মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার ট্রাম্পকার্ড হলো ইংরেজি ও সাধারণ জ্ঞান
মেডিকেল কলেজের ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের এমবিবিএসে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে ২০২৫ সালের ১৭ জানুয়ারি। কেন্দ্রে এক ঘণ্টার মেধার যুদ্ধে সাফল্যের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে মেডিকেল ভর্তিচ্ছুকদের স্বপ্ন ছোঁয়ার গল্প। তুমুল প্রতিযোগিতার এ সংক্ষিপ্ত সময়টির যথাযথ ব্যবহার ও শেষ সময়ে পরীক্ষার প্রস্তুতির নানা কৌশল নিয়ে কথা বলেছেন সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী সোয়েব সানিয়াদ খান তূর্য। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তানজিনা তন্বী।
মেডিকেলে পড়বেন, চিকিৎসক হবেন, এ স্বপ্ন কবে থেকে দেখা শুরু করেছিলেন?
সোয়েব সানিয়াদ খান তূর্য : সত্যি বলতে, আমার মেডিকেলে পড়তে চাওয়ার গল্পটা একটু ভিন্ন। ছোট থেকেই আমার ম্যাথমেটিকস যেমন প্রিয়, তেমনই বাংলা সাহিত্য বা হিউম্যান ফিজিওলোজিও খুব ভালো লাগত। তাই, মেডিকেলেই পড়তে হবে বা ইঞ্জিনিয়ারই হব; এমন কোনও ‘one way plan’ কখনোই আমার ছিল না। তবে ছোট থেকেই যে তীব্র ইচ্ছেটি ছিল আমার, তা হলো একজন কথাসাহিত্যিক বা ফিল্মমেকার হব। পড়ার ফাঁকেই টুকটাক লেখালেখি বা সিনেমা বানাব একদিন।
তো এইচএসসি যখন শেষ, তখন মনে হলো আমি কথাসাহিত্যিক বা ফিল্মমেকার যা-ই হই না কেন, উভয় ক্ষেত্রেই মানবজীবনকে কাছ থেকে দেখতে পারাটা অনেক বেশি জরুরি। তখনই উপলব্ধি করি, যদি মেডিকেলে পড়তে পারি, একদিকে যেমন বিশ্বের অন্যতম মহৎ একটি পেশায় নিজের নাম লেখাতে পারব, খুব সহজেই মানুষের জন্য আমি কাজ করে যেতে পারব; তেমনই শখের গল্পকার বা ফিল্মমেকার হতে যে জীবনকে জানার প্রয়াস, সেটিও সফল হবে বেশ ভালোভাবে। সব মিলিয়ে তাই ইন্টারমিডিয়েটের পরেই, আমার মেডিকেলে পড়বার ইচ্ছেটা আরও জোরালো হয়ে ওঠে।
এইচএসসি পরীক্ষার পর আপনি কীভাবে ভর্তি প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেন? ভর্তি কোচিং কি একজন শিক্ষার্থীর জন্য জরুরি?
