৩০ অক্টোবর ২০২৫, ১৭:০৮

ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতিতে অন্যতম বাধা ‘ওভার প্রিপারেশন’, যেভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ফোকাস রাখব

প্রকৃতি খান  © লেখকের সৌজন্যে

আমার স্কুল ছিল মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউট, আর কলেজ বিএন কলেজ, ঢাকা। বর্তমানে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। এ জায়গায় পৌঁছানো আমার কাছে শুধু একটা সাফল্য নয়, এটা এক স্বপ্নপূরণের গল্প। 

ছোটবেলায় আব্বু ও বড় বোনের সঙ্গে বইমেলায় যাওয়া ছিল প্রতি বছরের আনন্দের অংশ। বইয়ের গন্ধ, মানুষের ভিড়, নীল আকাশ—সবকিছুই মনে রঙ ছড়িয়ে দিত। কিন্তু ফেরার পথে শুরু হতো আমার স্বপ্ন দেখার যাত্রা। আব্বু তখন আমাদের নিয়ে ঘুরতেন টিএসসি, কলা ভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরজুড়ে। তিনি নিজেও ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের গল্প বলতে বলতে আব্বুর চোখ জ্বলে উঠত। আর সেই আলোয় আমিও যেন এক অদেখা ভবিষ্যতের ছবি দেখতে পেতাম। মনে মনে ঠিক করেছিলাম, একদিন আমিও এই জায়গারই অংশ হব।

ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির সময়টা আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন, অথচ সবচেয়ে সুন্দর সময়গুলোর একটি। প্রতিদিন চেষ্টা করতাম অন্তত ১২ ঘণ্টা পড়াশোনা করার। যদিও সবসময় তা সম্ভব হতো না, কিন্তু আমি দিনের পড়া দিনেই শেষ করার চেষ্টা করতাম। একটা ছোট নোটবুকে আগের রাতে লিখে রাখতাম। পরদিন কোন বিষয়গুলো পড়ব। দিন শেষে টিক চিহ্ন দিলে মনে হতো নিজের সঙ্গে একটা ছোট জয় পেলাম, আর ক্রস দিলে মনে হতো, পরের দিন সেই জায়গাটা জয় করতে হবে।

এই দীর্ঘ প্রস্তুতির সময় আমি একটা বিষয় স্পষ্টভাবে বুঝেছিলাম, ভর্তি পরীক্ষার সবচেয়ে বড় বাধা ‘ওভার প্রিপারেশন’। আমরা অনেকেই সবকিছু মুখস্থ করার চেষ্টায় এমনভাবে জড়িয়ে পড়ি যে আসল বিষয় থেকে দূরে সরে যাই। আমি বরং চেষ্টা করতাম গুরুত্বপূর্ণ টপিকগুলোতে ফোকাস রাখতে। মূল বই আমার প্রস্তুতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল। প্রথমে মূল বই মনোযোগ দিয়ে পড়তাম, তারপর গাইড বই বা প্রশ্নব্যাংক ব্যবহার করতাম প্রশ্নের ধরন বোঝার জন্য। আগের বছরের প্রশ্নগুলো বারবার সমাধান করতাম, যাতে নিজের দুর্বল জায়গাগুলো চিনে নিতে পারি।

টাইম ম্যানেজমেন্ট আমার প্রস্তুতির আরেকটি বড় দিক ছিল। প্রতিদিনের পড়ার সময়টা ছোট ছোট ভাগে ভাগ করতাম, যাতে মনোযোগ ধরে রাখা যায়। মডেল টেস্ট দিতাম নিয়মিত, কারণ আমি জানতাম, পরীক্ষার হলে সময় বাঁচানো মানেই আত্মবিশ্বাস বাড়ানো।

এ বছর ভর্তি পরীক্ষার্থীদের সময় অনেক কম। তাই আমি আমার অনুজদের বলতে চাই, সব পড়া শেষ করার প্রতিযোগিতায় নামো না। বরং যা পড়েছ, সেটাই মনে রাখো। জানা প্রশ্ন ভুল করা, না জানা প্রশ্ন না পারার চেয়েও বেশি ক্ষতি করে। তাই রিভিশনে মনোযোগ দাও, নিজেকে বিশ্বাস করো।

মানসিক চাপও প্রস্তুতির একটা বড় অংশ। আমি মাঝে মাঝে মেডিটেশন করতাম, নামাজ পড়তাম, আর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতাম যেন মনোযোগ ধরে রাখতে পারি। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতাম কেবল আপডেটেড থাকার জন্য। অপ্রয়োজনে সময় নষ্ট করিনি। আমার মনে হয়, যারা সহজেই বিভ্রান্ত হয়, তাদের উচিত পরীক্ষার আগে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে কিছুদিন দূরে থাকা।

পরীক্ষার দিন সকালটা আজও মনে আছে। এক অজানা উত্তেজনা, ভয় আর আনন্দ একসঙ্গে কাজ করছিল মনে। আমি প্রথমেই পুরো প্রশ্নপত্র পড়ে নিয়েছিলাম। আধা ঘণ্টা ধরে যেসব প্রশ্ন সহজ মনে হয়েছিল, সেগুলো দাগিয়ে ফেলেছিলাম। তারপর ধীরে ধীরে মাঝারি ও কঠিন প্রশ্নে মনোযোগ দিয়েছিলাম। লিখিত অংশ শুরু হওয়ার আগে পাঁচ মিনিট সময় নিয়ে ভেবে নিয়েছিলাম কোন প্রশ্নে কীভাবে লিখব। এতে পরীক্ষার সময় অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী থাকতে পেরেছিলাম।

অনেকে জানতে চান, দিনে কত ঘণ্টা পড়া উচিত। আমার মতে, এটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিভেদে নির্ভর করে। কেউ ছয় ঘণ্টা পড়েও প্রস্তুত হতে পারে, কেউ হয়তো বারো ঘণ্টাও যথেষ্ট মনে করে না। আসল বিষয় হলো মনোযোগ, যতটা সময় পাওয়া যায়, সেটুকু সর্বোচ্চ কাজে লাগানো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারা আমার জীবনের এক অবিস্মরণীয় অর্জন। এই সাফল্যের পেছনে আমি তিনটি বিষয়কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। প্রথমত, সৃষ্টিকর্তা ও আমার বাবা-মাসহ যারা প্রতিটি মুহূর্তে আমার পাশে ছিলেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। দ্বিতীয়ত, নিজের প্রতি বিশ্বাস, কঠোর পরিশ্রম ও ধারাবাহিকতা। আর তৃতীয়ত, ভয় জয় করার ক্ষমতা। বিশেষ করে পরীক্ষার ভয়।

আজ যখন কলা ভবনের সামনে হেঁটে যাই, চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছোটবেলার সেই বইমেলার বিকেলগুলো। মনে পড়ে, আব্বু বলতেন, ‘একদিন তুই এখানেই পড়বি।’ এখন আমি সত্যিই এখানে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে পড়ছি। বুঝতে পারি, সেই একবাক্যের ভেতর কতটা স্বপ্ন লুকিয়ে ছিল, আর সেই স্বপ্ন পূরণে কতটা লড়াই, অধ্যবসায়, আর আত্মবিশ্বাসের দরকার হয়।

আমি বিশ্বাস করি, প্রত্যেক স্বপ্নই বাস্তব হতে পারে, যদি তুমি তাকে ভালোবাসো, তার জন্য নিয়মিত পরিশ্রম করো, আর নিজেকে বিশ্বাস করো। আমার গল্পটা হয়তো সেই বিশ্বাসেরই এক ছোট্ট প্রমাণ।

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়