ভেঙে যেতে পারে গুচ্ছ, ইঙ্গিত দুই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী শিক্ষার্থীদের সার্বিক ভর্তি প্রক্রিয়া সহজ করতে ২০২০-২০২১ সেশন থেকে শুরু হয় সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা। স্বায়ত্তশাসিত ও বিশেষায়িত ছাড়া প্রথমবার ২০ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে শুরু হলেও পরের বছর থেকে ২২টি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে শুরু হয় এ ভর্তি প্রক্রিয়া। এ উদ্যোগের উদ্দেশ্য বিবেচনায় যতটুকু ইতিবাচক আশার সঞ্চার করার কথা ছিল তার থেকেও বেশি হতাশার জন্ম দেয় বিগত তিন সেশনের ভর্তি-ক্রমে।
ফলে নানা আশা জাগিয়েও শেষ মুহূর্তে ভেঙ্গে যাওয়া একক ভর্তি কার্যক্রমের এ বছরের জন্য নতুন কোনো সুযোগ না থাকায় নড়বড়ে অবস্থানে থাকা গুচ্ছ আবারও ভেঙ্গে পড়ার মুখে রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবস্থানও স্পষ্ট হয়েছে। গুচ্ছ প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে একক ভর্তি পরীক্ষার পক্ষে নিজেদের অনড় অবস্থানের কথা জানিয়ে শুক্রবার বিবৃতি প্রকাশ করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) শিক্ষক সমিতি।
এছাড়াও গুচ্ছ প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল অবস্থানের কথা জানিয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি)। এর আগে গত বছর চলতি (২০২২-২৩) শিক্ষাবর্ষে একক ভর্তি পরীক্ষা হবে—এমন আশ্বাসে গুচ্ছে আনা হয়েছিল ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়কে। তখন জবি জানিয়েছিল, আগামী (২০২৩-২৪) শিক্ষাবর্ষ থেকে একক ভর্তি পরীক্ষা না হলে ওই বর্ষ থেকেই জবি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন করবে বলেও সাফ জানিয়েছে শিক্ষক সমিতি।
গুচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের বিড়ম্বনা এবং ভর্তিতে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে আমরা এ ব্যবস্থা থেকে বের হতে চাই। সমন্বিত ভর্তি হতে হলে সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে আসতে হবে; কেউ আসবে কেউ আসবে না, তা হলে তো আর সমন্বিত হবে না—অধ্যাপক ড. আবুল কালাম মো. লুৎফর রহমান, জবি শিক্ষক সমিতি।
চলতি বছরের এপ্রিলে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একক ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে কমিশনকে দায়িত্ব দিয়ে রাষ্ট্রপতির নির্দেশক্রমে একটি আদেশ জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর এ নিয়ে প্রস্তাবনার খসড়া মন্ত্রণালয়ে পাঠায় ইউজিসি। সংশ্লিষ্টরা আশা করছিলেন, এই অধ্যাদেশ জারি হলে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি ভর্তি পরীক্ষায় আনা যাবে। সেজন্য চলতি বছরের জুলাই মাসে একক ভর্তি পরীক্ষা নিতে ইউজিসি চেয়ারম্যানকে আহ্বায়ক করে ১৫ সদস্যের একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটিও গঠন করা হয়।
ইউজিসির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে একক আওতাভুক্ত করে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের জন্য একটি অধ্যাদেশ জারি করা প্রয়োজন। ন্যাশনাল টেস্টিং অথরিটি (এনটিএ) গঠনের আগ পর্যন্ত ওই অধ্যাদেশ অনুযায়ী ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করা হবে। ভর্তি পরীক্ষা বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় আইনে যাই থাকুক না কেন; এই অধ্যাদেশ তার উপরে প্রাধান্য পাবে। কমিশনের একজন সদস্যের নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিটিকে অধ্যাদেশের খসড়া তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
দেশের উচ্চশিক্ষার তদারক সংস্থা ইউজিসি থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো নতুন ওই সুপারিশে ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষার্থীরা একক একটি ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ভর্তির সুযোগদানের প্রস্তাবনা রাখা হয়েছিল। এ নিয়ে রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে অধ্যাদেশ জারির পর ভর্তি প্রক্রিয়াটি শুরু করার কথা ছিল দেশের সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর।
দেশের উচ্চশিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত বছরগুলোর ভর্তি পরীক্ষায় দীর্ঘসূত্রিতা, ভর্তিতে কালক্ষেপণ, উপাচার্যদের সিদ্ধান্তহীনতা, ভর্তিতে নানা জটিলতা ও হয়রানিতে খোদ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদেরই গুচ্ছে থাকতে অনীহা তৈরি করেছে। একইসঙ্গে নতুন করে প্রশ্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের স্বকীয়তা হারানোসহ নানা প্রশ্ন তুলছেন সমন্বিত এ ভর্তির উদ্যোগের। ফলে গুচ্ছ পদ্ধতি থেকে বের হতে হাঁসফাঁস অবস্থা বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের।
একক ভর্তি পরীক্ষার কথা বলেই গত বছর সবাইকে গুচ্ছে রাখা হয়েছিল। না হলে এবার সবাই আলাদাভাবে পরীক্ষা নেবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছিল তখন। একক ভর্তি পরীক্ষা না হলে গুচ্ছ ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না—অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন, উপাচার্য, যবিপ্রবি।