সোয়েব সানিয়াদ খান তূর্য : এ দুটো প্রশ্নের উত্তর কিছুটা সাংঘর্ষিক হয়ে যাবে। তবে আমি সত্যি কথাটাই বলব। এইচএসসির পর আমি নিজে একটি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়েছিলাম ঠিকই, তবে ভর্তি কোচিং যে একজন মেডিকেল ভর্তিচ্ছুকের জন্য অনেক বেশি জরুরি, তা আমি মনে করি না।
কোচিং সেন্টারের ভূমিকা থাকে না, তা বলব না। সেখানে সবচে’ ভালো বিষয়টি হলো, পড়াশোনায় সেখানে একটি রেগুলারিটি মানা হয়। একজন শিক্ষার্থী যখন একটি কোচিং সেন্টারে ভর্তি থাকে, তখন একটি নির্দিষ্ট রুটিন অনুযায়ী তাকে ক্লাস করতে হয় ও নিয়মিত পরীক্ষা দিতে হয়। এতে নির্ধারিত সময়ের ভেতরে তার সিলেবাস শেষ হয় আর পরীক্ষা দেবার অভ্যাসটা গড়ে ওঠে। এ ছাড়া সেখানে নানা মেডিকেল স্টুডেন্টের সান্নিধ্য পাওয়া যায়। তাই, তারা যে গাইডলাইন বা মোটিভেশন দেন শিক্ষার্থীদের, সত্যি বলতে তা ভালোই কাজে দেয়। তবে কোনও শিক্ষার্থী যদি বাড়িতেই একটি সুন্দর রুটিন বানিয়ে সে অনুযায়ী সিলেবাসগুলো শেষ করে ফেলে, তাহলে আমি আলাদা কোচিংয়ে যাবার কোনও প্রয়োজন দেখি না।
এখন ইন্টারনেটের যুগ। ইউটিউবেই মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার জন্য কত লেকচার যে আছে! প্রতি বিষয়ের প্রতি চ্যাপ্টারভিত্তিক ভিডিও রয়েছে সেখানে। সেগুলো দেখলেই একজন শিক্ষার্থী কোচিংয়ের ক্লাসের মতোই চমৎকার একটি দিকনির্দেশনা পেয়ে যায়। তবে কোচিংয়ে ভর্তি না হলে অবশ্যই বাসায় নিজ উদ্যোগে নিয়মিত পরীক্ষা দিতে হবে। পরীক্ষা যদি না দেওয়া যায়, তবে যতই পড়া হোক না কেন, খুব একটা ফলপ্রসূ হবে না সে পড়া। যত পরীক্ষা দেওয়া যাবে, ভুলগুলো তত বেশি চোখে পড়বে।
বাজারে প্রশ্নব্যাংকের অভাব নেই ইদানীং। নিজের পছন্দমতো ভালো একটি প্রশ্নব্যাংক কিনে সেখানে শিক্ষার্থীরা রোজ পরীক্ষা দেবে। একটি OMR sheet সংগ্রহ করে অনেকগুলো ফটোকপি করে নিলে, রোজ সেই শিটে পরীক্ষা দিতে দিতে মূল পরীক্ষায় ঠিকভাবে বৃত্ত ভরাটের অভ্যাসটি গড়ে উঠবে। আর এই নিয়ম মেনে যদি কেউ দিনের পড়া দিনেই শেষ করে আর রোজ অধ্যায়ভিত্তিক পরীক্ষা দিতে থাকে, তবে তার কোচিং সেন্টারে যাবার কোনও দরকার নেই।
মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় ভীষণ প্রতিযোগিতা। অনেকে মানসিকভাবে প্রতিযোগিতা ভয় পায়। মানসিকভাবে হতাশ হয়ে যায়। নিজেকে মানসিকভাবে শক্তিশালী করার উপায় কী মনে করেন?
সোয়েব সানিয়াদ খান তূর্য : মানসিকভাবে দুর্বল শিক্ষার্থীদের আমি একটি কথাই বলি। ধরো তুমি সত্যিই মেডিকেলে চান্স পেলে। এরপর দেখতে দেখতে একদিন ডাক্তারও হয়ে গেলে। তখন যদি তোমার কাছে কোনও মুমূর্ষু রোগী আসে, তুমি কি চেষ্টা করবে না যে কোনও মূল্যে সে রোগীকে বাঁচিয়ে রাখার? তাহলে বলো তো, এই যে এত কঠিন মুহূর্ত সামাল দিতে তুমি তৈরি হবে একদিন, সেই যে সাদা অ্যাপ্রোন গায়ে দেবদূতের মতো হসপিটালে হেঁটে বেড়াবে একদিন, সে যাত্রার শুরুতে এমন ভয় পেলে কি চলবে?
