শিক্ষার্থী আন্দোলন আর ছাত্রলীগের মারামারিতে কেটেছে বাকৃবির বছর
ইতিবাচক ও নেতিবাচক নানা ঘটনায় শেষ হয়েছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) বিদায়ী বছর। গেল বছরে ছাত্রী নির্যাতন, শাখা ছাত্রলীগের মারামারি, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, হল নির্মাণে চাঁদা দাবি, স্পিডব্রেকারে ভোগান্তির মতো ঘটনা ঘটেছে। এর বাইরেও অনেক নেতিবাচক ঘটনায় বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল বিশ্ববিদ্যালয়টি। বাকৃবির এসব আলোচিত ঘটনা নিয়ে সাজানো হয়েছে এ সালতামামি। আজ থাকছে প্রথম পর্ব।
শিক্ষক লাঞ্ছিত
গেল বছরের শুরুতে ১০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক পূর্বা ইসলামের কক্ষে ঢুকে পড়েন ছাত্রলীগ নেতা খন্দকার তায়েফুর রহমান রিয়াদ ও তার অনুসারীরা। সেখানে তারা ভেটেরিনারি অনুষদের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আফতাব দূর্বারকে মারধর শুরু করেন। এ সময় বাধা দিতে গেলে ড. পূর্বা ইসলাম ও সহকারী প্রক্টর অধ্যাপক আফরিনা মুস্তারিকেও লাঞ্ছিত করা হয়।
ছাত্রীদের সড়ক অবরোধ
৭ মার্চ রাত সাড়ে ৮টার দিকে পানি সংকট নিরসন ও পরিষ্কার পানির দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন সুলতানা রাজিয়া হলের শিক্ষার্থীরা। হলের প্রধান ফটকের সামনের সড়ক অবরোধ করেন ওই হলের অর্ধশতাধিক ছাত্রী। ওই সময় তারা বিভিন্ন অভিযোগ লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে সড়কে অবস্থান নেন।
ছাত্রলীগের সঙ্গে বহিরাগতদের সংঘর্ষ
২২ ফেব্রুয়ারি দুপুরে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের পোস্টার লাগানোকে কেন্দ্র করে বাকৃবি শাখা ছাত্রলীগ ও বহিরাগতদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জব্বারের মোড়ে এ ঘটনার সূত্রপাত হয়। এ ঘটনায় একজন বহিরাগতসহ তিনজন আহত হন।
ত্রিভুজ প্রেমে দুপক্ষের মারামারি
২ জুন প্রেম বিষয়ক ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে বহিরাগত দুপক্ষের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এ সময় বাকৃবির শিক্ষার্থীরা বাধা দিতে গেলে বিষয়টি মারামারির দিকে মোড় নেয়। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষার্থীসহ মোট তিনজন আহত হন।
১৯ শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ৬০৩ জন শিক্ষকের মধ্যে শিক্ষা ছুটিতে রয়েছেন ১০৮ জন। সে হিসেবে ১৭.৯১ শতাংশ শিক্ষক ছুটিতে রয়েছেন। এছাড়াও নির্দিষ্ট সময়ে ফিরে না আসার কারণে ১৯ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। অন্য শিক্ষকরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্যই ছুটি নিয়েছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মো. অলিউল্লাহ।
ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ করে দুই অনুষদের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন
সমন্বিত বিএসসি ইন ভেটেরিনারি সায়েন্স অ্যান্ড অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি ডিগ্রি চালুর দাবিতে ৪৪ দিন ধরে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে আন্দোলন করে ভেটেরিনারি অনুষদের শিক্ষার্থীরা। ফলে ৫ জুন থেকে বন্ধ হয় অনুষদের সকল শিক্ষা কার্যক্রম। পাশাপাশি সমন্বিত ডিগ্রি চালু না করার দাবিতে গত ৭ জুন থেকে টানা আন্দোলন শুরু করে পশুপালন অনুষদের শিক্ষার্থীরাও। পরবর্তীতে তাদের ক্লাস পরীক্ষা আবার স্বাভাবিক হয়।
হল নির্মাণে ৩০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি
বাকৃবির নির্মাণাধীন শেখ রেহানা হল নির্মাণকাজ বন্ধের হুমকি দিয়ে ৩০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগ উঠে প্রকৌশল শাখার পূর্ত, নির্মাণ ও সংরক্ষণ বিভাগের উপ প্রধান প্রকৌশলী মো. আল মামুনের বিরুদ্ধে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে টাকার বিনিময়ে বিল করিয়ে নেওয়া, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ করতে নিরুৎসাহিত করা, ঠিকাদারের লোকজনের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণসহ নানা অভিযোগ তোলেন শেখ রেহানা হলের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাইট প্রকৌশলী মো. আনোয়ার বিন আরাফাত। তবে সম্পূর্ণ বিষয়টি মিথ্যা ও বানোয়াট বলে দাবি করেন প্রকৌশলী আল মামুন।
বাকৃবির হেলথ কেয়ার সেন্টার বন্ধ
বাকৃবি শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য প্রতিষ্ঠিত হেলথ কেয়ার সেন্টার নানা সমস্যায় জর্জরিত। সময়মতো ডাক্তার না থাকা, প্রয়োজনীয় ওষুধ না পাওয়া ও ডাক্তারদের দুর্ব্যবহারসহ নানা অভিযোগের প্রেক্ষিতে ১৮ সেপ্টেম্বর একবেলা হেলথ কেয়ার সেন্টার বন্ধ রাখেন শিক্ষার্থীরা।
