ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে মহা দুশ্চিন্তায় কয়েকলাখ শিক্ষার্থী
- ইরফান এইচ সায়েম ও আরিফুল ইসলাম তামিম
- প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০২১, ১২:২০ PM , আপডেট: ২৮ জুলাই ২০২১, ০১:৪৪ PM
দেশে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় তৃতীয় দফায় পেছানো হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার তারিখ। দুই দফায় পেছানো পর অনির্দ্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও তিন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট-রুয়েট-কুয়েট) গুচ্ছের ভর্তি পরীক্ষা। অন্যদিকে, ২০টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার তারিখ প্রথম দফায় পেছানোর পর পরবর্তীতে স্থগিত রেখেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
শুধু তাই নয়, করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতিতে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা ছাড়া ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের আর কোন পরীক্ষার আয়োজন করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানগুলো। দেশে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি ও দফায় দফায় লকডাউনে এসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার তারিখ বারবার পরিবর্তন-স্থগিতে হতাশ লাখ লাখ পরীক্ষার্থী। উচ্চশিক্ষায় ভর্তির স্বপ্ন যেন এখন আশা-নিরাশার দোলাচলে। যথাসময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন হলে শিক্ষার্থীরা ৬ মাস বিশ্ববিদ্যালয় জীবন পার করে ফেলতো।
এখন ভর্তির আগেই এক থেকে দেড় বছরের সেশনজটে এসব শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইতিমধ্যে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অনলাইনে ভর্তির আবেদন গ্রহণ করলেও ভর্তি পরীক্ষার দিনক্ষণ বারবার পেছানোর ফলে মহা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন এসব শিক্ষার্থীরা।
বর্তমানে দেশে ৪৬টি স্বায়ত্তশাসিত ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক কার্যক্রম চালু রয়েছে।এবার তিন গুচ্ছে ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এরমধ্যে ২০টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সাতটি কৃষি গুচ্ছ এবং তিনটি প্রকৌশল গুচ্ছ রয়েছে।
দেশের ২০টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক প্রথম বর্ষে গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে মোট ৩ লাখ ৬১ হাজার ৪০৬ জন শিক্ষার্থী প্রাথমিক আবেদন করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি ইউনিটে এবার মোট আবেদন পড়েছে ৩ লাখ ২০ হাজারের বেশি। এসব শিক্ষার্থীরা আবার অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও আবেদন করেছেন।
অন্যদিকে, কিছু এইচএসসি পাস করা শিক্ষার্থী ইতোমধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। তাছাড়া কয়েক লাখ শিক্ষার্থী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দেশের বিভিন্ন কলেজে ভর্তি হবে। এসব কলেজের ভর্তি আবেদন শুরু হচ্ছে আজ (২৮ জুলাই)। আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষার্থী ক্লাস করবেন।
২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক আবেদন গত ২৫ জুন শেষ হয়েছে। তবে এখনও চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। আগামী মাসের মাঝামাঝি সময়ে এ তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে জানা গেছে।
আগামী ৩১ জুলাই থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও দেশে চলমান করোনা পরিস্থিতির অবনতির ফলে তৃতীয় দফায় পেছানো হয়েছে। এখন আগামী ১ অক্টোবর থেকে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হবে।
চলতি বছর গত ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে প্রথম সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে (বিইউপি) ভর্তি পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা হলেও করোনার ঊর্ধ্বগতির ফলে পরীক্ষা আর হয়নি। পরবর্তীতে মে মাসে আবার ভর্তি পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করেও তৃতীয় দফায় অনির্দ্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেছে বিইউপি। এরপর মেডিকেল কলেজ ছাড়া কোথাও কোন ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করা সম্ভব হয়নি।
চলমান করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় তৃতীয় দফায় পিছিয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী ২৭ অক্টোবর থেকে ৫ নভেম্বর কয়েক ধাপে পরীক্ষা হবে।
আগামী ১২ আগস্ট তিন প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০-২০২১ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও করোনাভাইরাসের চলমান পরিস্থিতিতে সেটি তৃতীয় দফায় স্থগিত করা হয়েছে। এছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বঘোষিত ১৬, ১৭ ও ১৮ আগস্টের ভর্তি পরীক্ষার তারিখও স্থগিত করা চলমান কোভিড পরিস্থিতির কারণে।
দুইবার পিছিয়ে আগামী ৪ সেপ্টেম্বর দেশের সাত কৃষি বিষয়ক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার তারিখ দেওয়া থাকলেও চলমান করোনা পরিস্থিতির কারণে সেটিও চরম অনিশ্চয়তায়। এরই মধ্যে ভর্তি আবেদন বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে এবং সার্ভারে বাছাইকৃত শিক্ষার্থীদের তালিকা আপলোড করা হয়েছে।
