২৬ নভেম্বর ২০২৫, ১৩:৪৩

যশোরের সাংস্কৃতিক তীর্থস্থান মণিহার ভাঙার খবরে হৃদয় ভাঙছে সিনেমাপ্রেমিদের

মণিহার হল  © সংগৃহীত

দিন বদলে কালের গর্ভে হারিয়ে যায় অনেক কিছু। তবু কিছু স্মৃতি মনের মণিকোঠায় অমলিন হয়ে থাকে। তেমনি এক স্মৃতিময় নাম মণিহার। আভিধানিক পরিভাষায় মণিহার অর্থ রত্নধারণকারী। ঠিকই যেন মণিহার সিনেমা হল ছিল যশোরের রত্ন। যে রত্ন ধারণ করে যশোর দেশের সীমানা পেরিয়ে গোটা এশিয়ায় পেয়েছিল এক অনন্য পরিচিতি। কিন্তু সেই মণিহার বন্ধ হয়ে যাবার দুসংবাদে এখন চলছে অন্যরকম আবহ। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে অগণিত মানুষের। ব্যাথাতুর কণ্ঠে অনেকেই জানিয়েছেন তাদের বেদনাবিধূর অভিব্যক্তি।

সময়টা ১৯৮২ সাল। যশোরের ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম সুস্থ বিনোদনের জন্য মানসম্মত সিনেমা হল নির্মাণের উদ্যোগ নেন। পত্রিকার মাধ্যমে নাম আহবান করা হয়। সেই আহবানে সাড়া দেন কয়েকশ শিল্পানুরাগী। তাদের দেয়া নামের মধ্য থেকে মণিহার নামটি চুড়ান্ত হয়। দেড় বছর ধরে যশোর সিটি কলেজ সংলগ্ন প্রায় চার বিঘা জমির উপর নির্মিত হয় মণিহার সিনেমা হল। ঢাকার স্থপতি কাজী মোহাম্মদ হানিফ ছিলেন সিনেমা হলের আর্কিটেক্ট। নির্মাণের পর শোভাবৃদ্ধির কাজ করেন বরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান। নকশা ও বৈচিত্রময় কারুকাজের স্থাপত্য শিল্পে চারতলা ভবনে একহাজার ৪৩০ আসনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সিনেমা হলটি যাত্রা শুরুর দিন থেকেই ছিল সারাদেশে আলোচিত একটি নাম। সিনেমার রিলের আদলে র‌্যাম্প সিঁড়ি, ঝরনা, মনোমুগ্ধকর ঝাঁড়বাতি, উল্টো ঘড়ি আর স্বয়ংক্রিয় পর্দা তখন ছিল সবার মুখে মুখে। বিশেষ করে র‌্যাম্প সিড়ি দিয়ে মোটর সাইকেল বা প্রাইভেট কার চালিয়ে উঠা যেত তিনতলায় ড্রেস সার্কেল রুমে। খুলনা বেতারে দুপুরে মণিহার সিনেমা হল নিয়ে প্রচারিত অনুষ্ঠানে এ সব তথ্য মানুষের কাছে সিনেমা হলটিকে করে তুলেছিল পরম আরাধ্য। যার টানে দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসতো দর্শক ।

১৯৮৩ সালের ৮ ডিসেম্বর দেওয়ান নজরুল পরিচালিত সোহেল রানা ও সুচরিতা অভিনীত ‘জনি’ সিনেমা দিয়ে শুরু হয় মণিহারের প্রদর্শনী। সেই প্রথম প্রদর্শনীর ম্যাটিনি শো’তে পাঁচটাকা দিয়ে টিকিট কেটে সিনেমাটি উপভোগ করেন আবু কালাম। তখন তার বয়স ছিল ১১ বছর। বাড়ি ঝিকরগাছার কায়েমকোলায় হলেও তারা তখন সিটি কলেজ পাড়ায় ভাড়া থাকতেন পৌরসভার চাকুরে আমীর হোসেনের বাসায়। সেই স্মৃতি রোমন্থন করে আবেগ আপ্লুত হন তিনি। বলেন, তখন মণিহারে সিনেমা দেখার টিকিট ছিল অনেকের কাছে সোনার হরিণের মতো। যত লোক হলের মধ্যে প্রবেশ করতেন তার চাইতেও বেশি লোক হলের বাইরে অপেক্ষা করতেন টিকিট না পেয়ে। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে কাউন্টার থেকে টিকিট কাটার জন্য সে কি প্রতিযোগিতা। ব্লাকে টিকিট তখন রমরমা ব্যবসা। যারা লাইনে দাঁড়ানোর হ্যাপায় যেতেন না তারা চড়া দামে টিকিট কিনতেন ব্ল্যাকারদের কাছ থেকে। পুরোনো দিনের কথামালায় উঠে আসে টিকিট না পেয়ে অসদুপায় অবলম্বনের গল্পও। কখনো চোখে গুল ছিটিয়ে কখনো ব্লেড মেরে টিকিট ছিনিয়ে নিতো কেউ কেউ। উদ্দেশ্য অসৎ হলেও প্রাণান্ত চেষ্টা ছিল একবারের জন্য হলেও হলের ভেতরে গিয়ে ছবি দেখা। নরম গরম সিনেমা চলাকালীন নায়ক ইলিয়াস  জাবেদ আর নায়িকা অঞ্জু ঘোষকে সচক্ষে দেখা যেন সেই সময় তার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা।

