এবারও কি এসএসসি-এইচএসসিতে অটোপাস?
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কবে খোলা যাবে সেটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় আগামীকাল সোমবার (৬ এপ্রিল) থেকে দেশে আবারও লকডাউন শুরু হচ্ছে। এ অবস্থায় চলতি বছরের এসএসসি ও এইচএসসি এবং সমমানের পরীক্ষা আয়োজন নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
এ অবস্থায় ফের আলোচনায় এসেছে অটোপাসের বিষয়টি। আবারও লকডাউন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সে সম্ভাবনা জোরালো হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞ ও অভিভাবকরা মনে করছেন, পরীক্ষা নিয়েই ফলাফল ঘোষণা করা উচিৎ। অন্যথায় শিক্ষার্থীরা আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। দেশে করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকায় ফের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়ানো হয়েছে আগামী ২২ মে পর্যন্ত। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখাসহ ১৮ দফা নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।
এরমধ্যেই সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জানান, সবার নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। আমরা সবাইকে সচেতন হতে অনুরোধ করি। নিশ্চিত থাকতে পারেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষক-শিক্ষার্থী অভিভাবক সকলের স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা চিন্তা করে, সার্বিক নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছেন।
যদিও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সভাপতিত্বে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর এসএসসি পরীক্ষার্থীদেরকে ৬০ দিন আর এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ৮০ দিন ক্লাস করানো হবে। এজন্য তাদের সপ্তাহে ছয় দিনই ক্লাস করতে হবে।
ওই বৈঠকে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা কবে নেয়া হবে সে বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী কিছু না জানালেও মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মাহবুব হোসেন জানিয়েছেন, জুলাইয়ে এসএসসি পরীক্ষা হলে সেপ্টেম্বরে এইচএসসি পরীক্ষা নেয়া হবে। এসএসসি পরীক্ষার পর এক মাস সময় নিয়ে এইচএসসি পরীক্ষা আয়োজন করা হবে।
কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্কুল-কলেজ খোলা সম্ভব না হলে এসএসসির জন্য ৬০ দিন ও এইচএসসির ৮০ দিনের সংক্ষিপ্ত সিলেবাস পড়িয়ে শেষ করা সম্ভব হবে না। সিলেবাস শেষ না হলে আয়োজন করা যাবে না এ দুই বড় পাবলিক পরীক্ষা। তা সম্ভব না হলে গত বছরের মতো এবারও অটোপাস দিয়ে সনদ দেয়া হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
দেশের বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের এসএসসি পরীক্ষা আয়োজন করতে শিক্ষা বোর্ডগুলো সব ধরনের প্রস্তুতি শুরু করেছে। ইতোমধ্যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে শিক্ষার্থীদের বিলম্ব ফি ছাড়া ফরম পূরণে আগামী ১ থেকে ৭ এপ্রিল ও ফি’সহ ১০ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত ফরম পূরণের সময় ঘোষণা করা হয়েছে। এ বছর স্কুলে নির্বাচনী পরীক্ষা ছাড়াই নিবন্ধনভুক্ত শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় বসার সুযোগ পাচ্ছেন।
এদিকে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নেয়া সম্ভব নয় বলে মনে করছেন আন্তঃশিক্ষা সমন্বয়ক বোর্ডের সভাপতি ও ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নেহাল আহমেদ। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা আয়োজনে আমাদের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। আগামী সপ্তাহে এসএসসির ফরম পূরণ শুরু হবে। সেটি শেষ হলে পরবর্তীতে এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু করা হবে।
তিনি জানান, ইতোমধ্যে এসএসসির জন্য তিন ঘণ্টা সময়ে ১০০ নম্বরে তত্ত্বীয় ও বহুনির্বাচনী পরীক্ষার জন্য প্রশ্নপত্র চূড়ান্ত করা হয়েছে। এইচএসসির প্রশ্নপত্র তৈরির কাজ চলছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে দুই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রেসে পাঠানো হবে।
তিনি আরও জানান, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সংক্ষিপ্ত সিলেবাস শেষ করে এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষা নেয়া হবে। সিলেবাস পড়ানো সম্ভব না হলে এ পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হবে না। তবে প্রতি মুহূর্তে পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে। আগামী ২৩ মে’র মধ্যে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে পাঠদান শুরু করা হবে। নতুবা আগের বছরের মতো বিকল্প পথে চিন্তা করতে হবে।
