পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নিয়মে একক ভর্তি পরীক্ষার পরিকল্পনা
দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ে একক ভর্তি পরীক্ষার জন্য নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি তৈরি করা হচ্ছে। এতে দুই পদ্ধতিতে মূল্যায়নের চিন্তা করছেন নীতি নির্ধারকরা। চূড়ান্ত হতে যাওয়া খসড়ায় সব বিভাগের শিক্ষার্থীদের বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর করা বাধ্যতামূলক করা হতে পারে। আগামী সপ্তাহের শুরুতে পরীক্ষা পদ্ধতির খসড়া চূড়ান্ত করা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
জানা গেছে, গত জানুয়ারিতে একক ভর্তি পরীক্ষার নীতিমালা তৈরি করতে একটি কমিটি গঠন করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। সে কমিটির সুপারিশের আলোকে একক ভর্তি পরীক্ষার মূল্যায়ন পদ্ধতি ঠিক করতে চার সদস্যের একটি সাব-কমিটি গঠন করা হয়েছে। সে সাব-কমিটি মূল্যায়ন পদ্ধতির একটি খসড়া তৈরি করেছে। এ খসড়া চূড়ান্ত করতে আগামী সপ্তাহে ইউজিসিতে একটি সভা ডাকা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির সদস্য (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপক ড. হাসিনা খান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, একক ভর্তি পরীক্ষার মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে একটি সাব-কমিটি কাজ করছে। কাজের বেশ ভালো অগ্রগতি হয়েছে। মূল্যায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত করতে আগামী সপ্তাহের শুরুতে সভা করা হবে। সভা শেষে মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত বলা যাবে।
প্রাথমিকভাবে প্রচলিত পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়া হতে পারে। এক্ষেত্রে তিনটি ট্র্যাকে পরীক্ষা নেওয়া হবে। বিজ্ঞান, মানবিক এবং ব্যবসায় শিক্ষা শাখা। তিনটি ট্র্যাকের ক্ষেত্রেই কমন কিছু বিষয় থাকবে। এর মধ্যে অন্যতম হলো- ভাষা। এ বিষয়ে দক্ষতা নির্ণয় করতে সব বিভাগের শিক্ষার্থীদের বাংলা এবং ইংরেজি বিষয়ের প্রশ্নের উত্তর করতে হতে পারে।
সূত্র বলছে, একক ভর্তি পরীক্ষার মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে তৈরিকৃত খসড়ায় দুই পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়ার সুপারিশ করা হবে। এর মধ্যে একটি হলো- কম্পিউটার বেজড টেস্ট। আর অন্যটি হলো- প্রচলিত পদ্ধতিতে অর্থাৎ খাতার মাধ্যমে মূল্যায়ন। প্রাথমিকভাবে খাতার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হতে পারে। পরবর্তীতে কম্পিউটার বেজড মূল্যায়নের দিকে যাবে কমিটি। তবে এ বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
পরীক্ষা পদ্ধতির খসড়া তৈরির সাথে সম্পৃক্ত একটি সূত্র জানায়, প্রাথমিকভাবে প্রচলিত পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়া হতে পারে। এক্ষেত্রে তিনটি ট্র্যাকে পরীক্ষা নেওয়া হবে। বিজ্ঞান, মানবিক এবং ব্যবসায় শিক্ষা শাখা। তিনটি ট্র্যাকের ক্ষেত্রেই কমন কিছু বিষয় থাকবে। এর মধ্যে অন্যতম হলো- ভাষা। এ বিষয়ে দক্ষতা নির্ণয় করতে সব বিভাগের শিক্ষার্থীদের বাংলা এবং ইংরেজি বিষয়ের প্রশ্নের উত্তর করতে হতে পারে।
বাংলা ও ইংরেজির উত্তর বাধ্যতামূলক হলেও বিভাগভিত্তিক অন্যান্য বিষয়েও পরীক্ষায় উত্তর করতে হবে। বিভাগভিত্তিক প্রশ্নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিভাগের পঠিত বিষয় প্রাধান্য থাকবে। অর্থাৎ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পদার্থ, রসায়ন ও গণিত বিষয়ে প্রশ্ন বেশি থাকবে। এর পাশাপাশি বাংলা ও ইংরেজিও থাকবে।
