২০ অক্টোবর ২০২০, ২১:৩১

‘কাশ্মির টাইমস’ কার্যালয় সিলগালা

কাশ্মিরের অন্যতম প্রাচীন দৈনিক কাশ্মির টাইমস’র কার্যালয় সিলগালা  © সংগৃহীত

ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের একটি শীর্ষ ইংরেজি দৈনিকের কার্যালয় সিলগালা করে দিয়েছে আঞ্চলিক প্রশাসন। সোমবার প্রশাসনের সম্পত্তি বিভাগ কাশ্মির টাইমস এর কার্যালয় বন্ধ করে দেয়।

সংবাদপত্রটির প্রকাশক বলছেন, মত প্রকাশের জন্য প্রতিহিংসার কারণেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

কাশ্মিরের অন্যতম প্রাচীন এই দৈনিক কাশ্মির টাইমস। এর কার্যালয় সেখানকার মূল শহর শ্রীনগরে। ১৯৯০-এর দশকে বরাদ্দ পাওয়ার পর থেকেই কার্যালয়টি ব্যবহার করে আসছিল সংবাদপত্রটি। এর মালিক এবং নির্বাহী সম্পাদক অনুরাধা ভাসিন জানান, সিলগালা করার আগে কর্তৃপক্ষ কোনও প্রক্রিয়া অনুসরণ করেনি।

তিনি বলেন, ‘আমাদের কোনও নোটিশ দেওয়া হয়নি। তারা (সম্পত্তি বিভাগের কর্মকর্তারা) হঠাৎ চলে আসে। আমাদের কর্মীরা অফিসে কাজ করছিলো। কর্মীদের তারা বাইরে বের হতে বলে তারা জানায় তালা দিয়ে দেওয়া হবে।‘

অনুরাধা ভাসিনের অভিযোগ এই মাসের শুরুতে তাকে জম্মু শহরের সরকারি বাড়ি থেকেও উৎখাত করা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রতিহিংসার রাজনীতির কারণেই তার কার্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে ভারতীয় প্রশাসন তাকে থামিয়ে দিতে চায় বলেও অভিযোগ করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘প্রতিহিংসা কারণ গত বছর যোগাযোগ বন্ধের বিরুদ্ধে আমি আদালতে যাই আর তখন থেকেই কাশ্মির টাইমসে সরকিারি বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যায়। তখন থেকেই এটা চলছে।’

গত বছরের ৫ আগস্ট ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন বাতিল করে অঞ্চলটিকে দুই ভাগে ভাগ করে দেয়। এতে ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠটি অঞ্চলটি কার্যত সরাসরি দিল্লির নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।

ওই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কোনও আন্দোলন গড়ে ওঠা ঠেকাতে ভারত সরকার অঞ্চলটি দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে কার্যত অবরুদ্ধ করে রাখে। যানবাহন চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ ছাড়াও বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেটসহ সব ধরনের যোগাযোগ। গ্রেফতার করা হয় শত শত রাজনীতিবিদকে।

ইন্টারনেট ও টেলিফোন লাইন বন্ধের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে পিটিশন দাখিল করেন কাশ্মির টাইমস-এর নির্বাহী সম্পাদক অনুরাধা ভাসিন। তিনি জানান, যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়ার পরও পত্রিকা প্রকাশ চালু রাখেন তিনি। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে কর্মী সংখ্যাও কমিয়ে ফেলতে হয় তাকে।

অনুরাধা ভাসিন বলেন, ‘আমরা বেশ কিছু সরকারি নীতি ও কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সমালোচনা করে লেখা চালু রাখি। এটা (কার্যালয় সিলগালা করে দেওয়া) আমার কণ্ঠরোধের প্রচেষ্টা। আমাকে থামানোর চেষ্টা। তারা আমাদের কার্যালয়ে তালা দিতে পারে কিন্তু আমাদের কণ্ঠে তারা তালা দিতে পারবে না।’

সিলগালা করে দেওয়া প্রসঙ্গে অঞ্চলটির সম্পত্তি বিভাগের এক কর্মকর্তা দাবি করেন তারা কাশ্মির টাইমস-এর কার্যালয় বন্ধ করে দেননি। তা কেবলমাত্র পরিদর্শন করা হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা কেবলমাত্র ওই ভবনটির দখল নিয়েছি। সেটি কয়েক বছর আগে মারা যাওয়া বেদ ভাসিনকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল।‘