এ বিষয়ে অধ্যাপক এসএম আমিরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি খুললে সম্ভব ছিল। এখন যেহেতু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে বিলম্ব হচ্ছে, স্বাভাবিকভাবেই এসএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে যাবে। কারণ শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, না পড়িয়ে পরীক্ষা নেয়া হবে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, দেশে করোনা পরিস্থিতি যেভাবে বাড়ছে তাতে চলতি বছর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা আয়োজন করা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। আগামী তিন থেকে চার মাসের মধ্যে যদি করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয় তবে এসব পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হবে। অন্যথায় সিলেবাস শেষ না হলে এ দুই পাবলিক পরীক্ষা আয়োজন করা যাবে না। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে সারাদেশে এসএসসির প্রায় ২৩ লাখ শিক্ষার্থীর একসঙ্গে পরীক্ষা নেয়া অসম্ভব কর্মযজ্ঞ।
তবে ওই কর্মকর্তারা আরও জানান, যদি চার বা পাঁচ মাসের মধ্যেও করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়, সে ক্ষেত্রে মোট উত্তরপত্রের ৫০ শতাংশ কমানো হতে পারে। পরীক্ষার জন্য তিন ঘণ্টা সময়ের বদলে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা করে পরীক্ষা নেয়ারও বিকল্প পরিকল্পনা চিন্তা করা হচ্ছে। পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
এদিকে সরকারি-বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয় আগামী ২৪ মে’র পর খোলা হবে, এমন ঘোষণার পর এ দুটি পরীক্ষা জুন-আগস্টেও হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বোর্ড কর্মকর্তারা। শিক্ষাবোর্ড ও এনসিটিবি কর্মকর্তারা বলছেন, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা সম্ভব হবে, এমনটি ধরে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা জুন-আগস্টে নেয়ার ব্যাপারে ওই ঘোষণা দিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী। কিন্তু ছুটি ২৩ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। করোনার সংক্রমণের কারণে এ সময়ের পরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে কি-না, তা অনিশ্চিত। তাই সংক্ষিপ্ত সিলেবাস শেষ করা সম্ভব না হলে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হবে না। সেজন্য পরিস্থিতি তৈরি হলে অটোপাসে সনদ বিতরণ করতে হতে পারে।
দেশের দুই বড় পাবলিক পরীক্ষা এসএসসি এবং এইচএসসি কবে অনুষ্ঠিত হবে তা নিয়ে ধোঁয়াশায় রয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও। নোয়াখালী জেলার গণীপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী সালমা আক্তারের এবার এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে তার সব পরিকল্পনা ওলটপালট হয়ে গেছে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে সালমা বলেন, ‘আমি পরীক্ষার জন্য খুব ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। কিন্তু লকডাউন শুরুর পর থেকে কোচিং, প্রাইভেট সব বন্ধ। যা পড়েছিলাম, তাও এখন ভুলতে বসেছি। পরিক্ষার তারিখ দিলে আবার ভালোভাবে পড়াশোনা শুরু করতে হবে। ইচ্ছা ছিল জিপিএ-৫ পাওয়া, কিন্তু দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে দূরে থাকায় পড়াশোনা তেমন হচ্ছে না। এখন আবার লকডাউন শুরু হয়েছে তাই ঠিক কবে নাগাদ দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে তাও বলা যাচ্ছে না।’
এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন মেহনাজ শাহরিয়ার আহমেদ। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে পুরো এক বছর স্কুল বন্ধ থাকায় ক্লাস করতে পারেননি তারা। তবে অটোপাস দেয়া হলে ভবিষ্যতে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়তে হতে পারে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমরা তো পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের অসুবিধা হবে না। যারা বন্ধ করে দিয়েছে, তাদের সমস্যা হতে পারে।’
এসএসসি পরীক্ষা বাতিল করা নিয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে সাথে অভিভাবকদের মধ্যেও রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ কেউ অটোপাসের পক্ষে মত দিলেও অনেকে আবার এর বিপক্ষে মত দিয়েছেন। এসএসসি পরীক্ষার্থীর অভিভাবক মরিয়ম আক্তার মনে করেন, অটোপাসের তুলনায় পরীক্ষা হলেই ভাল। তিনি বলেন, পরীক্ষা হলে মেধার মূল্যায়ন হওয়ার একটা সুযোগ থাকে। কিন্তু অটোপাস হলে সেই সুযোগ বাদ হয়ে যায়। সে কারণেই পরীক্ষা চান তিনি।
এদিকে, অটোপাশের বিপক্ষে মত দিয়ে শিক্ষাবিদ এবং এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য যদি অটোপাসের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তাহলে সেটি হবে দুর্ভাগ্যজনক। গত বছর এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের অটোপাস দেয়া হলেও তারা তাদের পুরো দুই বছরের পড়াশোনা এবং পরীক্ষার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিল। শুধু পরীক্ষা নেয়াটা সম্ভব হয়নি। তবে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। যার কারণে ভবিষ্যতে তারা সমস্যায় পড়তে পারেন বলে মত দিচ্ছেন তারা।
এ বিষয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, ‘যে দেশ থেকে বিদেশিরা পরামর্শ এবং বিশেষজ্ঞ ফি বাবদ প্রতি বছর ৩৫ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যায়, সে দেশে মানুষ থাকার পরও আমরা কাজ করতে পারি না, আমরা দক্ষ না। আর এর মধ্যে যদি অটোপাসের আবর্তে পড়ি তাহলে আমাদের অবস্থা খুবই খারাপ হবে।’