১০ নভেম্বর ২০২৫, ২২:৪৯

প্রথম সারির ৯ মেডিকেলে কমেছে ২০৫ আসন, সুযোগ হারাচ্ছে শিক্ষার্থীরা?

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের লোগো  © টিডিসি সম্পাদিত

দেশের বেসরকারি মেডিকেলসহ ৩৭ সরকারি মেডিকেল কলেজের আসন সংখ্যা পুনর্বিন্যাস করেছে সরকার। ২০২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষে মোট ৭২২টি আসন কমানো হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি মেডিকেল কলেজে কমেছে ৩৫৫টি আসন। বিপরীতে ৩টি মেডিকেলে বেড়েছে ৭৫ আসন। এ হিসেবে সরকারি মেডিকেলে মোট আসন কমেছে ২৮০টি। তবে প্রথম সারির ৯টি মেডিকেল কলেজের ২০৫টি আসন কমানো হয়েছে। বাকি ১৫০ আসন কমেছে পিছিয়ে পড়া ৫ মেডিকেল কলেজ থেকে।

মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের চিকিৎসা শিক্ষা-১ শাখা থেকে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল হোসেনকে সোমবার দেওয়া এক চিঠিতে এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। পরে এর আলোকে নতুন শিক্ষাবর্ষের ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে অধিদপ্তর।

বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, দেশের প্রথম সারির পুরনো ৮টি মেডিকেল থেকে ২৫টি করে আসন কমানো হয়েছে। ২৫০ থেকে আসন কমে এই ৮ প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেকটিতে আসন সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০০-তে। এগুলো হল- ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, সিলেট এমএজি ওসমানী, বরিশাল শের-ই-বাংলা, ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ এবং রংপুর মেডিকেল কলেজ। এ ছাড়া তুলনামূলক নতুন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজেও ২৩০ থেকে ৫ কমিয়ে ২২৫টি আসন নির্ধারণ করা হয়েছে। এ হিসেবে প্রথম সারির এ ৯টি মেডিকেল কলেজে কমেছে মোট ২০৫টি আসন।

প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ব্যাপক আলোচনায় থাকা হবিগঞ্জ মেডিকেল কলেজ থেকে ৫০ এবং নেত্রকোনা, নীলফামারি, নওগাঁ, মাগুরা ও চাঁদপুর মেডিকেল থেকে ২৫ করে কমিয়ে ৫০টি করে আসন নির্ধারণ করা হয়েছে। অপরদিকে আসন বাড়া তিনটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ এবং পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ। এর মধ্যে শহীদ তাজউদ্দীন এবং টাঙ্গাইল মেডিকেলে ২৫ করে বাড়িয়ে আসন দাঁড়িয়েছে ১২৫টি। আর পটুয়াখালী মেডিকেলে ২৫ বাড়িয়ে আসন নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০টি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানহীন মেডিকেল কলেজগুলোতে আসন কমিয়ে দ্বিতীয় সারির প্রতিষ্ঠানে বাড়ানো ভাল উদ্যোগ। তবে প্রথম সারির ৯টি মেডিকেল কলেজে কমানো হয়েছে ২০৫টি আসন, যা সরকারি প্রণোদনায় গরিব শিক্ষার্থীদের ভাল চিকিৎসক হওয়ার পথ রুদ্ধ করবে। দেশে বর্তমানে চাহিদার তুলনায় চিকিৎসক রয়েছে কম। ফলে বিশেষ করে প্রথম সারির সরকারি মেডিকেলে আসন কমানোয় দীর্ঘমেয়াদে আরও চিকিৎসক সংকটও তৈরি হতে পারে।

পৃথিবীর কোন দেশেরই কোন ইউনিভার্সিটি বা কোন কিছু কিন্তু সরকারি না। বড় উন্নত দেশে কোনটাই সরকারি না। সব সায়ত্তশাসিত অথবা বেসরকারি পর্যায়ের মতো আছে। সরকার তাদেরকে সময়মত প্রণোদনা দেয়। যে ভালো করে তাকে আরো বেশি দেয় পরিচালনার জন্যঅধ্যাপক ডা. মো. সৈয়দ আকরাম হোসেন, সদস্য, স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের।