মেধা যাচাইয়ের জন্য একজন শিক্ষার্থীর ভাষার দক্ষতা জানাটা জরুরি। বিষয়টি নিয়ে কমিটির সদস্যরা কাজ করছেন। আমরা এমন একটি মূল্যায়ন পদ্ধতি ঠিক করতে চাই, যার মাধ্যমে প্রকৃত মেধাবীরাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির সুযোগ পাবেন। -অধ্যাপক ড. সঞ্জয় কুমার অধিকারী, মূল্যায়ন পদ্ধতি সংক্রান্ত কমিটির সদস্য
একক ভর্তি পরীক্ষার মূল্যায়ন পদ্ধতি তৈরির কাজ চলছে জানিয়ে একক ভর্তি পরীক্ষার মূল্যায়ন পদ্ধতি সংক্রান্ত কমিটির সদস্য বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলের (বিএসি) সাবেক সদস্য অধ্যাপক ড. সঞ্জয় কুমার অধিকারী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আগামী ২ জুন ইউজিসি ভবনে খসড়া নীতিমালা নিয়ে সভা রয়েছে। সভা শেষে খসড়া নিয়ে বিস্তারিত বলা যাবে।
মূল্যায়ন পদ্ধতিতে বাংলা এবং ইংরেজি বিষয়ের উত্তর বাধ্যতামূলক করা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মেধা যাচাইয়ের জন্য একজন শিক্ষার্থীর ভাষার দক্ষতা জানাটা জরুরি। বিষয়টি নিয়ে কমিটির সদস্যরা কাজ করছেন। আমরা এমন একটি মূল্যায়ন পদ্ধতি ঠিক করতে চাই, যার মাধ্যমে প্রকৃত মেধাবীরাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির সুযোগ পাবেন।
জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমাতে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ে একক ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের উদ্যোগ নেয় ইউজিসি। এজন্য একটি খসড়া অধ্যাদেশও তৈরি করা হয়েছিল। পরবর্তীতে তা অনুমোদনের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। তবে মন্ত্রণালয়ের সম্মতি না মেলায় সে উদ্যোগ ভেস্তে গেছে। এখন নতুন করে একক ভর্তি পরীক্ষা সংক্রান্ত নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে তদারক সংস্থাটি।
সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষের কাঠামো, এর চেয়ারম্যান পদ ও ব্যয়ের ক্ষমতাসহ বেশকিছু বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের জোর আপত্তি থাকায় আলোর দেখা পায়নি ইউজিসির পাঠানো নীতিমালা। এখন মন্ত্রণালয়ের প্রত্যাশা অনুযায়ী আগেরটি সংশোধন করে নতুন নীতিমালা তৈরি করতে যাচ্ছে কমিশন। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধিকে যুক্ত করা হবে। পাশাপাশি কর্তৃপক্ষের ব্যয়ের ক্ষমতায়ও কিছু পরিবর্তনের কথা শোনা যাচ্ছে।
উচ্চশিক্ষা সংশ্লিষ্ট অনেকের অভিযোগ, একক ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি আটকে যাওয়ার নেপথ্যে রয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির ‘ক্ষমতার দ্বন্দ্ব’। এ প্রক্রিয়া চালু হলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ পাবে ইউজিসি। আর নিয়ন্ত্রণ হারাবে মন্ত্রণালয়। এ কারণে অধ্যাদেশ জারির বিষয়ে পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো ইউজিসিকে থামিয়ে দেওয়া হয়।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কথায়ও ক্ষমতার দ্বন্ধের আভাস পাওয়া যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব পর্যায়ের এক কর্মকর্তা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘অধ্যাদেশের খসড়াটা দেখে মন্ত্রণালয়ের সবাই অবাক হয়েছিলেন। এটা যেভাবে করা হয়েছে, তাতে ইউজিসি এককভাবে অনেক ক্ষমতার অধিকারী হবে। সেখানে মন্ত্রণালয়ের কাউকে রাখার সুযোগ নেই অজুহাতে রাখা হয়নি। এটা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ভালোভাবে নেননি। এছাড়া আমরা তাদের কাছে চেয়েছিলাম প্রস্তাবনা। অথচ তারা তৈরি করে পাঠিয়েছিল অধ্যাদেশ। এসব কারণে নতুন করে প্রস্তাবনা পাঠাতে বলা হয়েছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৩১ অক্টোবর ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে স্নাতক পর্যায়ে ‘কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ অধ্যাদেশ-২০২৩’এর খসড়া চূড়ান্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠায় ইউজিসি। তবে সেটি সে সময় চূড়ান্ত করেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এমনকি পাঠানো হয়নি রাষ্ট্রপতির কার্যালয়েও। পরবর্তীতে গত বছরের ২৯ নভেম্বর একক ভর্তি পরীক্ষা সম্ভব নয় জানিয়ে ইউজিসিতে চিঠি পাঠানো হয়।