জিপিএ-৫ যখন গর্ব নয়, সাফল্যের, আড়ালে লুকানো সংকট
প্রতি বছর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে অভিনন্দনের বন্যা বয়ে যায়। হাস্যোজ্জ্বল মুখে ফুলের তোড়া হাতে তরুণ-তরুণীদের ছবি ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্রই। গর্বিত অভিভাবকরা সন্তানের সাফল্যে উচ্ছ্বসিত হন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের ‘রেকর্ড সাফল্য’ নিয়ে গর্ব করে, রাজনীতিকরা প্রতিবছর একে ‘ঐতিহাসিক সাফল্য’ বলে প্রচার করেন।
তবে চকচকে সাফল্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক ভিন্ন বাস্তবতা। সংখ্যায় সাফল্যের ঝলক থাকলেও মানে সেই আলো নিভে যেতে বসেছে। পরীক্ষার ফলের উজ্জ্বল পরিসংখ্যানের ভেতরে লুকিয়ে আছে শিক্ষার গুণগত মানের সংকট, মুখস্থনির্ভরতা, সৃজনশীলতার ঘাটতি, এবং বাস্তবজীবনের অপ্রস্তুতি।
গত ১৫ বছরের (২০২৪ সাল পর্যন্ত) পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ার পেছনে প্রকৃত শিক্ষার মানোন্নয়নের চেয়ে অন্যান্য কারণই বেশি প্রভাব ফেলেছে। ২০০৯ সালে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন প্রায় ২০ হাজার শিক্ষার্থী। ২০১৪ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭০ হাজারেরও বেশি। এরপর আসে ২০২০, মহামারির বছর, সেবার কোনো পাবলিক পরীক্ষাও হয়নি। তবু আগের পরীক্ষার ফলাফল ও অভ্যন্তরীণ মূল্যায়নের ভিত্তিতে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজারে। পরবর্তী বছরগুলোতেও চলতে থাকে এই গ্রেড-স্ফীতি। ২০২১ সালে ১ লাখ ৮৯ হাজার এবং ২০২২ সালে ১ লাখ ৭৬ হাজার শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ অর্জন করে। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা কিছুটা কমে দাঁড়ায় প্রায় ৭৮ হাজারে। কিন্তু ২০২৪ সালে আবার বেড়ে প্রায় ১ লাখ ৪৬ হাজারে পৌঁছায়।
একসময় যে ফলাফল কঠোর পরিশ্রম ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক ছিল, এখন তা অনেকটা প্রত্যাশিত ফলাফলে পরিণত হয়েছে। যার পেছনে শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের চেয়ে নীতিগত সিদ্ধান্তের প্রভাবই বেশি। তবে সমস্যা এটা নয় যে, এখন জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি; বরং সমস্যা হলো, গ্রেড বা ফলাফল আর আগের মতো মূল্যায়নযোগ্য থাকছে না।
সাফল্যের স্ফীতি বাংলাদেশের শিক্ষার ফলাফলকে এক ধরনের রাজনৈতিক নাটকের মঞ্চে পরিণত করেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনকাল থেকে এই প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পায়। এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার ফলাফলকে ব্যবহার করা হচ্ছে উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার প্রতীক হিসেবে। প্রতি বছরের ‘রেকর্ড সাফল্য’ যেন সরকারের ‘আধুনিক শিক্ষা’ ও ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার প্রতিশ্রুতির প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু এর আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে একটি গভীর সমস্যা, শিক্ষার্থীরা কাগজে যেটুকু অর্জন দেখে, বাস্তবে শ্রেণিকক্ষে কিংবা বা কর্মক্ষেত্রে সেই দক্ষতার প্রকাশ পায় না।
করোনা মহামারির বছরগুলোতে সমস্যাটি সবচেয়ে স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। ২০২০ সালে যখন পরীক্ষা বাতিল করা হয়, তখন শিক্ষার্থীদের আগের ফলাফলের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয়। সে বছর কোনো পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি, তবু অটোপাশের ফলে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। পরবর্তী বছরগুলোতেও এই ধারা অব্যাহত ছিল। ২০২১, ২০২২ ও ২০২৩ সালের পরীক্ষাগুলো সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের ভিত্তিতে কিংবা সংক্ষিপ্ত আকারে নেওয়া হয়। ২০২৪ সালে সরকার পতনের পর কিছু বিষয়ে কথিত ‘অটোপাস’-এর চলন রয়েই যায়, এ বছর প্রায় ১ লাখ ৪৬ হাজার শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পায়। যদি ফলাফল উন্নত মানের প্রতিফলন হতো, তাহলে এমন হঠাৎ উত্থান কতটা সম্ভব তা প্রশ্নসাপেক্ষ। এ থেকে বোঝা যায় যে, রাজনৈতিক সুবিধার জন্য গ্রেডিং সিস্টেমকে একরকম ব্যবহার করা হয়েছে।