মানসিকভাবে তাই নিজেকে শক্ত রাখবে সব সময়। হতাশ লাগলে বাবা-মা বা ভাইবোনকে বলবে। তারা তোমায় অনুপ্রেরণা দিতে প্রস্তুত। তাও না পারলে কোনও শিক্ষককে বলবে, অথবা কোনও কাছের বন্ধুকেই বলবে। দেখবে এক নিমেষেই তারা তোমার ভয় দূর করে দেবেন।
খুব হতাশ লাগলে নিজের মতো সময় কাটাবে কিছুক্ষণ। তোমার যা করতে ভালো লাগে, যে বইটি তোমার প্রিয় বা যে গানটি শোনো প্রায়ই, সেগুলোর সাথেই কিছুক্ষণ থাকবে না-হয়। স্রষ্টার কাছেও প্রার্থনা করবে রোজ। দেখবে, সবকিছু মিলিয়ে ভয় আর হতাশাকে জয় করে, একদিন তুমি ঠিক মেডিকেলের সেই করিডোরে পৌঁছে যাবে।
মেডিকেলে ভর্তির প্রস্তুতি হিসেবে ইংরেজি বা সাধারণ জ্ঞান অনেকে কম গুরুত্ব দেয়। এ দুটোতে ভালো করার উপায় কী?
সোয়েব সানিয়াদ খান তূর্য : সত্যি বলতে, ইংরেজি আর সাধারণ জ্ঞান মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার এক ট্রাম্পকার্ড বলা যায়। ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি আর বায়োলোজি নিয়েই সবাই এত ব্যস্ত থাকে, যে এ দুটো বিষয় অনেক অনাদর আর অবহেলায় পড়ে থাকে। কিন্তু মজার বিষয় হলো এ দুটো বিষয়ে যদি কেউ ভালো করতে পারে, তবে প্রতিযোগিতায় সে অনেকের চেয়ে বহু দূর এগিয়ে যায়।
ইংরেজির প্রস্তুতি নিতে আগে বিগত বছরের প্রশ্ন অ্যানালাইসিস জরুরি। দেখতে হবে কোন বিষয়গুলো থেকে প্রশ্ন আসে বেশি। শিক্ষার্থীরা সেগুলোরই একটি গোছানো তালিকা করে ফেলবে। এরপর যে বইটি পড়তে ভালো লাগে, সেখান থেকে সে টপিকটি নিয়ম বুঝে পড়বে। ঢালাওভাবে মুখস্থ করে কোনও লাভই নেই। পরীক্ষায় কোনও নতুন প্রশ্ন এলে তখন তা খুব কঠিন মনে হবে। তাই ওরা ইংরেজি গ্রামারের নিয়মগুলো বোঝে যদি, তবে নতুন যত প্রশ্নই আসুক-না-কেন, খুব সহজেই তা উত্তর করতে পারবে।
সাধারণ জ্ঞানের ক্ষেত্রেও ভালো করা খুব সহজ। এবার বাংলাদেশ ছাড়াও আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়েও প্রশ্ন আসবে পরীক্ষায়। ফলে এবার প্রশ্নের প্যাটার্ন ভিন্ন রকম হতে পারে।
সাধারণ জ্ঞান ও ইংরেজি বিষয়ের পেছনে রোজ ঘণ্টাখানেক সময় দেওয়াটা ভালো। ৩০ মিনিট রাখা হোক ইংরেজিতে, আর ৩০ মিনিট সাধারণ জ্ঞানে। রোজ রোজ যদি এই দুটি বিষয় পড়তে থাকে শিক্ষার্থীরা, কারও সাধ্য নেই ইংরেজি আর সাধারণ জ্ঞানে তাদের পিছিয়ে দেয়।
পরীক্ষার আগে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি হিসেবে আপনি কী কী করেছিলেন?
