‘আশার একক ভর্তি পরীক্ষা’য় ভয় গুচ্ছের মতো ভোগান্তি-অব্যবস্থাপনায়
আগামী ২০২৩-২০২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একক ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন করার বিষয়ে দ্রুত একটি অধ্যাদেশ জারির সুপারিশ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। এই অধ্যাদেশ জারি হলে ন্যাশনাল টেস্টিং অথরিটি (এনটিএ) গঠনের আগ পর্যন্ত এই অধ্যাদেশ অনুযায়ী ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করা হবে।
এই উদ্যোগ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। কেননা এর আগে ২২ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একক (গুচ্ছ) ভর্তি পরীক্ষা সর্ব মহলে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ালেও আবেদন ফি বৃদ্ধি, পরীক্ষার ফলে ভুল, মেরিট পজিশন না দেয়া এবং সবশেষ বিষয় পছন্দের জন্য বাড়তি ফি নির্ধারণ করায় এই পদ্ধতির পরীক্ষা আয়োজনের সফলতা ঢাকা পড়েছিল ব্যর্থতায়।
এর আগে দেশের উচ্চশিক্ষার তদারক সংস্থা, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে গুচ্ছ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যাপক প্রতিশ্রুতির কথা জানানো হয়েছিল। ফলে শিক্ষার্থীরা আশা করেছিলেন, প্রচলিত শিক্ষা ধারায় দেশের উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ অনেকটাই সহজ হবে তাদের জন্য। কিন্তু গুচ্ছ কমিটির সমন্বয়হীনতায় ভেস্তে যায় সে আশাবাদ। ফলে গুচ্ছ থেকে বের হতে সর্বোচ্ছ আগ্রহহীনতা প্রকাশ করে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। আলোচনায় আসে গুচ্ছ পদ্ধতিতে না থাকতে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলনও।
এ নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্সের শিক্ষার্থী জান্নাতুল মাওয়া মিথিলা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, একক ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমার চেয়ে বাড়বে বলেই আমার ধারণা। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, গুচ্ছ পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একই প্রশ্নে পরীক্ষা নিলেও ভর্তি প্রক্রিয়া অত্যন্ত দীর্ঘায়িত এবং ভোগান্তি হয়। এই তালিকায় স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যুক্ত হলে ভর্তি প্রক্রিয়া আরো দীর্ঘায়িত এবং ত্রুটিপূর্ণ হবে বলে আশঙ্কা করছি।
আরও পড়ুন: উপাচার্যদের সিদ্ধান্তহীনতায় আর্থিক ক্ষতিতে গুচ্ছের ভর্তিচ্ছুরা
এছাড়া ভর্তি পরীক্ষায় এবং ভর্তি প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি স্বতন্ত্র কাঠামো রয়েছে, একক পরীক্ষার মাধ্যমে এই স্বতন্ত্র নিয়মাবলি ক্ষুণ্ন হবে। যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা বা অসুস্থতাবশত একটি পরীক্ষা খারাপ হলেই একজন শিক্ষার্থীর সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয় বলেও জানান এই শিক্ষার্থী।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নয়ন তারা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একক ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হলে পরীক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমবে। ভর্তি পরীক্ষার জন্য দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে শিক্ষার্থীদের বিপুল অর্থ ব্যয়ে বিভিন্ন স্থান পাড়ি দিতে হবে না। এতে সকল স্তরের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাবে। ইউজিসি পারে দুর্ভাগ্য কমিয়ে এনে শিক্ষার্থীবান্ধব সুব্যবস্থা করতে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে-ভর্তিপরীক্ষার প্রশ্নফাঁস বন্ধসহ শিক্ষার্থীবান্ধব নানা পদক্ষেপ নিতে।
ইউজিসি তো আর স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একক ভর্তি পরীক্ষায় আনতে পারে না; যদি মহামান্য রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি না করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘৭৩ এর আইন’ অনুযায়ী আমরা একক ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ভেবে দেখব—চবি উপাচার্য ড. শিরীন আখতার।
এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ২০২১-২২ বর্ষের শিক্ষার্থী মো. আশিকুজ্জামান আশিক বলেন, একক ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির হবে বলে আমি মনে করি। সব ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা একসাথে একসাথে হলে তা জগাখিচুড়ি হবে। যেমন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান যদি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের আগ্রহী শিক্ষার্থীদের পড়তে হয় কিংবা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত যদি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আগ্রহী শিক্ষার্থীদের করতে হয় তবে তা একেবারে বেমানান হয়ে যাবে। আবার সব একসাথে পরীক্ষা হলে প্রশ্নফাঁসের ভয় তো থেকেই যায়। তবে প্রশ্নের মান বজায় রেখে, প্রশ্নফাঁসের ব্যাপারে সতর্ক থেকে যদি একক বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা হয়; তবে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমবে বলে আমি মনে করি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং বিভাগের শানু আক্তার নদী বলেন, এটা ঠিক যে একক ভর্তি পরীক্ষায় যাতায়াত সমস্যা কমে আসবে। একক ভর্তি পরীক্ষার যেমন ইতিবাচক বিষয় রয়েছে, তেমনি রয়েছে নেতিবাচক দিকও। একজন শিক্ষার্থীর ভাগ্য সর্বদা সহায় হবে-এমন নয়। আজকের দিন অতিবাহিত যেভাবে হবে, ভবিষ্যতে হয়ত নি:সংকোচে অপ্রত্যাশিত সুফল বয়ে আসতে পারে। তেমনি স্বতন্ত্র-ধারায় একজন শিক্ষার্থীর এক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা মন্দ হলে এমন তো নয় যে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা খারাপ হতে পারে। হয়ত ভালো পজিশনে ও থাকতে পারে। কোন পরীক্ষা নানাবিধ কারণে খারাপ হতে পারে কিন্তু দ্বিতীয় পরীক্ষায় সে ভালোও করতে পারে এমনটা অনেক হয়। তাই একক ভর্তি পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীদের মাঝে বাড়তে পারে বিড়ম্বনা, বাঁধতে পারে ভয়-ভীতি। তাছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়ে যে অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে; তা থেকে বঞ্চিত হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা তৈরি হবে বলেও মনে করেন তিনি।
আরও পড়ুন: গুচ্ছ পদ্ধতি ধরে রাখতে চান শিক্ষামন্ত্রী, বেরিয়ে যেতে হাঁসফাঁস শিক্ষকদের
এছাড়াও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের মার্কেটিং অনুষদের শিক্ষার্থীরা মুবাশ্বীর তাহমিদ ভুঁইয়া বলেন, গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা হলে সেখানে কোনো কারণে কেউ অংশগ্রহণ করতে পারল না বা সে সময় অসুস্থ থাকলে তার একটা বড় ক্ষতি হচ্ছে। গুচ্ছ পরীক্ষা হলে প্রশ্ন সিলেক্ট করে প্রতিটি কেন্দ্রে পাঠানো, নকল রোধে কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। মেধাবী অনেকে তার কাঙ্ক্ষিত সিট পাবে না দুর্নীতির কারণে। আবার আর্থিকভাবে অসচ্ছল পরিবারদের জন্য এক প্রকার সুখবর হতে পারে গুচ্ছ পরীক্ষা পদ্ধতি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী জাহেদুল হক বলেন, একক ভর্তি পরীক্ষা হলে যাতায়াত সমস্যা ও খরচ কমবে এটা ঠিক। কিন্তু ভোগান্তি কোনোভাবেই কমবে না। গুচ্ছ পদ্ধতিতে বলা হয়েছিল আমাদের ভোগান্তি কমবে; কিন্তু আমরা দেখেছি যাতায়াত ভোগান্তি কমলেও আসল ভোগান্তি কিন্তু কমেনি। বরং বেড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা, কচ্ছপের গতিতে মেধা তালিকা প্রকাশসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে শিক্ষার্থীদের মানসিক ভাবে সমস্যায় পড়তে হয়েছে। ইউজিসির গুচ্ছ পদ্ধতি অকার্যকর পদ্ধতি প্রমাণিত হয়েছে। একই পদ্ধতিতে একক ভর্তি পদ্ধতি চালু হলে শেষে কোন বিশেষ লাভ হবে না বলে আমার মনে হয়।