তবে নানা আলোচনা সমালোচনার পরও গুচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তির পক্ষে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। অন্যদিকে নানা আলোচনা-সমালোচনা ও সহজ-সরলের নানা হিসেব-নিকেশে অনেকটাই ভাঙনের দ্বারপ্রান্তে গুচ্ছ ভর্তি পদ্ধতি।
এর আগে চলতি ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ে একক ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের কথা জানিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর এ নিয়ে খসড়া অধ্যাদেশ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিল ইউজিসি। তবে তাতে সম্মতি দেয়নি মন্ত্রণালয়। ফলে শেষ মুহূর্তে এসে শেষ হয় দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে একক ভর্তির এ উদ্যোগটি।
গত বছর গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার সঙ্গে থাকা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি শিক্ষাবর্ষে একক ভর্তি পরীক্ষা হবে, এমন কথা বলে গত বছর গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় আনা হয়েছিল ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়কে। সে সময় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, একক ভর্তি পরীক্ষা না হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজস্ব প্রক্রিয়ায় ভর্তি পরীক্ষা নেবে। ফলে এবার একক ভর্তি পরীক্ষা না হওয়ায় ২২ বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ ভেঙে যেতে পারে বলে শঙ্কা তাদের।
গুচ্ছভুক্ত একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা জানিয়েছেন, চলতি বছর গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা বিষয়ে এখনো কোনও আলোচনা হয়নি। তবে আগের বছর একক ভর্তি পরীক্ষার কথা বলে সবাইকে গুচ্ছে রাখা হয়েছিল। সেটি না হলে এবার গুচ্ছ নাও থাকতে পারে। উপাচার্যদের সভা হলে গুচ্ছের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।
দেশের উচ্চশিক্ষার তদারক সংস্থা ইউজিসি থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো একক ভর্তি পরীক্ষার খসড়া সুপারিশে ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষার্থীরা একক একটি ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ভর্তির সুযোগদানের প্রস্তাবনা রাখা হয়েছিল।
জানতে চাইলে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, একক ভর্তি পরীক্ষার কথা বলেই গত বছর সবাইকে গুচ্ছে রাখা হয়েছিল। না হলে এবার সবাই আলাদাভাবে পরীক্ষা নেবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছিল তখন। একক ভর্তি পরীক্ষা না হলে গুচ্ছ ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল কালাম মো. লুৎফর রহমান বলেন, গুচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের বিড়ম্বনা এবং ভর্তিতে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে আমরা এ ব্যবস্থা থেকে বের হতে চাই। সমন্বিত ভর্তি হতে হলে সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে আসতে হবে; কেউ আসবে কেউ আসবে না, তা হলে তো আর সমন্বিত হবে না। দ্বিতীয়ত, ভর্তি সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে শিক্ষকদের সম্পৃক্ত করার দাবি আমরা করেছি। ভর্তির ফি নিয়ে আমরা বলেছি তা কমিয়ে রাখার জন্য।
গুচ্ছ প্রক্রিয়াকে শিক্ষার্থীদের জন্য সহজ ও লাভজনক করা যায়নি জানিয়ে অধ্যাপক ড. আবুল কালাম মো. লুৎফর রহমান বলেন, এটি শিক্ষার্থীদের জন্য এখন আরও বেশি হয়রানিমূলক হয়েছে। প্রথমে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আসার পর মাইগ্রেশনে আবার অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দৌড়াতে হয়। এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর ভর্তি সংক্রান্ত নানা জটিলতায় তা বাতিল করে আবার অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হয়। এমন নানা হয়রানি ও দীর্ঘসূত্রিতার কারণে আমরা গুচ্ছ থেকে বের হতে চাই।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসন অব্যাহত রাখতে হলে অ্যাকাডেমিক বিষয়গুলোতে তাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ দিয়ে নীতি-নির্ধারণ করতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বায়ত্তশাসন না থাকলে তো তা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো হয়ে যাবে। আমরা গুচ্ছ থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য গত বছর ১০ দফা দাবি ছিল তার একটিও মানা হয়নি। আমাদের শিক্ষক সমিতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৬ টি বিভাগ এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গুচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়ায় না থাকার বিষয়ে, আমরা এ রকম বৈষম্যমূলক ব্যবস্থায় থাকতে চাই না; সমন্বিত হলে এখানে সকল বিশ্ববিদ্যালয়কে আসতে হবে।
এ নিয়ে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. সালেহ আহম্মেদ গুচ্ছের চলমান নানা সমস্যার সমাধান হিসেবে মনে করেন, গুচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়াটি আরও পরিকল্পিত করা। সেজন্য তিনি চলমান কৃষি গুচ্ছের মতো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য আলাদা, সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য আলাদা ভর্তি প্রক্রিয়া বা পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা জানান। একই সাথে তিনি তার শিক্ষক সমিতির গুচ্ছে না থাকার সিদ্ধান্তকেও সাধুবাদ জানান।