সোয়েব সানিয়াদ খান তূর্য : পরীক্ষার আগে প্রথমত আমি নতুন কিছু পড়িনি। ইন্টারমিডিয়েট আর ভর্তি পরীক্ষার মাঝে তিন থেকে মাস চারেকের একটি সময় পাওয়া যায়। প্রথম দু-তিন মাসেই আমি পুরো সিলেবাস শেষ করেছিলাম। আর শেষ ৩০ দিন রেখেছিলাম রিভিশনের জন্য।
এই ভর্তি পরীক্ষায় অনেক তথ্য মাথায় রাখতে হয়। তাই রোজ রোজ যদি পুরোনো পড়া রিভিশন না হয়, তবে পুরোনো পড়াগুলো একজন ভুলে যেতে পারে আর এটি খুব স্বাভাবিক ঘটনা। তাই প্রথম তিন মাসে প্রতিদিন কিছু সময় পুরোনো পড়া তো আমি রিভিশন দিতামই, শেষ সময়ে রিভিশনের মাত্রাটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। নতুন কিছু পড়তে যাওয়ার চেয়ে তখন এত দিন যা পড়েছি, তা ভালোভাবে মাথায় রাখাটাই বেশি জরুরি লেগেছিল। আর শেষ মুহূর্তে আমি পরীক্ষা দেওয়ার মাত্রাও বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। আগে যে কথাটা বলেছি, আমিও তেমন অনেকগুলো OMR শিট ফটোকপি করে রেখেছিলাম। রোজ ঘড়ি ধরে একদম ৫০-৫৫ মিনিট সময় নিয়ে পরীক্ষাগুলো দিতাম। আর এই বেশি পরীক্ষা দেওয়ার চর্চাটা আমার দারুণ কাজে দিয়েছে।
প্রচুর পড়াশোনা করার পরও মেডিকেলে যদি কারও চান্স না হয়, তার জন্য আপনার কী পরামর্শ থাকবে?
সোয়েব সানিয়াদ খান তূর্য : মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা খুব প্রতিযোগিতামূলক এক পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় ভালো পড়াশোনা যেমন জরুরি, তেমনই একজনের ভাগ্য আর পরীক্ষা হলের পারফরম্যান্সের ওপরেও অনেক কিছু নির্ভরশীল। কেউ হয়তো নিজের সেরা প্রস্তুতিটা নিল, কিন্তু পরীক্ষা হলে গিয়ে কোনও কারণে নার্ভাসনেস এসে গেল। জানা উত্তরও ভুল দাগিয়ে আসায় দুর্ভাগ্যবশত তার চান্স হলো না। এমন ঘটনা হরদম ঘটে আজকাল। আর শুধু মেডিকেল ভর্তিতেই এটা হয় তা নয়, বরং যে কোনও ভর্তি পরীক্ষাতেই হতে পারে।
এক্ষেত্রে আমি বলব, কারও যদি এমন ইচ্ছে থাকে যে আমাকে মেডিকেলেই পড়তে হবে, তবে সে পরবর্তী সময়ে ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষা বা আর্মি মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে। তা-ও যদি না হয়, তবে পরের বছর সেকেন্ড টাইমের সুযোগ তো থাকছেই। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি এই ব্যাপারটি পছন্দ করি না।
কারণটা আগে বলেছি। ‘শুধু মেডিকেলেই পড়ব আমি’—আমার নিজের এমন কোনও ইচ্ছে ছিল না কখনও। তাই সব সময় প্ল্যান এ-এর পাশাপাশি আমি প্ল্যান বি, সি আর ডি-ও তৈরি রেখেছিলাম। তাই আমি নতুন ভর্তিচ্ছুকদেরও বলব, মেডিকেলে পড়তে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেও তোমরা অন্তত অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ফর্মটা তুলে রেখো। যেন হঠাৎ অঘটন ঘটে গেলে, অন্য পথে যাবার সুযোগটা থেকে যায়।
আর বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেক অনুষদ আছে, যেখানে মেডিকেল ভর্তির প্রস্তুতি দিয়েই চান্স পেয়ে যাওয়া সম্ভব। আমি নিজেই তার সাক্ষী। মেডিকেলের পাশাপাশি আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। একটুও বাড়িয়ে বলছি না, সত্যি এ দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেতে আমার বাড়তি প্রস্তুতি নিতে হয়নি। মেডিকেলের পড়া দিয়েই উত্তর করতে পেরেছিলাম।
সবাইকে বলব, এই তুমুল প্রতিযোগিতার যুগে একটি পথে না এগিয়ে কয়েকটি পথের দরজা খোলা রেখো। যেন হঠাৎ কোনও পথের দরজা বন্ধ হয়ে গেলে অন্য পথ দিয়ে তুমি গন্তব্যে পৌঁছে যাও।
সবার জন্য অনন্ত শুভেচ্ছা রইল। আসন্ন মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় বিজয়-নিশান উড়িয়ে তোমরা তোমাদের স্বপ্ন সত্যি করো, শুধু এটিই আমার চাওয়া।