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আদিল রায়হান বলেন, গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষায় অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের জন্য কিছুটা সুবিধা হলেও সার্বিকভাবে প্রশ্নের মান, বিভাগ-বন্টন, প্রশ্নফাঁস কিংবা যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং এর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। তাছাড়া পূর্বে অনুষ্ঠিত গুচ্ছ পরীক্ষায় আমরা নানা অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, পরীক্ষার জন্য আবেদন ফি’র পাশাপাশি ভর্তির পূর্বে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সাবজেক্ট চয়েজের সময় আলাদাভাবে ফি গ্রহণের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি। যে-সব সার্বিকভাবে শিক্ষার্থী কিংবা অভিভাবক সকলের ভোগান্তিকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
তিনি বলেন, কৃষি, সাধারণ কিংবা প্রকৌশল গুচ্ছ পদ্ধতিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থানীয় শিক্ষার্থীদের কাছাকাছি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি হতে দেখা গেছে। যা সার্বিকভাবে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জন্য ইতিবাচক দিক হিসেবে গণ্য করা যায়। এছাড়া একক পরীক্ষাতে যেমন শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার উদ্দেশ্যে অনেক স্থানে যাতায়াত, আবাসন ব্যবস্থাপনার মতো সমস্যা গুলো গুচ্ছ পদ্ধতির কারণে অনেকটাই কমে এসেছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ অন্যান্য উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর ন্যায় যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং এর আওতায় যদি গুচ্ছ পদ্ধতি আয়োজন সম্ভব হয় তবে হয়তোবা সরকারের কাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্য ফলপ্রসূ হতে পারে বলে আমার বিশ্বাস
একক ভর্তি পরীক্ষার বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক. ড. শিরীন আখতার দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন, ইউজিসি একক ভর্তি পরীক্ষার জন্য একটি কমিটি করে দিয়েছে। সে কমিটিতে আমিও রয়েছি। আমি একক ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে আমার ডিন, অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে আলাপ করেছি। কেউ এতে রাজি নেই। আমরা যেটা করতে পারি আগামী বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাইলে বিভাগীয় পরীক্ষার আয়োজন করার পরিকল্পনা করছি। এতে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমবে।
উপাচার্য ড. শিরীন আখতার বলেন, ইউজিসি তো আর স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একক ভর্তি পরীক্ষায় আনতে পারে না; যদি মহামান্য রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি না করেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘৭৩ এর আইন’ অনুযায়ী আমরা একক ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ভেবে দেখব বলেও জানান তিনি।
এছাড়াও একই বিষয়ে মতামত দিয়েছেন কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখরও। তিনি বলেছেন, আমার কাছে মনে হয় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা পরীক্ষা হলে ভালো হয়। এতে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমবে।
তিনি বলেন, একক ভর্তি পরীক্ষায় জটিলতা থাকবে না। একক ভর্তি পরীক্ষায় একটা মেরিট লিস্ট হবে। মেরিট লিস্ট অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা ক্রাইটেরিয়া ফুলফিল করে তাদের পছন্দের সাবজেক্টে ভর্তি হতে পারবে। এতে সময় যেমন বাঁচবে, শিক্ষার্থীরা চাপ থেকেও বাঁচবে। এমনিতেই পরীক্ষার সময়টায় শিক্ষার্থীরা নানান রকম চাপে থাকে। তাই আমি মনে করি একক ভর্তি পরীক্ষা হওয়া আপাতত ইতিবাচক।