তবে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর বলছে ভিন্ন কথা। জানতে চাইলে অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. রুবীনা ইয়াসমিন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, সরকারি বড় মেডিকেল কলেজগুলোর আসন কমানো হয়েছে, আমরা বলব আসনগুলো সমন্বয় করা হয়েছে। কারণ ২০২২ সালে হঠাৎ করে ১০৩০টি আসন বৃদ্ধি করা হয়েছিল। সে হিসাবে অবকাঠামো উন্নত করা হয়নি। দেখা যাচ্ছে একটি মেডিকেলের আসন ২৫০ বা ২৫০ জন শিক্ষার্থী একসাথে লেকচার গ্যালারিতে বসতে পারে, সেখানে হঠাৎ করে শিক্ষার্থী বাড়ানো হল। কিন্তু লেকচার গ্যালারিতে তার আসন বাড়ানো যায়নি। তারই পরিপ্রেক্ষিতে আসন কমানো। যেন স্টুডেন্টরা কমফর্টেবলি ক্লাস করতে পারে। যেন সুষ্ঠভাবে পড়াশোনাটা চালানো যায়। আমরা আসন শুধু কমাইনি, আসন সংখ্যা অ্যাডজাস্ট করা হয়েছে। যেখানে যতটুকু প্রয়োজন, যেমন তিনটি মেডিকেলে আসন বাড়ানো হয়েছে। যার যেরকম ক্যাপাসিটি, চেষ্টা করা হয়েছে ন্যায্যতাভিত্তিক স্টুডেন্ট সংখ্যা রাখতে।

অনেক শিক্ষার্থী মেডিকেলে পড়ার সুযোগ হারাচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিটা জিনিসকে বিভিন্নভাবে দেখার সুযোগ আছে। যদি বলেন সুযোগ হারাচ্ছে, সুযোগ হারাচ্ছে এটা সত্য। কিন্তু বড় কথা হচ্ছে, যত্রতত্র ভর্তি নিয়ে তো মানের ডাক্তার তৈরি হবে না। ডাক্তার তৈরি করতে গেলে আমাদের মানটা দেখতে হবে, মান দেখতে গেলে যা যা নিয়মনীতি আছে, নিয়মনীতি মেনে তো ভর্তি করতে হবে।

বিষয়টিকে কাছাকাছি দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখছেন স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের সদস্য ও বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) ক্লিনিক্যাল অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. সৈয়দ আকরাম হোসেন। তবে এটিকে ‘যুক্তিসঙ্গত উপায়ে’ হওয়ার উপরেই বেশি জোর দিচ্ছেন তিনি। দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে অধ্যাপক ডা. মো. সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, জনগোষ্ঠীর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সংখ্যার চাহিদা বিবেচনা করা হলে কিন্তু বাংলাদেশে ঘাটতি রয়ে গেছে। একটা যুক্তিসঙ্গত উপায়ে এ সংকটের সমাধান হতে হবে। আমি যদি মনে করি ২৮০টা আসন কমাব, সেটার পিছনে একটা ভ্যালিড যুক্তি থাকতে হবে, যা আন্তর্জাতিক মানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

দেশের শীর্ষ ৯ মেডিকেল কলেজে মোট ২০৫টি আসন কমানো হয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, স্যার সলিমুল্লাহ, রংপুর প্রতিটিতে ২৫টি করে এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলে ৫টি  আসন কমিয়ে ২২৫ নির্ধারণ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের রিপোর্টে আমরা বলেছি- ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব মেডিকেল এডুকেশনের (ডব্লিউএফএমই) মানদণ্ডে মেডিকেল কলেজগুলোকে মূল্যায়ন করতে হবে। অর্থাৎ ডব্লিউএফএমই যে মানদণ্ড ঠিক করেছে, ওই মানদণ্ডে সরকারি-বেসরকারি সকল মেডিকেল কলেজকে যাচাই করা যে তাদের অবস্থানটা আসলে কোথায় আছে। তারপর একটা সিদ্ধান্ত তৈরি করা যে- এই মেডিকেল বা ওই মেডিকেলের ঘাটতি কতখানি, ওই ঘাটতিগুলো পূরণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট মেডিকেল কলেজগুলোকে বলা। সরকারি মেডিকেল কলেজ হলে সরকার সরাসরি সিদ্ধান্ত নিবে। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলা যে- আপনাদের এই মানদণ্ড অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে, আর না নিলে আমরা একটা নির্দিষ্ট সময় পর আমরা এরকম একটা সিদ্ধান্তে যাব। এভাবে বিষয়গুলোর সমাধান করাকে অধিক যুক্তিসঙ্গত বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি।