করোনা পরিস্থিতির কারণে দুইবার পিছিয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ভর্তি পরীক্ষা। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালটির ভর্তি পরীক্ষা অনির্দ্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছে। করোনাভাইরাসের বর্তমান পরিস্থিতিতে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে সরকারি-বেসরকারি ডেন্টাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) ভর্তি পরীক্ষা দুই মাস পেছানো হয়েছে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী ২০ আগস্ট বুটেক্সের এ ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার তারিখও করোনা পরিস্থিতির উপর নির্ভর করছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি আবেদন গ্রহণ চলছে। চলতি বছরের শুরু দিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের সংগঠন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের এক সভায় ভর্তি পরীক্ষার প্রাথমিক দিনক্ষণ ঘোষণা করলেও পরবর্তীতে স্থগিত করা হয়। এরপর আর নতুন তারিখ ঘোষণা করা হয়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা গত ৪ জুন হওয়া কথা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে পরীক্ষা অনির্দ্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেছে।
মূলত মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা ব্যতীত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তি পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করেও তা কয়েক দফা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। নতুন করে ফের তারিখ ঘোষণা করা হলেও নির্ধারিত দিনে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব কিনা, তা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় রয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
দফায় দফায় ভর্তি পরীক্ষা পেছানোর ফলে বিপাকে পড়ছেন ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা। ভর্তি পরীক্ষার অনিশ্চয়তার ফলে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ এখন পুরোপুরি পড়াশোনার বাইরে৷ ফলে শিক্ষার্থীরা চরম হতাশা ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী দেলোয়ার হোসেন বলেন, বর্তমানে সবচেয়ে বেশি প্রতিকূল অবস্থায় শিক্ষার্থীরা বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি-ইচ্ছুক পরীক্ষার্থীরা। লকডাউনে কোনো কিছু থেমে নেই, থেমে আছে শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আমি একজন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার্থী। কলেজ জীবন শেষে আশা ছিলো উচ্চশিক্ষায় পড়ার স্বপ্ন।
“ভর্তি যুদ্ধে টিকে থাকতে তাই প্রস্তুতি নিতে শুরু করি, অনলাইনে বিভিন্ন ক্লাস করি। কিন্তু সম্যসা তখনই হয়, যখন শুনি ভর্তি পরীক্ষা আবার পেছানো হবে। ফলে হতাশা বাড়ছেই। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এখন দিনে একবারও বইয়ের দর্শন পাই না। এইভাবে ভেঙে পরেছে আমার মনোবল। যেই সময়টা আমি পড়ার টেবিলে কাটাতাম সেই সময়টা এখন কাটছে মোবাইলে।”
শেখ মাইনুর নামে একজন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী বলেন, আসলে বারবার পেছানোর কারণে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা করার আগ্রহটা কমে যাচ্ছে দিনদিন। আগে পরীক্ষার একটা নির্দিষ্ট তারিখ দেখে পড়া হচ্ছিলো এখন তাও হচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় পরীক্ষা পেছানোরও বিকল্প নেই। এটাও যেমন সত্য, মাঝখানে যখন সংক্রমণ কম ছিলো তখনও পরীক্ষা চাইলে নেওয়া সম্ভব ছিলো।
ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী আরমান তালুকদার বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে আগের মতো আর কৌতুহল কাজ করেনা। বারবার ভর্তি পরীক্ষার তারিখ পেছানোর ফলে মনোযোগ নষ্ট হয়ে যায়৷ যখন একটু পড়াশোনা নিয়ে একটু মনোযোগী হই তখনই ভর্তি পরীক্ষা পেছানোর সিদ্ধান্ত চলে আসে।কোভিড পরিস্থিতির দেড় বছরেও সরকার শিক্ষা ক্ষেত্রে এখনো পরিকল্পিত সিদ্ধান্তে আসতে পারে নাই যা দুঃখজনক।
ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী আফিয়াতুল ফারিহা বলেন, ভর্তি যুদ্ধ নিঃসন্দেহে একটি তীব্র প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা। এই পরীক্ষার জন্য যেমন মনোবল দরকার ঠিক তেমনি দরকার যথাযথ প্রস্তুতি। কিন্তু মহামারীর কারণে আমাদের পরীক্ষাগুলো বারবার পিছিয়ে যাওয়ায় যেমন আমাদের মনোবল ভেঙে যাচ্ছে ঠিক তেমনি আমাদের প্রস্তুতির ও প্রচন্ড ক্ষতি হচ্ছে। দীর্ঘ বিরতির কারণে আমরা কঠোরভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করার ইচ্ছাশক্তি হারিয়ে ফেলছি। যার কারণে আমাদের ভবিষ্যত হুমকির সম্মুখীন। তাই যত দ্রুত সম্ভব আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা গুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে সম্পন্ন করা উচিত।
ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী সাইফা নাসরিন বলেন, ভর্তি পরীক্ষা বারবার পেছানোয় এক প্রকার হতাশায় ভুগছি। সব মেয়েই উচ্চশিক্ষা অর্জন করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখে কিন্তু করোনায় শিক্ষা কার্যক্রম স্থবির হওয়ায় অনেক মেয়েকে পরিবার থেকে বিয়ের চাপ দিচ্ছে যা রীতিমতো হতাশাজনক। পরীক্ষা সময় আরো পিছিয়ে গেলে অনেক শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ার চরম আশঙ্কায় রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) ভিসি অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম সেখ বলেন, করোনার সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা বারবার পেছাতে হচ্ছে। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া সাপেক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের সংগঠন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের সঙ্গে আলোচনা করে ভর্তি পরীক্ষার নতুন তারিখ নির্ধারণ করতে হবে।