২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৪৯

গরিব শিক্ষার্থীদের ভর্তির পথ কঠিন করছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো?

ভর্তি পরীক্ষার তিন ‍গুচ্ছ ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে  © ফাইল ছবি

শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি প্রক্রিয়া সহজ করতে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ থেকে শুরু হয় গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা। এইচএসসি ও সমমান উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা এতে কিছুটা সুবিধা পাচ্ছিলেন। বিশেষ করে গরিব ও অসচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ বেড়েছিল। তবে চলতি বছর সে ধারায় ছেদ পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। শীর্ষস্থানীয় অনেক বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ থেকে বেরিয়ে আলাদা ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ কমবে অসচ্ছল ও গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের।

২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে প্রথমবার ২০টি এবং পরের বছর থেকে ২২টি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়। আর সর্বশেষ ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে ছিল ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয়। একইভাবে বুয়েট বাদে বাকি তিন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ছিল প্রকৌশল গুচ্ছ। কৃষি গুচ্ছে ছিল কৃষি বিষয়ে ডিগ্রি দেওয়া ৯ বিশ্ববিদ্যালয়। এসব গুচ্ছের কারণে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমেছিল অনেক। খরচও কমেছে। পাশাপাশি ভর্তির সুযোগও বেড়েছিল। তবে তিন গুচ্ছই ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা জোরালো হওয়ায় শিক্ষার্থীদের ভর্তি নিয়ে এবার বেশ ভোগান্তি পোহাতে হবে। এতে উদ্বেগ আরও বাড়ছে অসচ্ছল শিক্ষার্থীরা।

বুয়েট, মেডিকেল, ঢাবিসহ স্বায়ত্তশাসিত চার বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও আগে থেকেই আলাদা ভর্তি পরীক্ষা নিচ্ছে। এর সঙ্গে তিন গুচ্ছের অধীন মোট ৩৬টি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রকৌশল গুচ্ছ থেকে কুয়েট ও রুয়েট বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে চুয়েটকে আলাদা ভর্তি পরীক্ষা নিতে হবে। সে হিসেবে, প্রকৌশল গুচ্ছ আর থাকছে না। অভিযোগ রয়েছে, ভর্তি পরীক্ষা থেকে বাড়তি আয়ের জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আলাদাভাবে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে থাকে।

২৪ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ গুচ্ছ থেকে বেরিয়ে গেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। শাবিপ্রবি ও বশেমুরবিপ্রবিও বেরিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ও এ ধরনের মনোভাবের কথা প্রকাশ করেছে। ফলে এ গুচ্ছও ভেঙে যাচ্ছে। যদিও শেষ পর্যন্ত এ গুচ্ছে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

কৃষি গুচ্ছ থেকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বেরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে। তারা শেষ পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত নিলে কৃষি গুচ্ছ পুরোপুরি ভেঙে যেতে পারে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কমতে পারে। সবমিলিয়ে এ পর্যন্ত তিন গুচ্ছের একটি ভেঙে যাওয়া নিশ্চিত। বাকি দু’টিও ভেঙে যেতে পারে বা পরিসর কমতে পারে। এতে চলতি শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের।

গুচ্ছ ভাঙার ফলে একজন শিক্ষার্থীর ১০ থেকে ১৫টি কিংবা তারও বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিক ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে হতে পারে। প্রতিযোগিতা বেশি থাকায় দু’একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেই ভর্তির নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থীর ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে দু’টি করে অন্তত ২০টি ইউনিটে পরীক্ষা দিতে হতে পারে। অনেকে আরও বেশি ইউনিটেও পরীক্ষা দিতে পারেন।

এবার প্রতি ইউনিটে আবেদনে খরচ পড়বে ১ থেকে দেড় হাজার টাকা। সেক্ষেত্রে ২০টি ইউনিটে আবেদনে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা খরচ হবে। ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত ও খাওয়া দাওয়া বাবদ খরচ হবে গড়ে ২ হাজার করে ধরলেও ২০ হাজার টাকা। আর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে খরচ হবে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। কোনওটিতে ভর্তি বাতিল করে আরেকটিতে ভর্তি হতে চাইলে একই অঙ্কের অর্থ খরচ হবে।

এর আগে কোচিং করলে ভর্তি থেকে অন্তত তিন মাসের খরচ ও মডেল টেস্ট বাবদ অন্তত ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। সবমিলিয়ে এইচএসসি পাসের পর কোচিং থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থীর খরচ হবে ১ থেকে দেড় লাখ টাকা। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার কথা বিবেচনা করলে বিপুল সংখ্যক পরিবারের এ খরচ বহন করার সক্ষমতা নেই। উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং ধনী পরিবারের শিক্ষার্থীরাই এ ধরনের খরচ বহন করার সক্ষমতা রাখেন।

আরো পড়ুন: ঢাবিতে আবেদনের সুযোগ আর চারদিন, যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির তারিখ জানা গেল

এভাবে হিসাব করলে গুচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়া ভেঙে যাওয়ায় গরিব ও অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির ‍সুযোগ সঙ্কুচিত হচ্ছে। অথচ গুচ্ছ থাকলেই কোচিং খরচ বাদে মাত্র ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার মধ্যে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি সুযোগ নিতে পারতেন। এক খরচেই অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের সুযোগ পেতেন। এখন প্রতিটিতে আলাদা আলাদা আবেদন করতে হবে। সে সামর্থ্য অধিকাংশ শিক্ষার্থীরই নেই।

শুধু তাই নয়, নানা ধরণের দুর্ভোগও পোহাতে হবে শিক্ষার্থীরা। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত ও থাকা-খাওয়া খরচ তো আছেই। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ধরনও একটির তুলনায় অন্যটি কিছুটা ভিন্ন হয়। সেক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য আলাদা মনোযোগ দেওয়ার প্রয়োজন হবে। ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির ক্ষেত্রও বিস্তৃত হবে। কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় কবে ভর্তি পরীক্ষা ও অন্যান্য কার্যক্রম চলবে, তাও নজরে রাখতে হবে ভর্তিচ্ছুদের।

অনেকের অভিভাবকসহ যাতায়াত ও অন্যান্য কাজের ঝক্কিও কম নয়। সবমিলিয়ে এবার গুচ্ছ পরীক্ষা না হলে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কমলে ভর্তিচ্ছুদের ব্যস্ততা, পড়াশোনা, খরচ ও দুর্ভোগ বাড়বে। এসব সমন্বয় করা গরিব ও অসচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীদের জন্য কঠিন। সেক্ষেত্রে তাদের কথা চিন্তা করে সময় থাকতে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগী হতে হবে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনকে (ইউজিসি)। গুচ্ছে কোনও ত্রুটি থাকলে সেগুলোর সমাধান করে দ্রুত ভর্তি শেষ করার পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় অনেক শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মী।