শিক্ষক ও শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বহুবার সতর্ক করেছেন যে, এভাবে ফলাফল স্ফীতি ঘটানো দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। যখন প্রায় সবাই সর্বোচ্চ গ্রেড পায়, তখন সেটি আর প্রকৃত মূল্যায়ন থাকে না। নিয়োগকর্তা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি বোর্ডগুলো প্রকৃত মেধাবী শিক্ষার্থীকে আলাদা করে চেনার সুযোগ হারায়। ফলে দেশের সনদের মান দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় পর্যায়েই দুর্বল হয়ে পড়ছে।
জিপিএ-৫ পাওয়ার প্রতি অতিরিক্ত মোহ এমন একটি সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে, যেখানে শেখার চেয়ে গ্রেডই বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। অভিভাবকরা সন্তানদের কোচিং সেন্টারে ঠেলে দিচ্ছেন। শিক্ষার্থী বাস্তবে কতটুকু শিখতে পারল তার চেয়ে অধিক নম্বর পাওয়া যেন মূখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপরদিকে, শিক্ষার্থীরাও বোঝার পরিবর্তে মুখস্থবিদ্যার দিকে বেশি ধাবিত হচ্ছে। জ্ঞান অর্জন নয়, পরীক্ষায় নম্বর বেশি পাওয়াই যেন জীবনের মূল লক্ষ্য।
যার ফলে দেখা যায়, জিপিএ ৫ পাওয়া অনেক শিক্ষার্থীরাই মনঃপূত বিশ্ববিদ্যালয়ে পরার সুযোগ পাচ্ছেন না, এমনকি ফলাফলের বাইরে উল্লেখযোগ্য সফলতা পাচ্ছেন না। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা প্রায়ই অভিযোগ করেন জিপিএ-৫ পাওয়া অনেক শিক্ষার্থী একটি স্পষ্ট অনুচ্ছেদও লিখতে পারে না কিংবা মৌলিক কোনো ধারণা বিশ্লেষণ করতে ব্যর্থ হয়। চাকরি ক্ষেত্রে নিয়োগদাতারাও একই হতাশা প্রকাশ করেন। তাদের মতে, নতুন গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে যোগাযোগ দক্ষতা, বিশ্লেষণ ক্ষমতা এবং বাস্তব জ্ঞানের ঘাটতি রয়েছে। ফলাফলের মাত্রা যখন ঊর্ধ্বমুখী, কিন্তু শিক্ষার মান নিম্নমুখী, তখনই মূল ঘাটতির জায়গা স্পষ্ট হয়।
ফলাফল স্ফীতির ফলে প্রত্যাশা ও বাস্তবতার ফারাক
অভিভাবকরা মনে করেন, সন্তানদের জিপিএ-৫ পেতেই হবে, কারণ ‘সবাই তো পাচ্ছে’। স্কুলগুলো একে-অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছে, কে বেশি জিপিএ-৫ পাবে, সেই লক্ষ্যেই পাঠদান সাজানো হয়। রাজনীতিবিদরাও ফলাফলকে জাতীয় অগ্রগতির প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরেন। কিন্তু এর ফলে সম্পূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থা পিছিয়ে পড়ছে।
জিপিএ-৫ পাওয়া অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা যখন জীবনে বাস্তবতার মুখোমুখি হয়, তখন প্রত্যাশা ও বাস্তবতার ব্যবধান বুঝতে পারে। অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের লেখাপড়া বা চাকরির বাজারে নিজেকে মানিয়ে নিতে ব্যর্থ হন। একটি প্রজন্ম বেড়ে উঠছে এই ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে যে, জিপিএ-৫-ই মেধার মাপকাঠি। কিন্তু বাস্তব জীবনে এসে তারা উপলব্ধি করে, পরীক্ষার বাইরের জগতে সাফল্যের জন্য প্রয়োজন একেবারেই ভিন্ন ধরনের দক্ষতা। যেখানে পুথিগত জ্ঞানের চেয়ে বাস্তবিক জ্ঞানই মুখ্য।
অতিরিক্ত জিপিএ-৫ সমস্যাটি শুধু শিক্ষার পরিসংখ্যানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নকেও বাধাগ্রস্ত করছে। যখন ফলাফলের মান হারিয়ে যায়, তখন শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর থেকে মানুষের আস্থাও হারিয়ে যায়। আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় ও নিয়োগদাতারা তখন বাংলাদেশি সনদপত্র ও যোগ্যতাকে মূল্যায়ন করতে পারেন না। দেশের ভেতরেও মেধাবী শিক্ষার্থীরা হতাশ হয়ে পড়ে, যখন তাদের পরিশ্রমকে মিথ্যা ফলাফলের ভিড়ে হারিয়ে ফেলা হয়।