স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের এই সদস্য বলেন, বাংলাদেশে চিকিৎসক সংখ্যা বাড়াতে হবে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। কারণ আমাদের জনগণ ও রাষ্ট্রের চাহিদা অনুযায়ী চিকিৎসক লাগবে। একই সাথে মানসম্মত চিকিৎসক লাগবে আমাদের। মানসম্মত চিকিৎসক কিভাবে আমরা তৈরি করতে পারি সে ব্যাপারে আসলে আমাদের অধিক মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।

এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়িত্ব আছে বলে মনে করেন তিনি। বলেন, রাষ্ট্রকে চিন্তা করতে হবে যে একজন চিকিৎসক তৈরি করলে সেই চিকিৎসক কত মানুষের সেবা দিবেন। রাষ্ট্রকে কিন্তু এটা আর্থিক অংকেও বিবেচনায় নিতে হবে রোগী চিকিৎসা বঞ্চিত হচ্ছে কিনা। কারণ আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের চিকিৎসকের ক্ষেত্রে সরকারি খাতে ব্যাপক ঘাটতি, বেসরকারি খাতেও ঘাটতি। পাশাপাশি আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের চিকিৎসকের বিশেষজ্ঞ পর্যায়েও কিন্তু ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। কোন জায়গাতেই বা কোন বিশেষজ্ঞ লেভেলে কিন্তু অতিরিক্ত চিকিৎসক নাই, বরং জনসংখ্যার তুলনায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা সব জায়গাতেই কম। সেটা বেসিক সাবজেক্টের কথা বলেন, প্যাথোলজি বলেন, ফার্মাকোলজি বলেন, ফিজিওলজি বলেন, বায়োকেমিস্ট্রি বলেন, সেখানে যেমন কম, আবার ক্লিনিক্যাল সাবজেক্টগুলোতেও কিন্তু বেশ কম।

অধ্যাপক আকরাম হোসেন বলেন, আমরা যদি সামগ্রিকভাবে দেখি, মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করি, তাহলে যে মেডিকেল কলেজ ভালো পারফর্ম করবে, সেটা যদি বেসরকারি মেডিকেল কলেজও হয় রাষ্ট্রের দায়িত্ব তাকে সাপোর্ট দেওয়া, তার স্টুডেন্টদের বিভিন্ন রকমের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া এবং তাদেরকে এগিয়ে নেওয়া। এটা সারা পৃথিবীতেই হয়। কারণ পৃথিবীর কোন দেশেরই কোন ইউনিভার্সিটি বা কোন কিছু কিন্তু সরকারি না। বড় উন্নত দেশে কোনটাই সরকারি না। সব সায়ত্তশাসিত অথবা বেসরকারি পর্যায়ের মতো আছে। সরকার তাদেরকে সময়মত প্রণোদনা দেয়। যে ভালো করে তাকে আরো বেশি দেয় পরিচালনার জন্য। রাষ্ট্র যদি এভাবে চিন্তা করে, তাহলে স্টুডেন্টদের উপকার হবে অনেক বেশি।

আসন কমানোর সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কিসের ভিত্তিতে বা কোন চিন্তা-ধারণার প্রেক্ষিতে এটা কমানো হয়েছে আমি জানি না। আমাদের প্রস্তাবিত প্রক্রিয়া উনারা অনুসরণ করেছেন কিনা, সে সম্পর্কে আমার সুনির্দিষ্ট কোন ধারণা নাই। আমাদের বক্তব্য ছিল প্রত্যেকটা মেডিকেল কলেজকে আমরা যেন ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব মেডিকেল এডুকেশনের মানদণ্ড অনুযায়ী যাচাই-বাছাই করি। যদি দেখি ঘাটতি আছে, তাহলে বলা যে তোমাদের এই ঘাটতি আছে, ঘাটতি পূরণ কর। যদি তারা না পারে, তাহলে ফার্স্ট ওয়ারনিং, সেকেন্ড ওয়ার্নিং, থার্ড ওয়ারনিং। আর সরকারি ক্ষেত্রে সরকার কিন্তু ঘাটতি সহজে পূরণ করতে পারে, কারণ সরকারের সে ক্ষমতা থাকে। ওইভাবে যদি প্রক্রিয়াগতভাবে জিনিসটা করা হত, তাহলে একটা জাস্টিফিকেশন দাঁড় করানো যায়।