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপসচিব মোছা. রোখছানা বেগম স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের আচার্যের অভিপ্রায় অনুসারে ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে একক ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের জন্য গত ১৫ এপ্রিল ইউজিসিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রজ্ঞাপনের প্রেক্ষিতে ইউজিসি কেন্দ্রীয়ভাবে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া নির্ধারণের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করার কথা। কিন্তু তা না করে ইউজিসি সরাসরি অধ্যাদেশের খসড়া প্রেরণ করেছে।
এতে আরও বলা হয়, ইউজিসি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে স্নাতক পর্যায়ে ‘কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ অধ্যাদেশ-২০২৩’ প্রণয়নের প্রস্তাব করেছে। জাতীয় সংসদ অধিবেশন না থাকা অর্থাৎ বিলুপ্ত থাকা অবস্থায় রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা বিবেচনায় অধ্যাদেশ জারি করে থাকেন। বর্তমানে দেশে কোনো জরুরি অবস্থা বিদ্যমান নেই। তাই এক্ষেত্রে অধ্যাদেশ প্রণয়নের প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়।
আরো পড়ুন: বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্ম সংশ্লিষ্ট উচ্চশিক্ষা দিতে কাজ করবে কানাডা ও বাংলাদেশ
এরপরই চিঠিতে ইউজিসির ক্ষমতার বিষয়টি ইঙ্গিত করেছে মন্ত্রণালয়। চিঠির ক্রমিক নম্বর ২(গ)-তে বলা হয়, প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের ৫, ৬, ৭, ৮, ৯ ও ১০ ধারা পর্যালোচনায় দেখা যায়, ‘বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে স্নাতক পর্যায়ে কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ’ নামে একটি প্রস্তাবিত কর্তৃপক্ষ স্নাতক পর্যায়ে ভর্তি পরীক্ষা সংক্রান্ত সব কার্যক্রম সম্পন্ন করবে। যার চেয়ারম্যান হবেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান।
তিনি ইতোমধ্যেই একটি বিধিবদ্ধ সংস্থার প্রধান হিসেবে দায়িত্বরত। এ পরিপ্রেক্ষিতে তার আরেকটি কর্তৃপক্ষের প্রধানের দায়িত্ব পালন করা সমীচীন হবে না। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ‘বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন আদেশ, ১৯৭৩’ বলে গঠিত একটি বিধিবদ্ধ সংস্থা। একটি বিধিবদ্ধ সংস্থার অধীনে আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত আরেকটি কর্তৃপক্ষ থাকতে পারে না।
এনটিআরসিএ’র উদাহরণ টেনে মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়, বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) একটি স্বতন্ত্র পরীক্ষা গ্রহণকারী সংস্থা। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের একক পরীক্ষা গ্রহণ করার ক্ষেত্রেও এ বিভাগের অধীনে এরকম একটি স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষ গঠন করা যেতে পারে। এ অবস্থায় উপর্যুক্ত পর্যালোচনার আলোকে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এককভাবে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের নিমিত্তে ন্যাশনাল টেস্টিং অথরিটির গঠনকাঠামো, কার্যক্রম, পরীক্ষা গ্রহণ পদ্ধতি বিষয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রস্তাব নির্দেশক্রমে পাঠানোর অনুরোধ করা হলো।