এছাড়াও অতিরিক্ত উচ্চ ফলাফলের প্রাচুর্য এক ধরনের অস্বাস্থ্যকর চাপ তৈরি করে। যারা জিপিএ-৫ পায় না, তারা অনেক সময় নিজেকে পিছিয়ে পড়া মনে করে। এ তুলনার সংস্কৃতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিষণ্নতা ও হতাশা সৃষ্টি করছে। সবাইকে বিজয়ী বানাতে গিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থা নিজেদেরকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে।
গ্রেডিং ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা পুনরুদ্ধার করা সহজ নয়,এজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সততা ও শিক্ষাক্ষেত্রে স্বাধীনতা। পরীক্ষাগুলোকে অবশ্যই সব ধরনের প্রভাব ও রাজনৈতিক স্বার্থ থেকে মুক্ত রাখতে হবে। সংকটকালে সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচি বা ‘অটোপাস’ হয়তো সাময়িক সমাধান ছিল, কিন্তু রাজনৈতিক সুবিধার জন্য তা চালিয়ে যাওয়া একটি প্রজন্মের ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করছে।
শিক্ষকদের এমন ক্ষমতা দিতে হবে যাতে তারা ছাত্রদের ন্যায্যভাবে মূল্যায়ন করতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয় ও নিয়োগদাতাদেরও জিপিএ-এর ওপর একক নির্ভরতা পুনর্বিবেচনা করতে হবে। প্রাপ্ত নম্বরের পাশাপাশি দক্ষতা, সৃজনশীলতা ও সমস্যা সমাধানের ক্ষমতাকে গুরুত্ব দিতে হবে। অভিভাবকদেরও উচিত হবে নম্বরের পেছনে না ছুটে সন্তানদের প্রকৃত শিক্ষা ও মানসিক দৃঢ়তা অর্জনে উৎসাহিত করা।
ভবিষ্যতের জন্য প্রশ্ন
জিপিএ-৫ এর সংখ্যা বৃদ্ধিকে অনেকেই সাফল্য হিসেবে মনে করেন। কিন্তু এর পিছনে লুকিয়ে আছে একটি গভীর ব্যর্থতা। একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কেবল ফলাফল স্ফীতির ওপর নির্ভর করে টিকে থাকতে পারে না। প্রকৃত অগ্রগতি আসে সঠিক মূল্যায়ন ও পাঠদান থেকে। যদি বাংলাদেশ এই গ্রেডিং পদ্ধতিকে রাজনৈতিক গর্বের প্রতীক হিসেবে দেখতেই থাকে, তবে একসময় একাডেমিক সততার ভিত্তিটুকুও হারিয়ে যাবে।
পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০০৯ সালে যেখানে জিপিএ-৫ পেয়েছিল ২০ হাজার শিক্ষার্থী, ২০২৪ সালে সেখানে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজারেরও বেশি। অথচ খুব কম মানুষই বিশ্বাস করেন যে, এই পনেরো বছরে শিক্ষার মান সাতগুণ বেড়েছে।
শিক্ষার উদ্দেশ্য জাতিকে আলোকিত করা, শুধুই মার্কশিট সাজানো নয়। যতদিন না ফলাফলের ওপর বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা যায়, ততদিন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এমন সার্টিফিকেট পাবে, যেগুলো দেখতে আকর্ষণীয় হলেও আসলে কোনো মূল্য থাকবে না।
২০২৫ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় জিপিএ-৫ এর চিত্র যেমন ছিল
গতকাল বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। এবার সারা দেশে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৬৯ হাজার ৯৭ জন। গত বছর, অর্থাৎ ২০২৪ সালে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯১১ জন। সেই হিসাবে এবার জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ৭৬ হাজার ৮১৪ জন।
জিপিএ–৫ সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় কম কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ফল প্রকাশের পর শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, আমরা এমন এক সংস্কৃতি গড়ে তুলেছি যেখানে সংখ্যাই সত্য হয়ে উঠেছিল—পাসের হারই সাফল্যের প্রতীক, জিপিএ ৫–এর সংখ্যা ছিল তৃপ্তির মানদণ্ড। একজন দায়িত্বশীল উপদেষ্টা হিসেবে আমি চাই, শিক্ষা ব্যবস্থা আবার বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করুক। যে ফলাফল শিক্ষার্থীর শেখাকে সত্যিকারের মূল্যায়ন করে, সেটিই হোক আমাদের সাফল্যের মানদণ্ড।