীরা আগে ছাত্রলীগ করতেন তারাই এখন ছাত্রদলের রাজনীতি করার জন্য অন্যদেরকে আহ্বান করছেন। অনেকদিন ধরেই ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের সাথে লিয়াজোঁ করে এই অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। গতকাল ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে ছাত্রদলের নামে পানি বিতরণ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটির প্রচারণা দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন হলের শিক্ষার্থীরা। পরে লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন তারা।’
শামসুল হক হলের একাধিক শিক্ষার্থী জানান, ছাত্রদলের নামে পানি ও কলম বিতরণের ঘটনাটি প্রশাসনকে জানানোর পরেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ছাত্রদলের এ সকল কর্মকাণ্ডকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রশ্রয় দিচ্ছেন বলেই আমরা মনে করছি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পরে শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে অর্জিত এই রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসে আবার লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির আবির্ভাবকে কিছুতেই মেনে নেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন তারা।
এর আগেও গত ৭ সেপ্টেম্বর ছাত্রদলের ব্যানারে আবরার ফাহাদের মৃত্যুবার্ষিকীতে মৌন মিছিল করেন ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। সেসময় ছাত্রদলের ওই কার্যক্রমের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মো. আবদুল আলীম জানিয়েছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দলীয় ব্যানারে অনুষ্ঠান করার নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা ভালোভাবে বুঝতে পারেননি। তারা সামনে এ ধরনের কাজ আর করবেন না।
কিন্তু নিয়মিতই ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় তাদের আড্ডা দিতে দেখা যায়। এরপরেও আবার এই ভর্তি পরীক্ষার সময় তারা দলীয় নাম ব্যবহার করে পানি ও কলম বিতরণ করেছেন এবং সেটি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনেই। বারবার তারা দলীয় নামে বা ব্যানারে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাচ্ছেন, কিন্তু প্রশাসন কিছুই করছে না। এজন্যে প্রশাসনের কার্যক্রমকেই প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষার্থীরা, বলছেন প্রশাসনের ছত্রছায়ায় হচ্ছে এসব কার্যক্রম।
এ বিষয়ে বাকৃবি শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক মো. আতিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের রাজনীতি করি। আমাদের কাজটা হল ওনার বার্তা সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়া। আমরা এটা মিছিল মিটিংয়ের মাধ্যমে না করে ভালো কাজের মাধ্যমে করার চেষ্টা করি। তবে আমরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কোনোকিছু করিনি। গরমের মধ্যে সাধারণ শিক্ষার্থী ও পরীক্ষার্থীদের পানি খাওয়ানোর উদ্দেশ্য থেকেই এই উদ্যোগ নেওয়া।’
ছাত্রদলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে প্রশাসনের জবাবদিহিতা চেয়েছেন শিক্ষার্থীরা। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মো. আবদুল আলীম বলেন, ‘ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা প্রক্টরিয়াল বডিকে জানিয়েছে যে, তারা কোনো দলীয় ব্যানারে বা দলের নামে স্টল দেবে না। তাদের পানির বোতল বা কলমগুলো আমরা যাচাই করে দেখি নি, এটি আমাদের ভুল হয়েছে। শিক্ষার্থীরা প্রশাসনের সাথে আলোচনা না করেই মিছিল করেছে, যা একেবারেই কাম্য নয়। রাত দুইটা পর্যন্ত তারা মিছিল করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায় অনেক অসুস্থ ব্যক্তি আছেন, ছোট বাচ্চারা আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকা থেকে গতকাল রাতে প্রক্টরিয়াল বডির কাছে অনেক অভিযোগও এসেছে। আমি সার্বিক নিয়ে আলোচনায় বসব।’
এ বিষয়ে জানার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ. কে. ফজলুল হক ভূঁইয়ার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ব্যস্ত আছেন বলে জানান। পরবর্তীতে তাকে একাধিকবার মুঠোফোনে কল করা হলেও তার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় নি।