আবু কালামের কথায় সায় দেন সদর উপজেলার রঘুরামপুর গ্রামের শাহজান আলী। তিনি বলেন ভারতে দক্ষিণ ২৪ পরগোনার বশিরহাট থেকে তার বাড়িতে দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় এসেছিলেন শুধু মণিহারে একটি ছবি দেখার আশায়। সে স্মৃতিময় মুহূর্ত উঠে আসে শাহাজান আলীর কণ্ঠে।

মণিহারে সিনেমা দেখার আরো চমকপ্রদ তথ্য দিলেন মণিরামপুর উপজেলার নেহালপুর ইউনিয়নের পাচাকড়ি গ্রামের প্রবীণ বিনান্ত চৌধুরী। বয়স আশির কোঠায়। ক্ষীণ হয়েছে চোখের আলো তবু স্মৃতি যেন এখনো জ্বলজ্বলে। মণিরামপুরের হিন্দু অধ্যুষিত বিস্তীর্ণ এলাকাকে স্থানীয় ভাবে ৯৬ গ্রাম বলা হয়। সেই গ্রাম থেকে দল বেঁধে বিনান্ত চৌধুরীরা গরুর গাড়ি চেপে মণিহারে আসতেন সিনেমা দেখতে। পথের দূরত্ব আর বাহনের কারণে দিনের দিন টিকিট পেতেন না। তাই রাত্রি যাপন করতেন সিটি কলেজ মাঠে। সেখানে পিকনিক আদলে চলতো রান্না আর খাওয়ার আয়োজন। পরদিন টিকিটি কেটে সিনেমা দেখে হৈ হল্লা করতে করতে বাড়ি ফিরতেন তারা।

মণিহার বাসস্ট্যান্ডে ২৫ বছর ধরে ইলেকট্রিক পণ্য বিকিকিনির ব্যবসা করছেন রফিকুল ইসলাম। সিটি ইলেকট্রিকের কর্ণধার রফিকুল ইসলামের কণ্ঠ ধরে আসে মণিহার সম্পর্কে বলতে গিয়ে। তিনি বলেন, সারাদেশে এই এলাকার পরিচিতি মণিহারের জন্যই। মণিহার বন্ধ হবে এটা আমাদের জন্য বুকভাঙ্গা কষ্টের সংবাদ। সিনেমা হলটি হতে পারে ব্যক্তি সম্পত্তি। তারা ব্যবসায়িক কারণে যে কোন সিদ্ধান্ত নিতেই পারেন। কিন্তু আমরা মনে করি এটি যশোরবাসীর সবার সম্পদ। সবার কতশত স্মৃতি আর আবেগ জড়িয়ে আছে এই হলটির সাথে।

সিনেমা হলের ব্যবস্থাপক মোল্লা ফারুক আহমদ যুক্ত আছেন সেই শুরু থেকেই। তার সাথে আলাপচারিতায় উঠে আসে সেই সোনালী দিনের নানা স্মৃতি। বেদের মেয়ে জোসনার টানা ১০ সপ্তার বেশি চলা আর দর্শকের পদচারনায় মুখরিত সেই সব দিনলিপি ভাসতে থাকে তার বর্ণনায়।

মণিহার সিনেমা হলের প্রতিষ্ঠাতা সিরাজুল ইসলামের ছেলে ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মিঠু বলেন, ভালো মানের ছবি না আসায় দর্শকহীন হয়ে পড়েছে মণিহার। ভালো ছবি না থাকলে হল কীভাবে চালাব? আমাদের আসন সংখ্য ১৪৩০। ২৫ জন স্টাফ। লোকসানের কারণে হিমশিম খেতে হচ্ছে। শুধু বিদ্যুৎ বিলই আসে মাসে এক থেকে দেড় লাখ টাকা। এভাবে চালানো যাচ্ছে না, তাই হলটি বন্ধ করে নতুন করে মার্কেট ও আবাসিক হোটেল নির্মাণের পরিকল্পনা চলছে। তবে কবে নাগাদ হলটি ভাঙা হবে, তা এখনো নিশ্চিত নয় বলে জানান তিনি। হল ভাঙলেও দুশো বা ততোধিক আসনের সিনেপ্লেক্স থাকার কথাও জানান মিঠু।

মণিহার শুধু একটি সিনেমা হলই না, দেশের শিল্প ও সংষ্কৃতির অন্যতম তীর্থস্থান। যা একনজর দেখার বাসনায় সারাদেশ এবং দেশের বাইরে থেকেও মানুষ ছুটে আসতো। যে সিনেমা হলের খ্যাতির সাথে জড়িয়ে ছিল যশোর। নিপুণ কারুকার্য শৈলির জৌলুসময় মণিহার সত্যিই এ অঞ্চলের মানুষের কণ্ঠহার। এর সাথে মিশে আছে হাজারো হৃদয়ের আবেগ, অনুভুতি-স্মৃতি। যশোরের শিল্প, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের অংশ এই মণিহারকে রক্ষার দাবি সুধিজনের।