তুলে ফেলা হয়েছে ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরীণ সড়কের স্পিডব্রেকার
যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা জোরদারে ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোয় বসানো হয় স্পিডব্রেকার। কিন্তু নিরাপত্তার জন্য স্থাপন করা সেই স্পিড ব্রেকারগুলোই শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির কারণ হয়ে ওঠে। এসব স্পিডব্রেকার তুলে ফেলার দাবি জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একাংশ। পরবর্তীতে দাবির মুখে তুলে ফেলা হয় স্পিডব্রেকার।
নির্মাণাধীন অ্যানিমেল শেড ভাঙচুর
২৬ মে গভীর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের ব্যাডমিন্টন কোর্টের সামনে ফিজিওলজি বিভাগের নির্মাণাধীন অ্যানিমেল শেড ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। তবে ভাঙচুরের ঘটনার সময় নিরাপত্তাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন না বলে জানা যায়। এ ঘটনার সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজও পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ করেছেন বিভাগ সংশ্লিষ্টরা।
দুই হলের ছাত্রলীগ কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ
৫ নভেম্বর দিবাগত রাত ১টার দিকে আবাসিক শহীদ নাজমুল আহসান হল ও শামসুল হক ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি খন্দকার তায়েফুর রহমান রিয়াদ ও সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান এসে সমস্যার সমাধান করেন।
মেয়াদ শেষ হলেও পূর্ণাঙ্গ হয়নি ছাত্রলীগের কমিটি
বাকৃবি শাখা ছাত্রলীগের এক বছর মেয়াদি আংশিক কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে গত বছরের ২৮ এপ্রিল। কিন্তু মেয়াদ শেষ হয়ে দেড় বছর গড়ালেও গঠিত হয়নি পূর্ণাঙ্গ কমিটি। এদিকে হল কমিটি গঠনের আগেই হয়েছে অনুষদ কমিটি। এ নিয়ে পদবঞ্চিত অনেক নেতাকর্মীই ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
দপ্তরবিহীন পদে নিয়োগ
বাকৃবি বিভিন্ন বিভাগ ও শাখায় প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। সম্প্রতি এ নিয়োগ ব্যবস্থায় ১১ বছরে ডিগ্রিপ্রাপ্ত প্রার্থীকে চাকরি দেয়াসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্যহীন দপ্তরে নিয়োগ দেওয়া হয় উপ-উপাচার্যের একান্ত সচিব ও সেকশন অফিসার। এ নিয়ে অসন্তোষ দেখা দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন মহলে।
সোনালী দলের মিছিলে ছাত্রলীগের ধাওয়া
১৪ নভেম্বর বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন সোনালী দলের মৌন মিছিলে বাধা ও ধাওয়া করে শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সোনালী দলের মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের করিডোরে উপস্থিত হলে ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদকসহ শতাধিক নেতাকর্মীর বাধা ও ধাওয়ার মুখে পড়েন সোনালী দলের শিক্ষকরা।
সাংবাদিকের উপর হামলা
২১ নভেম্বর সাংবাদিকের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িয়েছিলেন বাকৃবির কৃষি অনুষদ ছাত্র সমিতির সভাপতি শাহীনুর রেজা (সুমন)। পরে ফের তার হামলার শিকার হন বাকৃবি সাংবাদিক সমিতির সভাপতি ও দৈনিক সমকালের প্রতিনিধি আশিকুর রহমান। এর আগেও সাংবাদিকের ওপর হামলা ও নিরাপত্তাকর্মী মারধরসহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে শাহীন সুমনের বিরুদ্ধে। মারধরের ঘটনাগুলো নিয়ে তদন্ত কমিটি হলেও বিচারের মুখ দেখেনি একটিও।
মধ্যরাতে ছাত্রী নির্যাতন
২২ নভেম্বর তাপসী রাবেয়া হলের এক ছাত্রীকে মধ্যরাতে জোর করে ডেকে নিয়ে নির্যাতন ও গালমন্দের অভিযোগ ওঠে ওই হলের একাধিক ছাত্রলীগ কর্মীর বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগী কৃষি অনুষদের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। তবে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করে নির্যাতনের মূল নেতৃত্বে ছিলেন ওই হলের কৃষি অনুষদের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী এবং ছাত্রলীগ কর্মী হাফসা তাসনিম। তবে বিষয়টি অস্বীকার করেছে হাফসা।
মাদক সেবনকালে আটক পাঁচ
৬ ফেব্রুয়ারি কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) লুৎফুর রহমান জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তাকর্মীর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার্থী তিনজন ছেলে ও দুজন মেয়ে রাত ১০টা থেকে নদীর পাড়ে অবস্থান করছিলেন। বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে জানানো হলে প্রক্টরিয়াল মোবাইল টিমের সহযোগিতায় তাদের আটক করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে প্রায় পাঁচ গ্রাম গাঁজা উদ্ধার করা হয়।