মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা: ভর্তিচ্ছুদের ১৩টি কমন প্রশ্নের জবাব

মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে লিখেছেন তৌহিদুল ইসলাম ইমন
মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে লিখেছেন তৌহিদুল ইসলাম ইমন  © ফাইল ফটো

মেডিকেল ভর্তির প্রস্তুতি নিয়ে ভর্তিচ্ছুদের মনে অনেক প্রশ্ন থাকে। বিভিন্নজনের নিকট জবাব খুঁজেও
সন্তুষ্ট হতে পারেন না অনেকে। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের পাঠকদের জন্য এসব প্রশ্নের জবাব দেয়ার চেষ্টা করেছেন তৌহিদুল ইসলাম ইমন—

১.কোন কোন বই পড়ব কতজন লেখকের বই পড়ব?

—আমি বলব যেকোন একজন রাইটারের বই পড়ো, শুধু মেইন বই পড়ো। যাচ্ছেতাই গাইড বই পড়ে মাথা খাওয়ার দরকার নেই। তবে একটা বই এমনভাবে পড়তে হবে যেন, এই বইয়ের আনাচে-কানাচে কি আছে সব একেবারে তোমার নখদর্পনে থাকে। যেকোন লাইনেই তুমি পার। এক্ষেত্রে যে বইগুলোকে অনুসরণ করতে পারো-

বোটানি: আবুল হাসান স্যার। (আর দরকার নেই একেবারে)

জুলোজি: গাজী আজমল স্যার (তবে এক্ষেত্রে কিছুটা আব্দুল আলীম স্যার লাগে)

ফিজিক্স: ইসহাক স্যার।

রসায়ন: হাজারী নাগ স্যার।

ইংরেজি: Apex- তবে মূল গুরুত্ব দিতে হবে ৩৯টি বিসিএসের ইংরেজি ও সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্ন সমাধান। এখান থেকে ইংরেজি ৫/৬টি কমন পাওয়া যাবে। এছাড়া আগের মেডিকেল প্রশ্নের উত্তর পড়লে আরও ২/৩টি কমন পড়বে। বাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্ন সমাধান পড়লে সবমিলিয়ে ইংরেজিতে ১২/১৩টি কমন এসে যায়।

সাধারণ জ্ঞান: গত ৫/৬ মাসের কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স।

শুধুমাত্র ভেতরের ৫০টি অবজেকটিভেই না। ভেতরের প্রত্যেকটা পৃষ্ঠা খুঁজে খুঁজে পড়তে হবে। মানে প্রত্যেকটা পাতাই পড়তে হবে। আরেকটা কথা কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সে কিছু ইংরেজির প্রশ্ন পাবেন পড়তে পড়তে। সেগুলোও সলভ করে নেবেন। আমি ৩/৪ টা ইংলিশ কমন পেয়েছিলাম কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স থেকে।

২. মেইন বই এর বাইরে কি আর কোন বইয়ের দরকারেই পড়ে না?

-হ্যাঁ পড়ে। আমি একটা বইয়ের কথাই বলছি। অথচ পরীক্ষাটা যেদিন শেষ হবে, সেদিন বাসায় না এসে সোজা লাইব্রেরিতে চললে যাবেন। গিয়ে জয়কলির মেডিকেল প্রশ্নব্যাংক কিনে নিয়ে আসবেন। তারপর বাসায় ফিরে কোচিংয়ে ক্লাস শুরু হওয়ার আগে আগেই এই প্রশ্নব্যাংকটা সমাধান করে ফেলার চেষ্টা করবেন। তবে একটু ভিন্ন ধরনে।

ধরুন আপনি ২০১৬ সালের একটা প্রশ্ন পড়ছেন, আপনি যেটা করবেন সেটা হচ্ছে ওই প্রশ্নটা যেই টপিকের অংশ পুরোটা টপিক পড়ে ফেলবেন। মেডিকেলে প্রশ্ন রিপিট হয় না কিন্তু টপিক রিপিট হয়। আপনি যদি এই সিস্টেমে ৫/৬ বছরের প্রশ্ন সলভ করতে পারেন তাহলে আপনি নিজেই একটা আইডিয়া পেয়ে যাবেন মেডিকেলে কী ধরনের প্রশ্ন আসে। বিশ্বাস করুন, এভাবে আপনি বই সলভ করতে পারলে ২৫/৩০ টা প্রশ্ন সরাসরি টপিক রিপিট হওয়ার কারণে পেরে যাবেন। আমি কয়েকটা টপিক লিখে রেখেছিলাম তখন ডায়েরিতে সবগুলো থেকেই ওইবার প্রশ্ন আসছিল।

৩. বইগুলো কীভাবে দাগিয়ে দাগিয়ে পড়ব?