অনুরাধা ভাসিনের বাবা বেদ ভাসিন ছিলেন কাশ্মির টাইমস-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। ২০১৫ সালে বেদ ভাসিনের মৃত্যু হয়। ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘ভবনটি বেদ ভাসিনকে বরাদ্দ দেওয়া হয় কিন্তু যখন বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তি মারা যান তখন সেই সরঞ্জাম বা কোনও স্থাপনা মারা যাওয়া কারো নামে অন্য কেউ ব্যবহার চালিয়ে যেতে পারেন না।‘ ওই কর্মকর্তার অভিযোগ সংবাদপত্রটির কার্যালয় বাসাবাড়ি হিসেবেও ব্যবহার করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘একই সময়ে ওই এলাকায় কাশ্মির টাইমসের নামে তাদের আরও একটি কোয়ার্টার আছে যেটি তারা কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করে।’

তবে ওই অঞ্চলের সাংবাদিকেরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। তারা বলছেন কাশ্মির টাইমস-এর বিরুদ্ধে নেওয়া পদক্ষেপ কাশ্মিরে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণে সরকারের আরেকটি প্রচেষ্টা। কাশ্মির প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইশফাক তান্ত্রি বলেন, ‘এই পদক্ষেপ মারাত্মক নিন্দনীয়। সরকারের উচিত এটি প্রত্যাহার করা এবং জম্মু ও কাশ্মিরে ভয় ও নিপীড়নের শঙ্কা ছাড়াই সংবাদমাধ্যমের কাজ চালানোর পরিবেশ সক্রিয় করা।‘

ভারতীয় কর্তৃপক্ষের ওই পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সুরক্ষায় কাজ করে যাওয়া অলাভজনক সংস্থা কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে)। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থাটির এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘আমরা অনুরাধা ভাসিন এবং কাশ্মির টাইমসকে ক্রমাগত লক্ষ্যবস্তু বানানো এবং হয়রানি করার নিন্দা জানাচ্ছি। কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই স্বাধীন এবং সমালোচক কণ্ঠরোধ করার প্রচেষ্টা থামাতে হবে আর অবশ্যই সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে শ্রদ্ধা দেখাতে হবে।‘

এর আগে গত ১৫ অক্টোবর স্থানীয় সংবাদ সংস্থা কাশ্মির নিউজ সার্ভিসকেও (কেএনএস) শ্রীনগরে তাদের কার্যালয় ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ। কেএনএস-এর এডিটর ইন চিফ মোহাম্মদ আসলাম বলেন, ‘জম্মু ও কাশ্মিরের সম্পত্তি বিভাগ থেকে ফোন করে আমাকে এক ঘণ্টার মধ্যে কার্যালয় খালি করে দিতে বলা হয়।’ তিনি বলেন, ‘কোনও কারণ জানানো হয়নি কিংবা কোনও নোটিশও দেওয়া হয়নি কিন্তু আমাদের মৌখিকভাবে তা করতে বলা হয়। ওই কর্মকর্তা আমাকে জানায় যে তাদের কাছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ রয়েছে।’

মোহাম্মদ আসলাম জানান ওই সম্পত্তিটি ২০০৪ সালে তার নামেই বরাদ্দ দেয় সরকার। আর এত দ্রুত খালি করে দিতে বলায় তিনি অবাক হয়ে যান। তিনি বলেন, ‘একদিকে আমাদের সরকারপন্থী বলে অভিযুক্ত করা হয় আবার অন্যদিকে আমরা সরকারের কাছ থেকে এই ধরনের পদক্ষেপের মুখোমুখি হই। কর্তৃপক্ষ যদি আমাদের খালি করে দিতেই বলবে তাহলে আমাদের অন্তত যৌক্তিক সময় দেওয়া উচিত।‘

এ বছরের শুরুতে কাশ্মিরের বেশ কয়েক শীর্ষ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে ভারতীয় পুলিশ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পোস্টের জেরে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর দেশদ্রোহী আইনে মামলা দায়ের করা হয়। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের ওই পদক্ষেপের নিন্দা জানায় সারা বিশ্বের সংবাদমাধ্যম ও অধিকার নিয়ে সরব বিভিন্ন গ্রুপ।

ভারতীয় কর্তৃপক্ষের আচরণের নিন্দা জানিয়ে অনুরাধা ভাসিনের প্রতি সংহতি জানিয়েছেন অঞ্চলটির দুই সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ এবং মেহবুবা মুফতি।

মেহবুবা মুফতি বলেন, ভারত সরকারের অবৈধ ও রাজ্যের বিশৃঙ্খল কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো স্থানীয় অল্প কয়েক জন সম্পাদকের একজন হলেন অনুরাধা ভাসিন। এক টুইট পোস্টে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি’কে ইঙ্গিত করে তিনি লেখেন, ‘শ্রীনগরে তার কার্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হলো যাদের সঙ্গে মতবিরোধ তার প্রতি বিজেপির প্রতিহিংসার সরাসরি প্রকাশ।‘

উল্লেখ্য, কাশ্মিরে যোগাযোগ বন্ধের জেরে এই বছর বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ভারতের অবস্থান দাঁড়ায় ১৪২ নম্বরে।