—নতুন সংস্করণের বই হাতে নেবেন, তাই সেই বইয়ে কোন দাগ থাকবে না। আপনি প্রথমে সব লাইন পড়ুন, সব পড়ুন। গুরুত্বপূর্ণ লাইনগুলো কালো কালি দিয়ে দাগিয়ে রাখুন। এক সপ্তাহ পর আবার ওই বইয়ের ওই টপিকটা হাতে নিন। দেখবেন দাগানো লাইনের মধ্যে অনেকগুলো লাইন আপনার মনে আছে। কিছু কিছু লাইন পড়ে আপনি সত্যিই অবাক হয়ে যাবেন যে, আসলে কি আমি এই লাইনগুলো নিজ হাতে দাগিয়েছিলাম?

মানে দেখবেন কিছু কিছু লাইন আপনার প্রথম বার পড়ার পরেও মনে থাকেনি। এবার শুধু এই লাইনগুলো দাগিয়ে রাখুন তবে নীল কালি দিয়ে, যাতে আপনি ধরতে পারেন প্রথমবার পড়ার পরেও আপনার এই লাইনগুলো মনে থাকেনি। এর আরেক সপ্তাহ পর আবার এই টপিক রিভিশন দিন। এবার খেয়াল করুন, কালো কালির লাইনগুলো আপনার সারাজীবন মনে থাকবে, তা না হলেও এই ৩/৪ মাস মাথায় থাকবে।

আর দ্বিতীয়বার দাগানো নীল কালির লাইনগুলোর মধ্যেও দেখবেন কিছু লাইন খুব ভালভাবে স্থায়ী হয়ে গেছে। এইবার নীল কালিতে দাগানোর পরেও যেগুলো মনে থাকেনি, সেগুলোকে লাল কালি দিয়ে দাগিয়ে রাখুন। যখন শেষদিকে বই রিভিশন দেওয়ার সময় আসবে তখন শুধু লাল কালির লাইনগুলো পড়লেই হবে। বাকিগুলো এমনিতেই মনে থাকবে। এতে যেটা হবে সেটা হচ্ছে, যে লাইনগুলোতে সত্যি সত্যিই আপনার টাইম দেওয়া দরকার, সেগুলোতে টাইম বেশি পড়ছে।

৪. মুখস্ত না করে কৌশলী হোন। এখানে এক লাখ এর মতো স্টুডেন্ট পরীক্ষা দেবে, আর নেবে মাত্র ৩/৪ হাজার। তার মানে এই ৩/৪ হাজার শিক্ষার্থীকে ভর্তি করানোর পরীক্ষা না, এটা হচ্ছে ৯৬/৯৭ হাজার স্টুডেন্টকে বাদ দেওয়ার পরীক্ষা। প্রশ্নকর্তা সবসময় চেষ্টা করে কেমনে বাদ দেওয়া যায়। তাই যখন গত বছরের প্রশ্নগুলো পড়বেন কিংবা প্রশ্নব্যাংক সলভ করবেন তখন আপনি যে প্রশ্নের উত্তরটা ভুল দিচ্ছেন সেটা কেন ভুল হল সেটা লিখে রাখুন তার পাশে। দেখুন আপনি সেটাকে সঠিক জেনেই দাগিয়েছেন। কিন্তু আপনার ধারণাটা কেন ভুল, সেটা খুঁজে বের করুন।

৫. কোচিং কি একটা করব নাকি পাশাপাশি প্রাইভেট টিউটর কিংবা আরেকটা কোচিং চালিয়ে যাব?

—টাকা নষ্ট করার ইচ্ছা থাকলে করতে পারেন।

৬. দিনে কতক্ষণ পড়ব?

—এইটা মানুষের ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। কারো একবার পড়লেই হয়ে যায়; কারো তিনবার পড়লেও হয় না। তবে যাই হোক না কেন কোচিং প্রাইভেট, মোবাইল, খাওয়া বাদ দিয়ে নিজের পড়ার জন্য অন্তত আট ঘন্টা হাতে রাখতে হবে। 

৭. শুধু ঘুমে ধরে। কি করব?

—কফি ট্রাই করেন। আমার মতো রাত জেগে পড়তে চাইলে রাতে ১২ টা কিংবা ১টার দিকে কফি খান। অনেকেই সন্ধ্যার দিকেই কফি খেয়ে ফেলে। রাতে ১২টা বাজার আগেই আবার ঘুমে ধরে ফেলে। কারণ ক্যাফেইনের কার্যকারিতা আমাদের দেহে গড়ে ৫/৬ ঘন্টার মত থাকে৷। তাই রাতে ১১/১২ টার দিকে কফি খেলে সেটা আপনাকে সকাল পর্যন্ত জাগিয়ে রাখবে।

৮. কোচিং এ ভর্তি হয়েছি। এখন কোচিংয়ে পরীক্ষাতে তো ভাল নম্বর পাই না, কী করব?

—এখানে মজার ব্যাপার হইল কোচিং এ কোন পরীক্ষা দিতে গেলেই দেখবেন সেখানে সর্বোচ্চ উঠে ৯৯/১০০। এগুলো দেখে খুব হতাশায় পড়ে যাবেন। বলবেন, ভাই আমার তো ৮০ তুলতেই খবর হইয়া যায়। আচ্ছা ভাই এই যে কোচিং এর পরীক্ষায় ৯৯/১০০ সর্বোচ্চ উঠে। রেটিনায় যখন সারা বাংলাদেশে পজিশন দেয় তারা তখন দেখবেন ৯০ এর নিচে মার্কস পেলেই আপনার পজিশন এক হাজারের মধ্যেও নাই। এই ৯৯/১০০ তাহলে কেন মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় সর্বোচ্চ হয় না?

একটা হচ্ছে স্ট্রেস-এর কারণে। আরেকটা ব্যাপার খেয়াল করবেন, কোচিংয়ে যারা এত এত মার্ক পায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের ভাল মেডিকেলে চান্স হয় না। এক হলো তাদের অভার কনফিডেন্স, দুই হল অনেকেই প্রশ্ন আগেই পেয়ে যায়। আপনি যদি নিজ থেকে, নিজের মত করে পরীক্ষা দিয়ে ৭০-৮০ রেঞ্জে মার্কসটা রাখতে পারেন প্রতিটা কোচিংয়ের পরীক্ষায়, তাহলে আপনি মোটামুটি শিওর থাকেন চান্স হয়ে যাবে এবং কোচিং এ পাওয়া মার্কস’র আশেপাশেই মূল পরীক্ষার মার্কসটা থাকবে। নিজের মত করে পরীক্ষা দিন।

১০. আমি তো খুব ডিপ্রেশনে থাকি। এখন কী করব?

—কীসের ডিপ্রেশন। আমার কাছে মনে হয় আমি বেশি ডিপ্রেশনে থাকি, তাই বেশি বেশি মোটিভেশন দিয়ে ফেলি। একবার কোথাও যেন লিখেছিলাম, ‘The most depressed person can give you the best motivation because he or she knows how it feels like’। যদি ডিপ্রেশনে ধরে, শুধু নিজেকে বোঝাবেন- ‘৩/৪ মাস পরে যতটা মন খারাপ করার কইরা নিবো, এখন একটু পইড়া লই।’

১১. শুধু মেডিকেল কোচিং করে কি অন্য কোথাও চান্স পাওয়া যায়?

-হ্যাঁ যায়। আমি নিজে পাইছি। জাহাঙ্গীর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘এ’  ইউনিটে ২৬তম। আর ‘ডি’ ইউনিটে ১৬৩তম। সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে প্রথম। এছাড়া ঢাকা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মানজনক পজিশন ছিল। কোচিং করেছিলাম শুধু একটা।

১২. কখন আমি বুঝব যে আমি মেডিকেলে চান্স পাব?

—যখন আপনি দেখবেন যে আপনার মা-বাবা আপনার প্রতি বিপরীত আচরণ শুরু করেছে। মানে আগে শুধু বলত, পড় পড়। আর এখন বলে, ‘বাবা অনেক পড়ছিস এইবার একটু বিশ্রাম নে। এত্ত পড়া লাগে না রে বাপ। পরে মাথা নষ্ট হইয়া যাইব। যা ঘুমা গিয়া।’ কিংবা যেদিন আপনার বাবা মা বলবে, ‘আমার ছেলেটা কিংবা মেয়েটা যদি মেডিকেলে চান্স না পায় তাইলেও আমার কষ্ট নাই।’ এই কথাগুলো যেদিন মা-বাবার মুখ থেকে শুনবেন, সেদিন বুঝবেন আপনি ঠিকমতো পড়াশুনা করছেন।

১৩. কতটুকু পরিশ্রম করতে হবে ভাল মানের মেডিকেলে চান্স পাওয়ার জন্য?

—বেশি বলব না, শুধু আমার একটা কাহিনী শেয়ার করব। মেডিকেল প্রস্তুতি নেওয়ার সময় একদিন আমার আম্মু হঠাৎ বলেন, ‘কিরে বাবা, তুই কি কোথাও মারামারি করছিস নাকি? তোর পিঠে কিসের দাগ?’ আমি বুঝতে পারছিলাম না, শেষে আবিষ্কার করলাম চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে চেয়ারের দাগ বসে গেছে। তখন আমি ব্যাক পেইনের জন্য দু’বার ডাক্তার দেখাই। চোখে হ্রস্বদৃষ্টি হয়ে গেলে চশমা নিই, যেটা এখনো পরতে হয়।

এত কিছুর পরেই তবে এখন বলি, ‘হ্যা আমি মেডিকেলের স্টুডেন্ট।’ উফ! এই কথাটা বলতে গিয়ে মনটার মধ্যে যা শান্তি লাগে, ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।

লেখক: শিক্ষার্থী, এমবিবিএস, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ


সর্বশেষ সংবাদ